• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

জুলুমের ব্যাপকতা এবং যেভাবে সংঘটিত হয়

  • প্রকাশিত ০৮ জুলাই ২০২১

আবদুর রশীদ

 

 

পৃথিবীর প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যে যেমন রয়েছে পরস্পর পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি ও সহযোগিতা, ঠিক তেমনি রয়েছে পরস্পর পরস্পরের প্রতি জুলুম বা অন্যায় আচরণের প্রবণতা। জুলুম এমন একটা অপরাধ বা অন্যায় যার অস্তিত্ব প্রতিটি সেক্টরে লক্ষ করা যায়। সাধারণত জুলুম বলতে আমরা বুঝি কাউকে অন্যায়ভাবে আঘাত করা, ধনসম্পদ নষ্ট করা, হত্যা করা ইত্যাদি। কিন্তু জুলুম অত্যন্ত ব্যাপক অর্থ বহন করে থাকে। জুলুম হতে পারে স্রষ্টার প্রতি, নিজের প্রতি, অন্যের প্রতি, প্রাণীর প্রতি ও উদ্ভিদের প্রতি ইত্যাদি। এছাড়াও জুলুম প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও বস্তুর প্রতিও হতে পারে। তাই, জুলুম সম্পর্কে জ্ঞান রাখা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। হাদিসে এসেছে, ‘নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মহান প্রতিপালকের পক্ষ থেকে বর্ণনা করেন। আল্লাহ বলেন, হে আমার বান্দারা! আমি আমার জন্য জুলুম হারাম করেছি আর তা (জুলুম) তোমাদের পরস্পরের মধ্যেও হারাম করেছি। অতএব, তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম করো না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-৬৭৩৭) পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ বিশ্বজগতের প্রতি কোনো জুলুম করতে চান না।’ (সুরা আল-ইমরান, আয়াত-১০৮) আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনার প্রভু কারো ওপর জুলুম করেন না ।’ (সুরা কাহাফ, আয়াত-৪৯)

জুলুম শব্দের সাধারণ অর্থ হলো-বস্তুকে তার সঠিক জায়গায় দাখিল না করা। এছাড়াও অত্যাচার, অবিচার, জবরদস্তি, উৎপীড়ন, সীমালঙ্ঘন ইত্যাদি বুঝায়। সুতরাং স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে জুলুমের অর্থ ব্যাপক। যাপিত জীবনে যেভাবে আমরা স্রষ্টার প্রতি জুলুম করে থাকি সে সম্পর্কে আমরা কয়জনই বা চিন্তা করি। যিনি সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, তাঁর প্রতি আমরা সবচেয়ে বেশি জুলুম করে থাকি। অথচ এর প্রতি আমরা ভ্রূক্ষেপও করি না। এটা সাধারণ কোনো অপরাধ নয়; বরং মহা অপরাধ। এটা কেমন মহা অপরাধ তা বুঝতে পারা আমাদের চিন্তা-শক্তিরও বাইরে।

মহান আল্লাহতায়ালাকে রব হিসেবে গ্রহণ না করাই হলো তাঁর প্রতি সবচেয়ে বড় জুলুম। কেননা তিনিই যেহেতু সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা; অন্য কেউই এর উপযুক্ত হকদার নয়। সুতরাং আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যকে রব হিসেবে গ্রহণ করাই হলো আল্লাহর প্রতি জুলুম করা। সকল প্রকার ইবাদত পাওয়ার যোগ্য একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালা। যখন ইবাদত অন্যের জন্য করা হয় কিংবা অন্যকে খুশি করার উদ্দেশ্যে করা হয়, সেটা হবে আল্লাহর প্রতি মারাত্মক জুলুম (শিরক)। লোক দেখানো ইবাদতও এক প্রকার বড় জুলুম। লোক দেখানো ইবাদত মূলত আল্লাহর সাথে ঠাট্টা কারার শামিল। এমনও ঘটে যে, আমরা যখন কোনো বিপদের কবল থেকে মুক্তি পায় তখন চিন্তা না করেই বলে ফেলি, এটা না থাকলে বা এই ব্যক্তি না হলে আমি প্রায়ই মারা যেতাম বা আমার অনেক ক্ষতি হতো। জমিতে সার দেওয়ার ফলে ফসল ফলেছে ইত্যাদি এসবের মধ্য দিয়ে জুলুম হয়ে থাকে। এভাবে আমাদের বিভিন্ন কর্মের ক্ষেত্রে যা মাধ্যম হয়ে থাকে সেগুলোকে আল্লাহর স্থানে উত্তীর্ণ করাই হলো আল্লাহর প্রতি জুলুম করা। কারণ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কোনো না কোনো কিছুকে আল্লাহ মাধ্যম বানিয়ে আমাদের সাহায্য করে থাকেন। আবার কখনো কখনো কোনো মাধ্যম ছাড়াই আল্লাহ আমাদের যত্ন নেন। তাই আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলোর প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা একান্ত অপরিহার্য যেন মহান রবের প্রতি জুলুম না হয়ে পড়ে। পবিত্র  কোরআনে ইরশাদ হয়েছে-নিশ্চয় শিরক বড় জুলুম।’ (সুরা লুকমান, আয়াত-১৩) মনে রাখতে হবে, শিরকের গুনাহ আল্লাহতায়ালা কখনো ক্ষমা করবেন না যতক্ষণ না তাওবা করে পুনরায় ঈমান গ্রহণ করেন।

অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রতি জুলুমের বিষয়টি সাধারণত আমরা গুরুত্বের সাথে নিই না। পবিত্র কোরআনে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের হেফাজত করার নির্দেশ এসেছে এবং হাদিসে উল্লেখিত হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিজেদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিবে। সুতরাং এর থেকে বুঝা যায় অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রতি জুলুমের বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যময়। মূলত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রতি জুলুমের অর্থ হলো-অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঠিক ব্যবহার না করা। যেমন-হাত দিয়ে চুরি করা, খুন করা ও অন্যায়ভাবে কাউকে প্রহার করা ইত্যাদির মাধ্যমে হাতের প্রতি জুলুম করা হয়। চোখ দিয়ে অশ্লীল চিত্র, মুভি, পর্নগ্রাফি, বেগানা নারী দেখা ও পর্যাপ্ত ঘুম না দেওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে চোখের প্রতি জুলুম করা হয়। পায়ের প্রতি জুলুম হলো অন্যায় পথে তাকে ব্যবহার করা, লজ্জা স্থানের প্রতি জুলুম হলো তার হেফাজত না করা। জিহ্বার প্রতি জুলুম হলো তা দিয়ে মিথ্যা বলা, গিবত করা, পরনিন্দা করা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া ইত্যাদি। কানের প্রতি জুলুম হলো অশ্লীল গান ও আলোচনা শ্রবণ করা ইত্যাদি। মস্তিস্কের প্রতি জুলুম হলো খারাপ চিন্তা করা, খারাপ কিছুর পরিকল্পনা করা ইত্যাদি৷ পেটের প্রতি জুলুম হলো পর্যাপ্ত খাবারের তুলনায় অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ অথবা অস্বাস্থ্যকর পানীয় কিংবা অসুস্থ খাবার গ্রহণ এবং হারাম উপার্জনের খাদ্য গ্রহণ ইত্যাদি। দাঁতের প্রতি জুলুম হলো তা নিয়মিত পরিষ্কার না রাখা, ভক্ষণের ক্ষেত্রে সঠিকতা বজায় না রাখা ইত্যাদি শরীরের যাবতীয় প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রতি নিজেদের অবাঞ্ছিত কর্মের মাধ্যমে জুলুম হয়ে থাকে। মূলত এগুলোর মাধ্যমে নিজেদের প্রতি জুলুম করা হয়।

অন্যের প্রতিও আমরা প্রায়ই জুলুম করে বসি। এটা অপরাধের দিক থেকে অনেকটাই উচ্চ স্তরের। জীবন চলার পথে একে অপরের সাথে কত কিছুর আদান-প্রদান ও বাক্য বিনিময় হয়ে থাকে। ফলে কখনো কখনো একে অপরের প্রতিও জুলুম হয়ে যায়। অন্যের প্রতি জুলুম করা কিংবা হক নষ্ট করার অপরাধ ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ ক্ষমা করেন না যতক্ষণ না ঐ ব্যক্তিই ক্ষমা করে দেন। সুতরাং এর প্রতি সবার কঠোর নজর রাখা অতীব জরুরি। বিনা কারণে কাউকে মানসিক কিংবা শারীরিকভাবে আঘাত করা, কথার মাধ্যমে কষ্ট দেওয়া, আচরণে কষ্ট দেওয়া, কারো সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করা, ঠকানো, প্রতারণা করা ইত্যাদি হচ্ছে মারাত্মক জুলুম। এছাড়াও গিবত করার মাধ্যমে যার গিবত করা হয় তার প্রতি জুলুম করা হয়। চাকরি করা বিভিন্ন কর্মস্থলে যথা সময়ে উপস্থিত না হওয়া এবং কর্মের ক্ষেত্রে অবহেলা কিংবা কর্মে ফাঁকি দেওয়াই হলো কোম্পানি বা মালিকের প্রতি জুলুম করা। ক্লাসে এক মিনিট দেরিতে প্রবেশ করা এবং এক মিনিট আগে বের হওয়াও হলো ছাত্রদের প্রতি জুলুম করা; কেননা ক্লাসের নির্দিষ্ট সময়ের এক মিনিট পর্যন্তও হচ্ছে ছাত্রদের হক। ওজনে কম দিয়ে এবং সঠিক মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্য আদায়ের মাধ্যমেও ক্রেতার প্রতি জুলুম করা হয়। সোশাল মিডিয়াই কারো ফেসবুক একাউন্ট হ্যাক করা, অন্যায়ভাবে রিপোর্ট মারা ইত্যাদি হচ্ছে এক প্রকার জুলুম। কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা খবর ছড়ানো এবং সেগুলোর সাথে সহমত প্রকাশের মাধ্যমেও ওই ব্যক্তির প্রতি জুলুম করা হয় যার বিরুদ্ধে মিথ্যা খবর ছড়ানো হয়েছে। যোগ্য ব্যক্তির স্থলে অযোগ্য ব্যক্তিকে ঘুষের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়াই হলো যোগ্য ব্যক্তির প্রতি জুলুম করা। শয়তানের আশ্রয় নিয়ে কারো ওপর ব্ল্যাক ম্যাজিক করা ইত্যাদি সবকিছুই জুলুম হিসেবে বিবেচিত। অতএব, এই স্তরের জুলুম থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখা অত্যন্ত অপরিহার্য৷ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, জুলুম কিয়ামতের দিন ভীষণ অন্ধকার হয়ে দেখা দেবে।’ (আল জামি বাইনাস সাহিহাইন, হাদিস নং-১৩৮৭)

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের ওপর জুলুম করেছে সে যেন তার কাছ থেকে ক্ষমা নিয়ে নেয়, তার ভাইয়ের পক্ষে তার আমলনামা থেকে পুণ্য কেটে নেওয়ার আগেই  কারণ সেখানে কোনো দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) বা দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) পাওয়া যাবে না । তার কাছে যদি পুণ্য না থাকে তবে তার (মজলুম) ভাইয়ের গুনাহ তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৬৫৩৪)

সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবেশ করলে দেখা যায় বিশেষ করে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্ট্যাগ্রাম, ইউটিউব, ওয়েব ইত্যাদি সাইটে আপলোড করা ভিডিও, পোস্ট করা কোনো লেখা বা ছবির ওপর বিভিন্ন রিয়েক্ট ও কমেন্টের আচরণ লক্ষ করা যায়। সে ক্ষেত্রেও কিন্তু জুলুমের বিষয় নিহিত আছে। যেমন- রিয়েক্টের ক্ষেত্রে যেখানে ‘ক্রায়িং’ রিয়েক্ট দিতে হয় সেখানে ‘হা হা’ রিয়েক্ট দেওয়া, কমেন্টের যথার্থতা বজায় না রাখাই হলো আপলোডিং বা পোস্টিং করা বিষয়ের প্রতি জুলুম করা।

কিছু কিছু জুলুম রয়েছে যেগুলো কিয়ামতের আলামত হিসেবেও চিহ্নিত। যেমন-যে চেয়ারে (নেতৃত্ব/ক্ষমতা) যে ব্যক্তি বসার যোগ্য নয়, তাকে যদি সে চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হয় তাহলে হবে জুলুম। মসজিদ পরিচালানায় ধার্মিক, বিজ্ঞ আলেমের পরিবর্তে অযোগ্য, অশিক্ষিত ব্যক্তিদের কমিটিতে নিয়োগ দেওয়া হলো জুলুম। যে ব্যক্তি ইমামতি করার যোগ্যতা রাখে না, তাকে যদি ঈমামতি করতে দেওয়া হয় তাহলে সেটা হবে জুলুম। সুদখোর, ঘুষখোর ইত্যাদি ব্যক্তিদের যদি সমাজের মেম্বার বা চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়, তাহলে হবে জুলুম। এ প্রকারের কাজ সম্পাদিত হতে থাকলে বুঝতে হবে কিয়ামত সন্নিকটে এসে পড়েছে। কারণ কিয়ামতের পূর্বেই জুলুম, অত্যাচার, উৎপীড়ন ইত্যাদি বেড়ে যাবে।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘জালিমরা কখনো সফলকাম হয় না।’ (সুরা আনআম, আয়াত-৫৭) তিনি আরো ইরশাদ করেন, ‘অচিরেই জালিমরা জানতে পারবে, তাদের প্রত্যাবর্তনস্থল কোথায় হবে।’ (সুরা আশ-শুআরা, আয়াত-২২৭) কিছু জুলুম রয়েছে যা সবচেয়ে জঘন্য এবং কিছু জুলুম নিন্দনীয়। সুতরাং সব ধরনের জুলুম থেকে বেঁচে থাকা আমাদের করণীয়। যত প্রকার জুলুমের স্তর রয়েছে সবকিছু থেকে আল্লাহতায়ালা আমাদের হেফাজত করুন। আমিন।

লেখক : শিক্ষার্থী, সরকারি সিটি কলেজ চট্টগ্রাম

সদস্য, বাংলাদেশ কওমি তরুণ লেখক ফোরাম

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads