• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

গুনাহ থেকে তওবা করা ওয়াজিব

  • প্রকাশিত ০৬ জুলাই ২০২১

মনিরুজ্জামান খান

নিঃসন্দেহে ভুল ও কসুর মানুষের প্রকৃতিজাত। কোনো মুকাল্লাফ (শারঈ দায়িত্বপ্রাপ্ত) ব্যক্তিই আনুগত্যের ক্ষেত্রে কসুর কিংবা ভুল ও গাফলতি, নতুবা ত্রুটি ও বিস্মৃতি, নচেৎ গুনাহ ও পাপমুক্ত নয়। আমরা প্রত্যেকেই কসুরকারী ও গুনাহগার, ভুলকারী। কখনো কখনো আমরা আল্লাহর অভিমুখী হই; আবার কখনো কখনো পিছিয়ে আসি। কখনো কখনো আল্লাহ‌র নজরদারিকে স্মরণে রাখি; আবার কখনো কখনো গাফলতি আমাদের ওপর ভর করে বসে। আমরা গুনাহমুক্ত নই। আমাদের থেকে গুনাহ ঘটেই থাকে। যেহেতু আমরা মাসুম বা নিষ্পাপ নই। এ জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমি ওই সত্তার শপথ করে বলছি, যার হাতে রয়েছে আমার প্রাণ। যদি তোমরা গুনাহ না করতে তবে আল্লাহ অবশ্যই তোমাদেরকে ধ্বংস করে এমন এক সমপ্রদায়কে সৃষ্টি করতেন, যারা গুনাহ করে আবার ক্ষমা প্রার্থনা করে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-২৭৪৯) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, “প্রত্যেক বনী আদম গুনাহগার। আর গুনাহকারীদের মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছে ‘তওবাকারীগণ’।” (সুনানে তিরমিযি, হাদিস নং-২৪৯৯)

 

দুর্বল মানবের প্রতি আল্লাহর দয়া হচ্ছে  তিনি তার জন্য তওবার দ্বার উন্মুক্ত রেখেছেন এবং তাকে নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর দিকে ফিরে আসার ও তাঁর অভিমুখী হওয়ার; যখনই পাপ তাকে পরাভূত করে কিংবা গুনাহ তাকে দূষিত করে। যদি এমনটি না হতো তাহলে মানুষ কঠিন সংকটে পড়ে যেত, স্বীয় প্রতিপালকের নৈকট্য হাসিলে তার হিম্মত হ্রাস পেত এবং আপন প্রভুর ক্ষমা পাওয়ার আশা ছিন্ন হতো। তাই তওবা হচ্ছে, মানুষের ঘাটতি ও কসুরের অনিবার্য দাবি। আল্লাহতায়ালা এ উম্মতের সব শ্রেণির মানুষের ওপর তওবা করা ওয়াজিব করে দিয়েছেন; যারা নেক কাজে অগ্রণী, যারা পরিমিত নেক আমলকারী এবং যারা পাপকাজের মাধ্যমে নিজেদের ওপর জুলুমকারী সবার ওপর। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তওবা করো, যাতে তোমরা সফল হও।’ (সুরাহ আন-নূর, আয়াত- ৩১) আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে খাঁটি তওবা করো।’ [সুরা আত-তাহরীম, আয়াত-৮) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘ওহে লোকসকল! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবাহ ও ইস্তিগফার করো। নিশ্চয়ই আমি দিনে একশবার তওবা করি।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-২৭০২)

আল্লাহতায়ালার রহমত অবারিত, বান্দার প্রতি তাঁর দয়া সর্বব্যাপী। তিনি সহিষ্ণু; তাৎক্ষণিকভাবে আমাদেরকে পাকড়াও করেন না, শাস্তি দেন না, কিংবা ধ্বংস করে দেন না; বরং আমাদেরকে সময় দেন। তিনি তাঁর নবীকে নির্দেশ দিয়েছেন যাতে করে তিনি তাঁর মহানুভবতার ঘোষণা দেন, ‘বলে দিন, ‘হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের ওপর বাড়াবাড়ি করেছ! আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ তো সব গুনাহ মাফ করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি পরম ক্ষমাশীল, অসীম দয়ালু।’ (সুরা আয-জুমার, আয়াত -৫৩) বান্দার প্রতি কোমল হয়ে তিনি বলেন, ‘তবে কি তারা আল্লাহর কাছে তওবাহ করবে না (ফিরে আসবে না), তাঁর কাছে ইস্তিগফার করবে না (ক্ষমাপ্রার্থনা করবে না)? আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা মায়িদাহ, আয়াত-৭৪) তিনি আরো বলেন, ‘আর যে তওবা করে, ঈমান রাখে, সৎকাজ করে এবং সঠিক পথে অবিচল থাকে তার প্রতি আমি অবশ্যই ক্ষমাশীল।’ (সুরা ত্বহা, আয়াত- ৮২) তিনি আরো বলেন, ‘এবং আর যারা কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা নিজেদের প্রতি জুলুম করে ফেললে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজেদের পাপের জন্য ইস্তিগফার করে (ক্ষমা চায়)। আল্লাহ ছাড়া পাপ ক্ষমা করবে কে? আর তারা জেনেশুনে নিজেদের কৃতকর্মের ওপর জিদ ধরে থাকে না।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-১৩৫) তিনি আরো বলেন, ‘যে লোক কোনো খারাপ কাজ করে কিংবা নিজের প্রতি জুলুম করে, তারপর আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা চায় সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল ও দয়ালু পাবে।’ (সুরা আন-নিসা, আয়াত- ১১০)

আল্লাহ মুনাফিকদের জন্যেও তওবার দরজা উন্মুক্ত রেখেছেন; যারা প্রকাশ্য কাফেরদের চেয়েও নিকৃষ্ট কাফের। তাদের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মুনাফিকদের জায়গা হবে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে। আর আপনি তাদের জন্য কোনো সাহায্যকারী পাবেন না; সেই সব লোক ব্যতীত যারা তওবা করে, নিজেদের অবস্থা সংশোধন করে, আল্লাহকে (আল্লাহর বিধানকে) আঁকড়ে ধরে এবং নিজেদের ধার্মিকতাকে কেবল আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ করে; এমন লোকেরা মুমিনদের সাথে থাকবে। অচিরেই আল্লাহ‌ মুমিনদেরকে এক মহান প্রতিদান দেবেন।’ (সুরা আন-নিসা, আয়াত-১৪৫, ১৪৬) প্রতিপালকের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি তওবা কবুল করেন এবং তাঁর মহানুভবতা ও অনুগ্রহের কারণে তিনি এতে খুশি হন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনিই তাঁর বান্দাদের তওবা কবুল করেন এবং তাদের পাপসমূহ ক্ষমা করেন। আর তোমরা যা কিছু কর তিনি তা জানেন।’ (সুরাহ শুরা, আয়াত-২৫) তিনি আরো বলেন, ‘তারা কি জানে না যে, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের তওবা কবুল করেন ও (তাদের) দান-সদকা গ্রহণ করেন এবং কেবল আল্লাহই ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’ (সুরা আত-তওবাহ, আয়াত-১০৪)

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খাদেম হামজার পিতা আনাস বিন মালেক আল-আনসারী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া উট খুঁজে পেয়ে যতটা খুশি হয়, নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর বান্দার তওবাতে এর চেয়েও বেশি খুশি হন।’ (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম) সহিহ মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় এসেছে, “নিশ্চয় বান্দার তওবাতে আল্লাহ তোমাদের ওই ব্যক্তির চেয়ে অধিক আনন্দিত হন, যে ব্যক্তি বিজন মরুর প্রান্তরে উট হারিয়ে ফেলেছে। যে উটের পিঠে তার খাদ্যপানীয় ছিল। উট হারানোর কারণে হতাশ হয়ে গাছের ছায়ায় এসে শুয়ে পড়ল। এমন পরিস্থিতিতে সে হঠাৎ দেখতে পেল তার উট তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তখন সে উটের লাগাম ধরে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে বলতে লাগল ‘হে আল্লাহ, তুমি আমার বান্দা আমি তোমার প্রভু!’ অতি আনন্দের কারণে সে এভাবে ভুল কথা বলে ফেলল।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-২৭৪৭)

তওবার সওয়াব হচ্ছে, ভালো জীবন; যে জীবন হবে ঈমান, অল্পে তুষ্টি, সন্তুষ্টি, আত্মপ্রশান্তি, নিশ্চিন্ততা ও নিষ্কলুষ হূদয়ের ছায়ায় ধন্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা তোমাদের প্রভুর কাছে ইস্তিগফার কর (ক্ষমা চাও) ও তওবা করো (তাঁর দিকে ফিরে এসো)। তাহলে তিনি তোমাদেরকে এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সুন্দরভাবে (জীবনের সুখ) ভোগ করতে দেবেন এবং প্রত্যেক মর্যাদাবানকে তার (যথার্থ) মর্যাদা দেবেন।’ (সুরাহ হুদ, আয়াত-৩) আসমান থেকে অবতীর্ণ বরকত, জমিনে দৃশ্যমান বরকত, সন্তান-সন্ততির বৃদ্ধি, উৎপাদনে বরকত, শরীরের রোগমুক্তি, বিপদাপদ থেকে সুরক্ষা ইত্যাদি। আল্লাহতায়ালা হুদ আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেন, ‘আর হে আমার সমপ্রদায়! তোমরা তোমাদের প্রভুর কাছে ইস্তিগফার করো (ক্ষমা চাও), তারপর তওবা করো (তাঁর দিকে ফিরে আস); তাহলে তিনি আসমান থেকে তোমাদের ওপর বারিধারা বর্ষণ করবেন এবং তোমাদের শক্তির সাথে আরো শক্তি বাড়িয়ে দেবেন। অতএব তোমরা অপরাধী হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিও না।’ (সুরাহ হুদ, আয়াত-৫২) যে কেউ তওবা করলে আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন। তওবাকারীদের কাফেলা চলমান থাকবে। পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় ঘটার পূর্ব পর্যন্ত এ কাফেলা থামবে না। প্রত্যেক পাপ থেকে আল্লাহ‌র কাছে তওবাকারীকে স্বাগতম। খাঁটি তওবার মাধ্যমে সে যেন নবজাতক শিশুর মতো হয়ে গেল।

তওবা শব্দের অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর দিকে ফিরে আসা, গুনাহ ত্যাগ করা, গুনাহকে অপছন্দ করা, নেক কাজে কসুর হওয়ার জন্য অনুতপ্ত হওয়া। ইমাম নববী (রহ.) বলেন, ‘আলেমগণ বলেন, প্রত্যেক গুনাহ থেকে তওবা করা ওয়াজিব। যদি গুনাহটি বান্দার মাঝে ও আল্লাহর মাঝে হয়ে থাকে; কোনো মানুষের হকের সাথে সম্পৃক্ত না হয় তাহলে সে তওবার জন্য শর্ত তিনটি- ১. গুনাহ ত্যাগ করা। ২. কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হওয়া। ৩. সে গুনাতে পুনরায় লিপ্ত না হওয়ার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেওয়া। যদি এ তিনটি শর্তের কোনো একটি না পাওয়া যায় তাহলে সে তওবা শুদ্ধ হবে না।

আর যদি গুনাহটি মানুষের সাথে সম্পৃক্ত হয় তাহলে সে তওবার জন্য শর্ত চারটি- উল্লেখিত তিনটি এবং হকদারের হক থেকে নিজেকে মুক্ত করা; যদি সম্পদ বা এ জাতীয় কিছু হয় তাহলে সেটা মালিককে ফিরিয়ে দেওয়া। আর যদি অপবাদ এবং এ ধরনের কিছু হয় তাহলে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য নিজেকে তার কাছে পেশ করা কিংবা ক্ষমা চেয়ে নেওয়া। আর যদি গীবত হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে মাফ চেয়ে নেওয়া। সকল গুনাহ থেকে তওবা করা ওয়াজিব। যদি কেউ কিছু গুনাহ থেকে তওবা করে তাহলে মুহাক্কিক আলেমদের মতে সে যে গুনাহ থেকে তওবা করেছে সে গুনাহ থেকে তার তওবা শুদ্ধ হবে এবং অন্যান্য গুনাহ থেকে তওবা করা বাকি থাকবে।’

 

লেখক : শিক্ষার্থী, দারুল উলুম হাটহাজারী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads