• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

ঈমানবিধ্বংসী সম্পর্ক

  • প্রকাশিত ২৯ মে ২০২১

রাশেদ নাইব

 

 

একটি মেয়ে যে কতটা সহজে একজন পুরুষের জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে তা সেই মেয়েটি নিজেও কল্পনা করতে পারে না। গুনাহের শুরুটা অনেক মিষ্টি, কিন্তু শেষটা অনেক তিক্ত। ঘুড়ি যখন নাটাই থেকে ছুটে যায়, তখন তাকে সামাল দেওয়া খুবই কষ্টকর হয়ে যায়। একজন মেয়ের হাসি, কান্না, চাহনি-সবকিছুতেই রয়েছে পুরুষের জন্য আকর্ষণ। সেই আকর্ষণে মুগ্ধ হয়ে কখন যে তা পরপুরুষের অন্তরে ভালোবাসার আল্পনা এঁকে দেয় তা হয়তো মেয়েটিও বুঝতে পারে না। আর এভাবেই শুরু হয় দুটি নর-নারীর গুনাহের পথে পথ চলা। আর সে পথ-চলা, হাসি-কান্নায় কখন যে একজন পুরুষের ভবিষ্যৎ‍ কল্পনার সাগরে অন্ধকারে হারিয়ে যায়। তা সেই পুরুষটি বুঝতে পারে খুবই পরে।

নারীর পর্দা শুধু তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঢাকার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং একজন নারীর জন্য আবশ্যক তার কণ্ঠ, কথা, লেখা, পুরুষের মনে আকর্ষণ তৈরি করে এমন সবকিছু থেকে নিজেকে বিরত রাখা। যাতে একজন নারীর দ্বারা কখনো কোনো পুরুষের জীবন, তার ভবিষ্যৎ‍ গুনাহের সাগরে অন্ধকার হয়ে না যায়। যাই হোক, বিবাহপূর্ব বা বিবাহবহির্ভূত প্রেম ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের জন্য হালাল সতী-সাধ্বী মুসলমান নারী এবং তাদের সতী-সাধ্বী নারী, যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে তোমাদের পূর্বে, যখন তোমরা তাদেরকে মোহরানা প্রদান করো তাদেরকে স্ত্রী করার জন্যে, কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার জন্যে কিংবা গুপ্ত প্রেমে লিপ্ত হওয়ার জন্যে নয়।’ (সুরা আল-মায়িদা, আয়াত-৫) সুতরাং, তারা স্বাধীনভাবে লালসা পূরণ কিংবা গোপনে লুকিয়ে প্রেমলীলা করবে না।

পর্দার আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয়ই তারা যা করে আল্লাহ তা সম্পর্কে অবগত আছেন।’ (সুরা নূর, আয়াত-৩০) এখানে পুরুষদের চোখ নিচু রাখতে এবং লজ্জাস্থান হিফাজত করতে বলা হয়েছে। আল্লাহ আরো বলেন, ‘ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং যৌন অঙ্গের হেফাজত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান, তাছাড়া তাদের সৌন্দর্যকে প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো কাছে তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্যে জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তওবা করো যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সুরা নুর, আয়াত-৩১)

ইরশাদ হয়েছে ‘হে, নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মতো নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, তবে পরপুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না, ফলে সেই ব্যক্তি (পরপুরুষ) কুবাসনা করে, যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে, তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে।’ (সুরা আল-আহযাব,   আয়াত-৩২) আল্লাহ আরো বলেন, ‘হে নবী, আপনি আপনার পত্নীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের ওপর টেনে নেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্ত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’ (সুরা আল-আহযাব, আয়াত-৫৯) এখানে আরো পরিষ্কার ভাষায় পর্দা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নবীপত্নীদের উল্লেখ করা হলেও তা সকল মুসলিম নারীর ওপর প্রযোজ্য। এখানে দৃষ্টি নিচু ও সংযত রাখা, কোমলভাবে কথা না বলা, লজ্জাস্থান হিফাজত করা এবং পর্দা করার কথা বলা হয়েছে। আর সুরা মায়িদাতে গোপন প্রেমলীলাকে নিষেধ করা হয়েছে। তাহলে বিবাহপূর্ব প্রেম বৈধ হতে পারে কি করে? এটি একটি সুস্পষ্ট হারাম সম্পর্ক। যেখানে আস্থা, বিশ্বাস, শ্রদ্ধাবোধ, প্রশান্তির চেয়ে বেশি থাকে সন্দেহ, শরীরকেন্দ্রিক ভোগবাদী চিন্তা, মানসিক উত্তেজনা আর ধীরে ধীরে আত্মিক অবক্ষয়। আমরা আমাদের চারপাশে এগুলোই দেখে এসেছি, এখনো দেখছি এবং ভবিষ্যতেও দেখবো।

ইসলাম দুইজন নারী পুরুষকে বিয়ের পবিত্র বন্ধনে বেঁধে তাদের শারীরিক, আত্মিক পবিত্রতা নিশ্চিত করে। একজন স্ত্রী ও একজন স্বামী একে অপরের প্রতি শ্রদ্বাবোধ, আস্থা, বিশ্বাসের যে সম্পর্ক তৈরি করে সেখানেই রয়েছে যথার্থ প্রশান্তি। একজন গার্লফ্রেন্ড যতটা অনিশ্চয়তা, ভয় আর আত্মসম্মানের হুমকি নিয়ে একজন বয়ফ্রেন্ডের সাথে অবৈধ শারীরিক সম্পর্কের দিকে যায়, একজন স্ত্রী ঠিক ততটাই আস্থা আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে ভাবতে পারে তার স্বামী তার পবিত্রতার সঙ্গী। তার স্বামী তার অনাগত সন্তানের বাবা। ইসলাম এভাবেই সুন্দর, পবিত্রতা, শরীর ও মনের ক্ষতি রোধ করে। এভাবেই দুজন নারী ও পুরুষকে একেবারে আপন করে দেয়। তার জন্য কোনো হারাম সম্পর্কের দরকার হয় না। মিথ্যার মায়ায় সান্ত্বনা খোঁজার প্রয়োজন হয় না।

তাছাড়া প্রেম বা ভালোবাসা হচ্ছে জিনা ব্যভিচারের প্রবেশপথ। ব্যভিচারের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, ‘আর ব্যভিচারের কাছেও যেও না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ ও মন্দ পথ।’ (সুরা বনী ইসরাইল, আয়াত-৩২) জিনার নিকটবর্তী হওয়ায় নিষেধ। অর্থাৎ‍ যে সকল জিনিস জিনার নিকটবর্তী করে দেয় তার কাছে যাওয়াই নিষেধ। বিবাহপূর্ব প্রেম নর-নারীকে জিনার নিকটবর্তী করে দেয়। আর জিনা হচ্ছে একটি মারাত্মক কবিরা গুনাহ। আল্লাহ বলেন, ‘এবং যারা আল্লাহতায়ালার সাথে অন্য উপাস্যর ইবাদত করে না, আল্লাহ যার হত্যা অবৈধ করেছেন, সঙ্গত কারণ ব্যতীত তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না। যারা একাজ করে তারা শাস্তির সম্মুখীন হবে। কেয়ামতের দিন তাদের শাস্তি দ্বিগুণ হবে এবং তথায় লাঞ্ছিত অবস্থায় চিরকাল বসবাস করবে।’ (সুরা ফুরকান, আয়াত-৬৮,৬৯)

বিবাহপূর্ব প্রেম অনেক সময় বান্দাকে শিরকের নিকটবর্তী করে দেয়। কারণ অনেকসময় তারা একে অপরকে এতটাই ভালোবাসা শুরু করে দেয় যে, যেই ভালোবাসা পাওয়ার দাবিদার একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহ বলেন, ‘আর কোনো লোক এমনও রয়েছে যারা অন্যকে আল্লাহতায়ালার সমকক্ষ সাব্যস্ত করে এবং তাদের প্রতি তেমনি ভালোবাসা পোষণ করে, যেমন আল্লাহতায়ালার প্রতি ভালোবাসা হয়ে থাকে। কিন্তু যারা আল্লাহতায়ালার প্রতি ঈমানদার তাদের ভালোবাসা ওদের তুলনায় বহুগুণ বেশি। আর কতইনা উত্তম হতো যদি এ জালেমরা পার্থিব কোনো কোনো আজাব প্রত্যক্ষ করেই উপলব্ধি করে নিত যে, যাবতীয় ক্ষমতা শুধুমাত্র আল্লাহতায়ালারই জন্যে এবং আল্লাহতায়ালার আজাবই সবচেয়ে কঠিনতর।’ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত-১৬৫)

উমর (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো পুরুষ যখন কোনো নারীর সাথে একান্তে থাকে, তখন তাদের মাঝে তৃতীয় জন হিসেবে উপস্থিত হয় স্বয়ং শয়তান, তাদের মাঝে ভাবাবেগকে উৎ‍সাহিত করে এবং উভয়ের মাঝে খারাপ কুমন্ত্রণা দিতে থাকে এবং সর্বশেষে লজ্জাকর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায়।’ সুতরাং বোঝা যায় যে, নিভৃতে বেগানা নারী-পুরুষ এক সাথে নির্জন স্থানে বসা জায়েয নেই। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত আলী (রা.)কে লক্ষ্য করে বলেন, ‘হে আলী, তুমি (নারীর প্রতি) একবার তাকানোর পর পুনর্বার তাকাবে না। তোমার প্রথম দৃষ্টিপাত ক্ষমার যোগ্য। কিন্তু দ্বিতীয়বার নয়।’ অনেকেই মনে করেন যে, ‘কোনো নারী হিজাব অবস্থায় থাকলে (মুখ ও কব্জি যদি খোলা থাকে) তখন বারবার তাকানোতে দোষ নেই। এই হাদিস থেকে আশাকরি তারা শিক্ষা নিতে পারবেন। আবার অনেকে মনে করে থাকেন, নারীর প্রতি একবার তাকানো বৈধ। না, ব্যাপারটি এমন নয়। উল্লিখিত হাদিসের ভাষ্য হলো, যদি কোনো নারী চোখের সামনে পড়ে যায় এবং অনিচ্ছাকৃতভাবে দেখে ফেলে; এটা ক্ষমাযোগ্য। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে তাকিয়ে দেখা যাবে না এবং চোখ পড়লে সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিতে হবে।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘হে যুবসমাজ, তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ের সামর্থ্য রাখে, তাদের বিয়ে করা কর্তব্য। কেননা বিয়ে দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণকারী, যৌনাঙ্গের পবিত্রতা রক্ষাকারী। আর যাদের সামর্থ্য নেই তারা যেন সিয়াম পালন করে। কেননা সিয়াম হচ্ছে যৌবনকে দমন করার মাধ্যম।’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত, হাদিস নং-৩০৮০ নিকাহ অধ্যায়)

 

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads