• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
কোরবানির বিধান ও সমাজের দ্বৈরথ

ছবি: স্টার মেইল

ধর্ম

কোরবানির বিধান ও সমাজের দ্বৈরথ

  • প্রকাশিত ১৪ জুলাই ২০২১

কোরবানি! এটা ধনবান মুসলিম ব্যক্তির ওপর আবশ্যক বিধান। যা মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম হতে প্রচলন ঘটে। ইসলামের বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী, মহান আল্লাহতায়ালা ইসলামের রাসুল হজরত ইব্রাহিম (আ.)কে স্বপ্নযোগে নির্দেশ দেন, ‘তুমি তোমার প্রিয়বস্তু আল্লাহর নামে কোরবানি করো।’ ইব্রাহিম (আ.)  স্বপ্নে এ আদেশ পেয়ে ১০টি উট কোরবানি করলেন। পুনরায় তিনি একই স্বপ্ন দেখলেন। ইব্রাহিম  (আ.) আবার ১০০টি উট কোরবানি করেন। এরপরেও তিনি একই স্বপ্ন দেখে ভাবলেন, আমার কাছে তো এ মুহূর্তে প্রিয়পুত্র ইসমাইল (আ.) ছাড়া আর কোনো প্রিয়বস্তু নেই। তখন তিনি পুত্রকে কোরবানির উদ্দেশ্যে আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশে যাত্রা করেন। যখন ইব্রাহিম (আ.) আরাফাত পর্বতের ওপর তাঁর পুত্রকে কোরবানি দেওয়ার জন্য গলদেশে ছুরি চালানোর চেষ্টা করেন, তখন তিনি বিস্মিত হয়ে দেখেন যে তাঁর পুত্রের পরিবর্তে একটি প্রাণী কোরবানি হয়েছে এবং তাঁর পুত্রের কোনো ক্ষতি হয়নি। এই ঘটনাকে স্মরণ করে সারা বিশ্বের মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রতি বছর এই দিবসটি ঈদুল আজহা নামে উদযাপন করে। হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের সুন্নাত হিসেবে উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য হিজরি ক্যালেন্ডারের ১২ তম চন্দ্র মাসের জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোরবানি করার সময় হিসেবে নির্ধারিত। যে ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না, সে যেন আমার ঈদগাহে উপস্থিত না হয়।’

কোরবানির গোশতের হুকুম : ১. কোরবানির গোশত কোরবানিদাতা নিজে ভক্ষণ করবে এবং অন্যদেরকেও ভক্ষণ করাতে পারবেন। ২. ইচ্ছানুযায়ী আত্মীয়, প্রতিবেশী, ধনী, গরিব, মুসলিম, অমুসলিম সবার মাঝে বিলিয়ে দিতে পারবে। ৩. ইচ্ছা করলে সব গোশতই সদকা করে দিতে পারবে। তবে এক-তৃতীয়াংশ গরিবদের মাঝে সদকা করা মুস্তাহাব। ৪. পরিবারের সদস্য বেশি হলে নিজের পরিতৃপ্তির জন্য সব গোশতই ভক্ষণ করতে পারবে, তবে এটি কোরবানির জন্য  বেমানান। ৫. কোরবানির গোশত বিক্রি করা বা তাদ্বারা জবাইয়ের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের মজুরি দেওয়া বৈধ নয়। ৬. কোরবানির গোশত সংরক্ষণ করা বৈধ। ৭. কোরবানির গোশত বণ্টনে অংশীদারদের মাঝে সমতা রক্ষা করতে হবে।

কোরবানির চামড়ার হুকুম : ১. চামড়া (নিজে/অংশীদারদের সম্মতিতে) সদকা করে দিতে পারবে। ২. চামড়া দ্বারা ব্যবহার্য দ্রব্য তৈরি করে নিজে ব্যবহার করতে পারবে। ৩. চামড়ার বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ করলে তা গরিবদের মাঝে বণ্টন করে দিতে হবে। এই অর্থ নিজে খরচ করা হারাম। ৪. পারিশ্রমিক হিসেবে চামড়া বা চামড়ার মূল্যের টাকা প্রদান করা যাবে না।

কোরবানির পশুর বিধান : ১. উটের বয়স কমপক্ষে ৫ বছর হতে হবে। ২.গরু/মহিষের বয়স কমপক্ষে ২ বছর হতে হবে। ৩. ছাগল/ভেড়া/দুম্বার বয়স কমপক্ষে ১ বছর হতে হবে। তবে ৬ মাসের মোটাতাজা বাচ্চাকে যদি ১ বছরের বাচ্চার মতো দেখায়, তাহলে তা দ্বারা কোরবানি বৈধ হবে।

যেসব পশু দ্বারা কোরবানি বৈধ নয় : ১. পশুর এক/উভয় চোখ অন্ধ হওয়া। ২. লেংড়া পশু, যা কোরবানির স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারেনা। ৩. দাঁতহীন পশু। ৪. জন্মগতভাবে কানহীন পশু। ৫. স্তনের মাথা কাটা পশু। ৬. ময়লা, আবর্জনা ও পায়খানা খেতে অভ্যস্ত পশু। ৭. যে পশুর পা কাটা। ৮. লেজের অধিকাংশ কাটা থাকা। ৯. পশু প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া।

কবুল হওয়া ও এর ফজিলতলাভের সহজ উপায় : কোরবানি কবুল হওয়া এবং এর যথাযথ ফজিলতলাভের জন্য কিছু কিছু বিষয়ে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আর কিছু বিষয় পরিহার করতে হবে। যেসব বিষয়ে অতিমাত্রায় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে; তা হচ্ছে কোরবানি হবে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি রেজামন্দি হাসিলের উদ্দেশ্যে, হালাল ও বৈধ অর্থের মাধ্যমে। আর এগুলো সব ইবাদত কবুলেরও শর্ত। কোরবানি হতে হবে মনের ঐকান্তিক আগ্রহসহকারে শুধুমাত্র আল্লাহর আদেশ পালন, ইব্রাহিম নবীর সুন্নাতের অনুসরণ অনুকরণের বাস্তব নমুনা হিসাবে ইসলামী শরিয়ার একটি বিধান পালনের নিমিত্তে। এ দুটি বিষয়ের অনুপস্থিতিতে অথবা দুটির একটির অনুপস্থিতিতে কোরবানি আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। লোক দেখানো যে কোনো ইবাদত শিরক, যা আল্লাহ মাফ করবেন না বলে ঘোষণা করেছেন সুরা মায়িদার ৭১ নাম্বার আয়াতে।

১. নিয়তের বিশুদ্ধতা। এটা যে কোনো ভালো কাজ ইবাদত-বন্দেগি ও কোরবানি কবুলের প্রথম এবং পূর্বশর্ত। কিন্তু বর্তমান মুসলিমসমাজের বিশাল একটা অংশ সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে থাকে কেবল গোশত খাওয়ার জন্য বা সমাজে তার অবস্থান ধরে রাখার জন্য। আবার কিছু লোক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করেনা। যা মোটেও কাম্য নয়।

২. অর্থের বিশুদ্ধতা । অবৈধ অর্থের দান সদকা হজ মসজিদ মাদরাসা নির্মাণ, কোরবানি ইত্যাদি কোনোকিছুই কবুল হয় না। কিন্তু বর্তমানে সমাজে বহু আমলা ও মাতব্বর রয়েছে যাদের মাসিক বেতন ৪০/৬০ হাজার টাকা কিন্তু তারা লক্ষ লক্ষ টাকার পশু কোরবানি করছে। যা নিঃসন্দেহে ঘুষ বা এজাতীয় অবৈধ পন্থায় রোজগারকৃত টাকা।

৩. শরিক নির্বাচনে সতর্কতা । যেহেতু কোরবানি আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য তাই সবার ইখলাছ এক রকম হয় না। তাই শরিকদের কোনো একজনের নিয়তে অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকলে বাকি সবার কোরবানি বাতিল। কোরবানিতে শরিক নির্বাচনের ক্ষেত্রে সুদখোর, ঘুষখোর, প্রতারক, অবৈধ পণ্যের ব্যবসায়ীর সাথে কোরবানি করা উচিত নয়। 

৪. পশুক্রয়ে ট্যাক্স দিতে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করা ঠিক নয় । অনেকে নানা কলা কৌশলে ট্যাক্স ফাঁকি দিতে চায়, কেউ কেউ ফাঁকি দেয়। এটা অনুচিত, কারণ কোরবানি ইবাদত।

৫. শুধু পরিবারের প্রধানের নামে কোরবানি দেওয়া নয়। বরং যদি কোনো পরিবারে একাধিক সদস্য থাকে সবাই আয় রোজগার করে এবং সবার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হয়, সেক্ষেত্রে প্রত্যেকেই কোরবানি দেবে যদিও যৌথ পরিবার। ৬. কোরবানির গোশত শরিকদের মাঝে পাল্লা দিয়ে ওজন করে বণ্টন করতে হবে। ৭. জবেহকারী বা কসাইকে গোশত বানানোর মজুরিস্বরূপ গোশত, চামড়া, রশি ইত্যাদি দেওয়া যাবে না। ৮. পশুর অপ্রয়োজনীয় অংশ গর্ত করে মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে। নতুবা অপ্রয়োজনীয় অংশ হতে দুর্গন্ধ ছড়াবে, যা পরিবেশ দূষণ করে রোগ-ব্যাধি ছড়ায়। ৯. বড় পশু ক্রয়ের প্রতিযোগিতা করা উচিত নয়। বরং মনের পশুকে দূরীকরণের প্রতিযোগিতা করা উচিত। ১০. পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন এমনকি অমুসলিমদের মাঝেও কোরবানির গোশত বিতরণ করা যাবে।

সবিশেষ, কোরবানির পশুর রক্ত, মাংস, আকার আকৃতি ইত্যাদি আল্লাহতায়ালার কোনোই প্রয়োজন নেই; বরং এর সবকিছুই আমাদের জন্য। আমাদের কোনো না কোনো উপকারার্থে ব্যবহূত হচ্ছে। যখন কোনো চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, প্রবাসী অথবা অন্য কোনো পেশায় নিয়োজিত নারী পুরুষ কোরবানি করতে চায়, কিন্তু তার পশু নেই। সে বাজার হতে যখন পশু ক্রয় করে তখন পরোক্ষভাবে সমাজের অপরাপর পেশায় নিয়োজিত সকলের প্রতি তার অবদান শুরু হয়ে যায়। যা ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের অগণিত কল্যাণ বয়ে আনে। শুধু কোরবানিতেই হালাল পশু জবাই হয়না; বরং দৈনন্দিন জীবনে মানুষের জীবনধারণের এক অসীম প্রয়োজনীয় বস্তু হচ্ছে পশু, পাখি, জীব, জন্তু। যার কোনো না কোনো অংশ আমাদের উপকারে আসছে। উন্নত মানের জুতা, মানি ব্যাগ, বেল্ট তৈরিতে পশুর চামড়াই প্রধান উপাদান। মিষ্টিজাতীয় খাবার তৈরিতে দুধের বিকল্প নাই। আমাদের শরীরে পুষ্টি যোগাতে, বিয়ে-শাদী, শিশুদের আকীকা, সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে হালালপশুর গোশতের বিকল্প আর কিছুই নাই। তাহলে অতি সহজেই বুঝা গেল যে, শুধু কোরবানিতেই পশু জবাই নয়; বরং প্রতিনিয়তই মানুষের কল্যাণে পশু জবাই আল্লাহ বৈধ করেছেন।

অপচয় অপব্যয় ব্যতীত যদি বৈধ পথে মানবতার কল্যাণে পশু জবাই করা হয়, কোরবানি দেওয়া হয় তা হলে নিঃসন্দেহে তা ছাওয়াবের কাজ। পুণ্যের কাজ। মানবতা মনুষ্যত্বের কাজ। সমাজসেবামূলক কাজ।  যদি কোরবানি মানুষের ক্ষতির কারণ হতো তাহলে আল্লাহ এ বিধান দিতেন না। বর্তমান সমাজের যারা কোরবানিতে পশু নিধনের দোহাই দিয়ে জাতীয় আয়ের জন্য মায়া কান্না করে, তারা নিজেরাই জাতীয় দায়! দেশের বোঝা! দেশ জাতি এবং মুসলিম উম্মাহর শত্রু। তারা মূলত মহান আল্লাহর বিধানকে উপেক্ষা করতে চায়! তারা মুসলমান উম্মাহর ফোঁড়া! তাদেরকে সামাজিক ভাবে বয়কট করা প্রয়োজন। সরকারের উচিত যারা এ জাতীয় বিভ্রান্তিমূলক কথা বলে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়, তাদেরকে প্রচলিত আইনের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তির সম্মুখীন করা।

মুহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত ত্বোহা

লেখক : প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার এক্টিভিস্ট

শিক্ষার্থী (আল-ফিকহ ও আইন অধ্যয়ন বিভাগ), ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads