• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

লকডাউনে বিশেষ কিছু আমল

  • প্রকাশিত ০৫ জুলাই ২০২১

ডা. মুহাম্মাদ  মাহতাব হোসাইন মাজেদ

 

গত ১ জুলাই থেকে সারা দেশে চলছে সাত দিনের সর্বাত্মক ‘কঠোর লকডাউন’। আর এ সময়ে নিজেকে আমলের মধ্যে ডুবে থাকার সূবর্ণ সুযোগ। দুনিয়ার নানা ব্যস্ততায় ইবাদতের জন্য সময় বের করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। লকডাউনে সেরকম কোনো ব্যস্ততা না থাকায় পুরো সময়টা থাকছে আমলের জন্য উন্মুক্ত। আতঙ্কিত সারা দেশ। দিশেহারা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। নানান বিজ্ঞ ব্যক্তিরা দিচ্ছেন প্রতিকারমূলক মতামত। বিভিন্ন সভা সেমিনারে চলছে দ্বিতীয় ঢেউর সচেতনতামূলক প্রচারণা। এতকিছুর পরেও থেমে নেই করোনার বিস্তার। এ পর্যন্ত ২১৫টি দেশ ও অঞ্চলের মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এতে। আমেরিকাসহ পৃথিবীর পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলোও করোনার ছোবলের বাইরে নয়। এতোকিছুর পরেও এখনো মানুষ বুঝতে পারছে না।

এই করোনার ধ্বংসলীলার শক্তির উৎসটা কোথায়। স্বল্পসংখ্যক বাদে অধিকাংশই শুধু সায়েন্টিফিক সমাধানে ব্যস্ত। এই ক্ষেত্রে ইসলাম কি বলে। করোনা হলো আসমানি বালা-মুসিবত। এরকম গজব যা বান্দাদের জন্য শাস্তিস্বরূপ আসে। আবার কখনোবা বান্দাকে সঠিক পথে ফিরে আসার সুযোগ হিসেবেও আসে, যেসব রোগের শুরুতেই কোনো প্রতিষেধক নেই, সেসব রোগে মানুষ আক্রান্ত হবার ভয়ে, খাঁটি মুমিন বাদে অনেকেই এলামেলো বকতে শুরু করে। এতে বান্দা-বান্দিদের ঈমানি শক্তি লোপ পাবার সঙ্গে সঙ্গে, কখনো কখনো ঈমানহারা হয়ে যায়। ধৈর্যহারা হলেই শেষ। খাঁটি মুমিন কখনো আজাবে ধৈর্যহারা কিংবা আতঙ্কিত হয় না; বরং তারা আরো বেশি আল্লাহর পথে নিজেকে রুজু করে। বান্দাদের কৃতকর্মের কারণে যখন আজাব-গজব আসে, তখন পরহেজগার ব্যক্তিসহ শিশু-বৃদ্ধ কেউই রেহাই পায় না।

রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘ইসলামে ব্যাধি সংক্রমণের কোনো বাস্তবতা নেই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৭৫৫৭) তাই সব মুসলমানের মৌলিক আকিদা ও বিশ্বাস হবে, যে কোনো রোগ সরাসরি আল্লাহর হুকুমেই প্রকাশ পায়। তবে হ্যাঁ, পৃথিবী আসবাবের জগৎ তথা কারণ ও উপকরণ প্রকাশের ক্ষেত্র হলো পৃথিবী। তাই ইসলাম কারণ ও উপকরণের স্বীকৃতি দিয়েছে। যেমন হাদিসে বলা হয়েছে, ‘কুষ্ঠরোগী থেকে এমনভাবে পলায়ন করো, যেমন তুমি বাঘ থেকে পলায়ন করে থাক।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-১৭৬৭) এতে বোঝা গেল, সংক্রমণটাও আল্লাহর হুকুমে হয়। রোগের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই। এ আলোচনার মাধ্যমে এটাও পরিষ্কার হয়ে গেল যে, ইসলাম সংক্রমণের অস্তিত্ব অস্বীকার করেনি। তবে একে চূড়ান্ত ক্ষমতাধর জ্ঞান করতে নিষেধ করেছে। হজরত আলী (রা.) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি হাদিস বর্ণনা করেন, ‘তোমরা কুষ্ঠরোগীদের বারবার দেখতে যেয়ো না, আর তাদের সঙ্গে যখন কথা বলবে তখন তাদের এবং তোমাদের মাঝখানে একটি বর্শার পরিমাণ দূরত্ব থাকা উচিত।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং-৫৮১) সাকিফ গোত্রের একটি প্রতিনিধি দল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে উপস্থিত হয়। তাদের মধ্যে একজন কুষ্ঠরোগী ছিল। সে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে হাত দিয়ে বাইআত হতে চেয়েছিল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার হাতে হাত না মিলিয়ে বলেন, ‘আমি তোমাকে (স্পর্শ না করেই) বাইআত করালাম, অতএব তুমি চলে যাও।’ (সহিহ মুসলিম, হদিস নং-২২৩১)

হাদিস শরিফে প্লেগ সম্পর্কিত বর্ণনায় এসেছে, ‘যদি কোনো স্থানে প্লেগ প্রকাশ পাওয়ার কথা শোনো, তখন তথায় প্রবেশ করো না। আর যদি তোমাদের বসবাসের এলাকায় প্লেগ দেখা দেয়, তখন সেখান থেকে পালিয়ে যেয়ো না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৫৭২৭, ৫৭২৮) এতে বোঝা যায়, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্লেগ-বিদূষিত এলাকায় এজন্য যেতে নিষেধ করেছেন যে, সেখানে গেলে প্লেগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। যেহেতু পৃথিবী আসবাবের জগৎ। আর যারা আগে থেকেই প্লেগ-বিদূষিত এলাকায় আছে, তাদের সেখান থেকে বের হতে এজন্য নিষেধ করেছেন, যেন সুস্থ ব্যক্তিরা রোগীদের সেবা করতে পারে। আবার সে যদি নিজের সঙ্গে রোগের জীবাণুগুলো নিয়ে অন্য এলাকায় যায়, তবে সেখানেও এই রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। অতএব, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ মহল যেসব বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে, তা শরিয়তের দৃষ্টিতে বাস্তবায়ন করা জরুরি। যদি কোনো ব্যক্তি এই রোগে আক্রান্ত হয়, সমাজের অন্য লোকদের দায়িত্ব হলো তার চিকিৎসা ও সুস্থতার জন্য যথাযথ চেষ্টা করা। আর রোগীর দায়িত্ব হলো, এমন কাজ থেকে বিরত থাকা, যার দ্বারা অন্য ব্যক্তি আক্রান্ত হতে পারে। তবে এই পরিমাণ সতর্কতা নয়, যার দ্বারা শরিয়তের জরুরি আমল বর্জিত হয়।

করোনাকালীন সময়ে জরুরি দোয়া ও আমল : ১. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ অনুসরণে রোগমুক্তির উদ্দেশ্যে সবাই সালাতুল হাজাত আদায় করবে। এটা অত্যন্ত উপকারী ও পরীক্ষিত আমল।

২. হাদিসে বর্ণিত দোয়াগুলো বেশি বেশি পড়বে। উচ্চারণ : ‘রাব্বিগ ফিরলি ওয়ার হামনি।’ অর্থ : হে আল্লাহ, আমাকে মাফ করে দিন এবং আমার ওপর অনুগ্রহ করুন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-৮৯৪) উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারাসি, ওয়াল জুনুনি, ওয়াল জুজামি, ওয়ামিন সাইয়্যিইল আসকাম।’ অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই শ্বেত, উন্মাদনা, কুষ্ঠ এবং সব দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে।’ (আবু দাউদ, হাদিস নং-১৫৫৪) উচ্চারণ : ‘বিসমিল্লাহিল্লাজি লা ইয়াদুররু মাআসমিহি শাইয়ুন ফিল আরদি ওয়ালা ফিস সামায়ি ওয়া হুয়াস সামিউল আলিম।’ অর্থ : আল্লাহর নামে, যাঁর নামের বরকতে আসমান ও জমিনের কোনো কিছুই কোনো ক্ষতি করতে পারে না। তিনি সব কিছু শোনেন এবং সব কিছু জানেন। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, এই দোয়া সকালে পাঠ করলে সারা দিন নিরাপদে থাকবে আর বিকেলে পাঠ করলে সারা রাত্রি নিরাপদে থাকবে। (আবু দাউদ, হাদিস নং- ৫০৮৬)

৩. আয়াতুল কুরসি পাঠ করবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব বিপদাপদ থেকে নিরাপদ থাকার জন্য সাহাবায়ে কেরামকে আয়াতুল কুরসি তিলাওয়াত করার তাগিদ দিয়েছেন। এটি পাঠ করে নিজের শরীরে ও বাচ্চাদের শরীরে দম করবে (ফুঁ দেবে)। ৪. সকাল-বিকেল সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত করবে। সুরা ফাতিহার অন্য নাম দোয়ার সুরা ও শিফার সুরা। ৫. সকাল-বিকেল সুরা ফালাক ও সুরা নাস পাঠ করে নিজের শরীরে ও বাচ্চাদের শরীরে দম করবে (ফুঁ দেবে)। আর করোনাভাইরাসের মতো কঠিন রোগবালাইর সময় চিকিৎসক, সরকার ও ধর্মীয় নিয়মাবলিগুলো অনুসরণ করা কর্তব্য। ধর্মীয় গোড়ামি হতে চিকিৎসকের পরামর্শ ও সরকারের আইন অমান্য করাটাও ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত গর্হিত হিসেবে বিবেচ্য। মুমিন বান্দাদের এই সময়ে ধৈর্যের সঙ্গে আরো বেশি বেশি আমল বাড়িয়ে দিতে হবে। সেই সঙ্গে আমলের বরকত সম্পর্কে অন্যদের মাঝেও ছড়িয়ে দিতে হবে।

প্রত্যেক আসমানি রোগবালাইর সময়েই কতিপয় হক্কানী আলেমসমাজ হতে প্রতিকারের বিশেষ আমল আসে। যা তারা অবস্থার ওপরে বলে থাকেন। কখনোবা স্বপ্নযোগেও পেয়ে থাকেন। এবারের মহামারি করোনায় বিখ্যাত আলেম সুপরিচিত ইসলামী ব্যক্তিত্ব হজরত মুফতি তাকী ওসমানী (দা. মা.) করোনা হতে রক্ষা পাবার জন্য আমল দিয়েছেন। যথাক্রমে ১/সুরা ফাতিহা তিনবার ২/ সুরা এখলাস তিনবার ও হাসবুনাল্লাহু ওয়া নিমাল ওয়াকিল ৩১৩ বার পাঠ করবে।

মুমনিদেরকে সর্বাস্থায় খেয়াল রাখতে হবে, আমার আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট। সুতরাং হতাশ হওয়ার সুযোগ নেই। হতাশাগ্রস্তরা বিপথগামী। আসুন দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে বাড়িতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার মজুত না করে, স্বাস্থ্যকর্মীদের পরামর্শ পালনের পাশাপাশি বেশি বেশি এস্তেগফার পড়ায় অভ্যস্ত হই। সেই সঙ্গে ওলামায়ে দেওবন্দ ইসলামী সব মহলে গ্রহণযোগ্য আলেমে দীন হজরত মুফতি তাকী ওসমানী (দা.) কর্তৃক জানিয়ে দেওয়া করোনা হতে বাঁচার বিশেষ আমলে, নিজেরাসহ অন্যদেরকেও ব্রত করার চেষ্টা করি। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে করোনা নামক এই মহামারি ভাইরাস থেকে হেফাজত করুন। নফল ইবাদতের মধ্যে সালাতুল তাহাজ্জুদ, সালাতুত তাসবিহ ছাড়াও ফরজ নামাজের পরে অতিরিক্ত নফল নামাজ এবং বাকি সময়ে আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

 

লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক স্বাস্থ্য তথ্য

কো-চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ রোগী কল্যাণ সোসাইটি

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads