• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

প্রভুর সামীপ্যলাভে সালাতে তাহাজ্জুদ

  • প্রকাশিত ০৪ জুলাই ২০২১

আবু তালহা রায়হান

আকাশে তারার মৃদু স্ফুরণ, ঝিঁঝি পোকার মন-মাতানো সুর, ছন্দ আর হিমশীতল দখিনা বাতাসে পৃথিবী যখন নীরব ঘুমায় তখন একদল প্রেমিক চোখে অশ্রু, হাতে তাসবিহ, কণ্ঠে মহাগ্রন্থের মহাধ্বনি তুলে প্রভুর সামীপ্য খোঁজে। দিনের ক্লান্তি শেষে শান্ত রাতে পৃথিবী যখন নিজেকে প্রশান্তির চাদরে আবৃত করে, মুমিনবান্দা তখন আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদ পড়ে। রবকে ডাকে। সিজদায় লুটে মাটির মানুষ মাটির গন্ধে মাতে, দুহাত তুলে ভিখারির বেশে নিজেকে রব্বে-কাবার দরবারে উপস্থাপন করে। আল্লাহ, আল্লাহ বলে মধুর সুরে তাসবিহ জপে। এ এক স্নিগ্ধ অনুভূতি, দারুণ ভালো লাগা, যা প্রশান্তির সাগরে পবিত্রতার ঢেউ তোলে। পাপিষ্ঠ নাফসকে পুণ্যের মহাত্মায় জাগ্রত করে। আল্লাহর সঙ্গে বান্দার প্রেমময় সম্পর্ক স্থাপন করে।

মহামহিম আল্লাহতায়ালা নশ্বর এ পৃথিবীর মালিক, সৃষ্টিকর্তা। সৃষ্টিজাত সকলেই স্বীয় ভাষা ও ভঙ্গির মাধ্যমে তাঁর একত্ববাদের উপাসনা করে। কিন্তু  আল্লাহর কাছে মানুষের ইবাদত-বন্দেগি বেশ পছন্দনীয়।  আর তাই মানবজাতিকে মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর ইবাদতের উপযোগী করে জ্ঞান, বোধ ও কথা বলার শক্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদাদান করেছেন। যা অন্য কাউকে দেন নি। মানুষকে পাপ ও পুণ্যের পথ দেখিয়েছেন। মানুষ চাইলে পুণ্যের পথে নিজেকে উৎসর্গ করে চিরস্থায়ী সুখের ঠিকানা জান্নাতে যেতে  পারে। আবার চাইলে নাফসের পূজায় লিপ্ত হয়ে পাপের পথে পা বাড়িয়ে জাহান্নামের  পথিক হতে পারে। মানবজাতির মধ্যে যারা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী হয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হবে, তাদের ওপর আল্লাহতায়ালা প্রতিদিন পাঁচবার সালাত আদায় করার বিধান ফরজ করেছেন।

 

দৈনন্দিন পাঁচবার সালাত আদায়ের পাশাপাশি প্রভুর সামীপ্যলাভের জন্য আরো বিশেষ কিছু সালাত রয়েছে। যেগুলো আদায়ে বান্দার আল্লাহর সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন হয়। ইহকাল ও পরকালীন সাফল্য অর্জিত হয়। বান্দা যা চায়, আল্লাহ তা-ই দেন। এসব সালাতসমূহের অন্যতম হলো ‘তাহাজ্জুদের সালাত।’ তাহাজ্জুদের সালাত মানুষের চিন্তাচেতনা ও চরিত্রকে নির্মল করে। হকের পথে মানুষকে অবিচল রাখে। আত্মতৃপ্তি দান করে মানুষকে দুনিয়াবিমুখ করে তোলে। আখিরাতের চিন্তায় বিভোর করে। এ সালাতের ফজিলত প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদের সালাত কায়েম করুন, এটা আপনার জন্য এক অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায় আপনার রব আপনাকে  মাকামে মাহমুদে প্রতিষ্ঠিত করবেন।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াাত-৭৯)  মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের সুরা মুজ্জাম্মিলে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘নিশ্চয় রাতে ঘুম থেকে উঠা মনকে দমিত করার জন্য খুব বেশি কার্যকর এবং সে সময়ের  কোরআন তিলাওয়াত বা জিকির একেবারে যথার্থ।’ অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘আর আল্লাহর প্রিয়বান্দা তাঁরা, যারা তাদের রবের দরবারে সিজদা করে এবং দাঁড়িয়ে থেকেই রাত্রিযাপন করে।’ (সুরা ফুরকান, আয়াত-৬৪)

ইসলামের সূচনালগ্নে কাফিরদের  বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ী হওয়ার পেছনে মূল ভূমিকা ছিল শেষ রাতের ইবাদত, তাহাজ্জুদের সালাত। মুসলমানরা তখন রাতের শেষ ভাগে আল্লাহর দরবারে চোখের পানি ফেলতেন, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাত্রিযাপন করে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। যেমন কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা ছিল কঠিন পরীক্ষায় পরম ধৈর্যশীল, অটল-অবিচল, সত্যের অনুসারী, পরম অনুগত। আল্লাহর পথে ধন-সম্পদ উৎসর্গকারী এবং রাতের শেষ প্রহরে আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত- ১৭) প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসেও তাহাজ্জুদ সালাতের গুরুত্বের কথা উল্লেখ রয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘ফরজ সালাতের পর সবচেয়ে উত্তম সালাত হলো তাহাজ্জুদের সালাত।’ হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত অন্য এক হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়ভাগে নিকটবর্তী আসমানে অবতীর্ণ হয়ে বলতে থাকেন, ‘কে আছো যে আমায় ডাকবে, আর আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কে আছো যে আমার কাছে কিছু চাইবে, আর আমি তাকে তা দান করব। কে আছো যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আর আমি তাকে ক্ষমা করব।’ (বুখারি ও মুসলিম)

হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির প্রতি আল্লাহ খুশি হন। এক. যে ব্যক্তি শেষ রাতে উঠে এবং তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে। দুই. যেসব মুসল্লি  সালাত আদায়ের জন্য সারিবদ্ধভাবে কাতারে দাঁড়ান। তিন. ওই সব মুজাহিদ যারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করার জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ান।’ আলোচ্য আয়াত ও হাদিসের মাধ্যমে একথা প্রতীয়মান হয় যে, তাহাজ্জুদের সালাত মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মুমিন বান্দার  জন্য এক বিশেষ নেয়ামত। মুমিন বান্দা পার্থিব ও পরকালীন জীবনে এই নেয়ামতের ফল ভোগ করতে থাকে। এ সালাত আদায়ের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর সামীপ্যলাভ করে। আসুন, আমরা তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করি, নাফসকে পবিত্র করি, আল্লাহর প্রিয়বান্দা হই! আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দান করুন। আমিন!

 

 

লেখক : ছড়াকার, সাংবাদিক

abutalharayhan62@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads