• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

প্রচলিত দাওয়াতে গিফট এবং ইসলামী ভাবনা

  • প্রকাশিত ১১ জুলাই ২০২১

হাসান মুরাদ

 

দাওয়াত আরবী শব্দ। ক্রিয়ামূল। অর্থ আহ্বান, নিমন্ত্রণ, ডাকা। প্রচলিত দাওয়াত বলতে  সম্মিলিত  উন্নত ভোজের বিশেষ অনুষ্ঠান। আমাদের দেশে দাওয়াতের আছে নানান উপলক্ষ ও  অনুষঙ্গ। বিবাহ, খৎনা, বিবাহবার্ষিকী, জন্মদিন, মুখেভাত, ঈসালে সাওয়াব ইত্যাদি। মানুষকে খাওয়ানো ইবাদত, নেকীর কাজ। তবে সেটা হতে হবে শরয়ী নীতিমালার আলোকে। এসব অনুষ্ঠান আনন্দ ভাগাভাগির একটি উৎস। এটি ভালোলাগার একটি দিক। তবে এর আড়ালে আছে কিছু অব্যক্ত নির্মম সত্য। বেদনাক্লিষ্ট  বাস্তবতা। সেটি হলো উপহার। অবশ্য গিফট নামেই সমাজে অধিক পরিচিত। দাওয়াত খাওয়ার আগে পরে নিমন্ত্রকের সমীপে পৌঁছে দিতে হয় এসব গিফট-উপহার। নিমন্ত্রকও সে উপহার গ্রহণের অধীর আগ্রহে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। হিসাব-নিকাশের জন্য একজন লেখকও নির্দিষ্ট করেন।

বর্তমানে রকমারি পেপার মোড়ানো উপহার থেকে নগদ টাকার প্রতি আবার আকর্ষণ একটু বেশিই। অনুষ্ঠান শেষে আসর বসে প্রত্যাশা-প্রাপ্তির। কে এলো?  কত দিল? অবাক হতে হয়! সর্বশেষ চলে লাভ-লোকসানের হিসাব। এমন দাওয়াত আর হোটেল বাণিজ্যের মধ্যে কী পার্থক্য? এ বাণিজ্যে শরিক হতে অনেক পরিবারকে দেখেছি সুদিনির্ভর হতে। সমিতির লোন তুলে দাওয়াত খেতে। কী নির্মম? কখনো  মাসে একাধিক দাওয়াত পড়ে, তখন সাধারণ পরিপারের কষ্টের শেষ থাকে না। আবার আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখতে দাওয়াতে উপস্থিতিও একান্ত হয়ে পড়ে। তাই মনোকষ্ট নিয়েই দাওয়াতে উপস্থিত হতে হয়। মনে রাখতে হবে এসব প্রথা-প্রচলন ইসলাম কখনই সমর্থন করে না।

 

উপহারের শরয়ী পদ্ধতি : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা একে অন্যকে হাদিয়া (উপহার-গিফট) দাও, ভালোবাসা সৃষ্টি হবে।’ (আল-আদাবুল মুফরাদ-৫৯৪) অন্যত্র নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমরা হাদিয়া দাও, এ হাদিয়া শত্রুতা ও বিদ্বেষ দূর করে।’ (তিরমিযি শরিফ, হাদিস নং-২১৩০) এ ছাড়াও বিভিন্ন হাদিসে হাদিয়া বা উপহারের অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। আরব বেদুইনরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য গ্রাম থেকে হাদিয়া নিয়ে আসতেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও তাদের হাদিয়া দিতেন। হাদিয়ার মাধ্যমে আত্মীয়ের সাথে আত্মার সম্পর্ক গাড় হয়। আর দূরের কারো সঙ্গে হয় নিগুড়, নিবিড়। তবে পারস্পরিক হাদিয়া দেওয়া-নেওয়াটা হতে হবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। একে অপরের সুখে, দুঃখে পাশে দাঁড়াব। আনন্দ বেদনা ভাগ করে নেব। এনিয়েই আমাদের সমাজ। কিন্তু আমরা উপহারের যে রীতি নিজেদের ওপর চাপিয়ে নিয়েছি, তা নিয়ে ভাববার অবকাশ আছে। প্রচলিত নিমন্ত্রণের সময় পত্রে যদি সাহস করে লিখে দিতে পারি- ‘দয়া করে সাথে কোনো উপহার আনবেন না’ তাহলে অন্যরাও সাহস করে সিদ্ধান্ত নিতে অভ্যস্ত হবে। এটাই হোক আমাদের আগামীর প্রত্যয়।

সাধারণত মানুষ কোথাও বেড়াতে গেলে কিছু উপহার সাথে নিয়ে যায়। এখানে কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না। হাদিয়াকে স্বাভাবিকভাবে ব্যাপকায়ণ করতে হবে। হাদিয়ার মানসিকতা তৈরি হলে একে অন্যকে হাদিয়া দিবে। এর মাধ্যমে প্রচলিত প্রথা রুদ্ধ হবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আর তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দিকে খাদ্য দান করে। তারা বলে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা তোমাদেরকে খাদ্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।’ (সুরা আদ-দাহার, আয়াত-৮, ৯) আয়াতে মুমিনদের গুণ স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, তারা অন্যকে আহার করায় কিন্তু কোনো প্রতিদান; এমনকি কোনো ধরনের কৃতজ্ঞতাও কামনা করে না। শুধু আল্লাহকে খুশি করা উদ্দেশ্য। আমাদেরও বিনা উপহারে খাওয়ানোর মানসিকতা রাখা উচিত।

ইসলামে অনুষ্ঠান : বিবাহ উপলক্ষে অনুষ্ঠান ইসলামে স্বীকৃত। বিবাহ অনুষ্ঠানকে হাদিসের ভাষাতে ওলিমা বলে। ওলিমা সুন্নাত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ওলিমাতে কেবল ধনীদেরকেই আমন্ত্রণ করা হয় আর গরিবদেরকে বর্জন করা হয়, সে ওলিমার খাবার নিকৃষ্ট। আর যে আমন্ত্রণ রক্ষা করে না সে তো আল্লাহ ও তার রাসুলের অবাধ্য হলো। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৫১৭৭) সুতরাং সামর্থ্য থাকলে ধনী-গরিব সবাকেই ওলিমাতে আহ্বান করা। মনে রাখতে হবে, ওলিমা ছেলেপক্ষের আয়োজনকে বলা হয়। অনেক সময় ছেলেপক্ষ থেকে মেয়ে পক্ষকে শর্ত বেঁধে দেওয়া হয়, আমার ১০০ জন লোক খাওয়াতে হবে, ইত্যাদি। এটাও অনুচিত।এমন শর্তকে যৌতুকের ভিন্নরূপ বললে অত্ত্যুক্তি হবে না হয়ত। হ্যাঁ! মেয়েপক্ষ স্বেচ্ছায় আয়োজন করলে সুযোগ আছে।

ওলিমা ভিন্ন অন্য উৎসব যেমন- খৎনা, বিবাহবাষির্কী, জন্মবার্ষিকী, মুখেভাত ইত্যাদি অনুষ্ঠানের কোনো প্রমাণ ইসলামে পাওয়া যায়না। তবে এসব অনুষ্ঠান কেউ ইবাদত মনে করে করে না। তাই বিদআতও বলা যায়না। কিন্তু ভিন্নধর্মের সাদৃশ্য অবশ্যই। তাই এসব থেকে বিরত থাকা উচিত। অনেকে স্মরণীয় দিন ভেবে কিছুটা আনন্দ উপলব্ধি করতে চাই। তাদের উচিত ব্যক্তিপরিবারের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ রাখা। এগুলোকে আয়োজনে রূপ না দেওয়া। আমাদের দেশে মৃত পরবর্তী দাওয়াতেরও বেশ প্রচলন আছে। বড় আয়োজন করে  মানুষ খাওয়ানো হয়। এসব অনুষ্ঠান না করলে নিন্দার পাত্রও হতে হয়। তবে এমন অনুষ্ঠানে উপহার নেওয়া-দেওয়ার প্রচলন খুব একটা দেখা যায়না। ইসলামে মৃত পরবর্তী খাওয়ানোরও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।

 

তবে কোনো উপলক্ষ ছাড়া গরিব, অসহায়, আত্মীয়দের খাওয়ানোতে কোনো অসুবিধা নেই। অন্যকে খাওয়ানো ইবাদত। হযরত ইব্রাহিম (আ.) মেহমান ছাড়া খেতেন না। আর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবাগণও উপস্থিত মেহমানদারি করতেন। আবার আয়োজন করেও অন্যদের খাওয়াতেন। হাদিস শরিফে এসেছে দুজনের খাবার তিনজনের জন্য যথেষ্ট। তিনজনের খাবার চাঁরজনের জন্য যথেষ্ট। এটা খাবারের বরকতের প্রমাণ। অর্থাৎ উপস্থিত মেহমান এলে কম খাবারও সকলের জন্য যথেষ্ট হবে। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘জাহান্নামিদের বলা হবে তোমরা কেন জাহান্নামে এসেছ? তারা বলবে, আমরা নামাজ পড়তাম না এবং অভাবগ্রস্তদের খাদ্য দিতাম না।’ (সুরা মুদ্দাসসির, আয়াত-৪৪) আয়াত থেকে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়, প্রয়োজনের সময় খাদ্য সরবারহ না করার কারণে অনেক মানুষ জাহান্নামি হবে।

সমাজে অনেক মানুষ আছে যারা কোনো অনুষ্ঠান না করে খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। সেটা প্রশংসার দাবি রাখে। মাঝেমধ্যে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রিয়জনদের খাওয়ানো, মেহমানদারি করাও সুন্নাহ। মেহমানদারি করা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে মেহমানদারি করে না, তার মাঝে কোনো কল্যাণ নেই।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং-১৭৪১৯) আরবরা কোনো সফরে গেলে বা সফর থেকে নিরাপদে ফিরে এলে সমাজের সম্ভ্রান্ত লোকদের মেহমানদারি করতেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, যে আল্লাহ ও কিয়ামতের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন মেহমানের সমাদার করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং- ৬১৩৬) মেহমান বাড়িতে বরকত নিয়ে আসে। মেজবানের গোনাহ মাফের মাধ্যম হয়। সুতরাং প্রচলিত বাণিজ্যিক দাওয়াত পরিহার করে আমরা মহেমানদারি প্রথা প্রচলন করতে পারি।

প্রসঙ্গক্রমে একটি ঘটনা দিয়ে লেখা শেষ করছি। সেদিন শান্তাহার রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পথের সন্ধানে কাউকে খুঁজছিলাম। হঠাৎ এক ভদ্রলোকের সাক্ষাৎ হলো। বেশে কথা হলো। আমাকে সাহায্য করলেন। আলাপচারিতার পর্যায়ে জানতে চাইলাম আপনি এখানে কি করছেন? বলতে রাজি হলো না। পরে বললেন, তিনি  মাঝেমধ্যে ছিন্নমূল মানুষদের খাদ্য সহায়তা করেন। স্টেশনে অনেক না খাওয়া মানুষ থাকে, তাদের খাওয়াতে এসেছিলেন। ভদ্রলোক একটি হিফজ মাদরাসার শিক্ষক। আল্লাহ তাকে উত্তম বিনিময় দান করুন। তিনি নওগাঁ এবং বগুড়ার দুটি হোটেলের কথাও বললেন, তারা সপ্তাহে একদিন প্রায় ৩০০ মানুষদের ফ্রি খাওয়ান। এছাড়াও প্রতিদিন কিছু না কিছু মানুষ খাওয়ান। তাদের থেকেই তিনি এমন মানসিকতা তৈরি করেছেন। আমারাও উদ্যোগী হয়ে এমন মানসিকতা লালন করতে পারি। প্রচলিত প্রথা পরিহার করে সুন্নাহের পথ গ্রহণ করি। আমিন!

 

লেখক : শিক্ষক, দারুস সুন্নাহ মাদরাসা, ভেড়ামারা কুষ্টিয়া

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads