• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

কোরবানির সময় নয়, একটি জীবন্ত সত্য

  • প্রকাশিত ১৮ জুলাই ২০২১

মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ

 

 

পৃথিবীতে সবাই নিজ নিজ উদ্দেশ্যের পেছনে ছুটে চলে এবং এ পথে প্রয়োজনানুযায়ী অর্থ-সম্পদ, সময় ও শ্রম ব্যয় করে। এভাবে উদ্দেশ্য লাভের জন্য নিজের অর্থ-সম্পদ, সময় ও শ্রম ব্যয় করাকেও ব্যাপক অর্থে কোরবানি বলা হয়। পৃথিবীতে কোনো কোরবানিই অনর্থক ও উদ্দেশ্যহীন নয়। যখন মানুষ দেখতে পায় যে, কোন কাজের ভেতর তার উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে, তখনই সে এর জন্য সাধ্যানুযায়ী ত্যাগ স্বীকার করে। যেমন, কেউ যদি নিজ সন্তানদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে চায়, তাহলে এর জন্য তাকে সময়, শ্রম ইত্যাদি ব্যয় করতে হয়, কোরবানি দিতে হয় অর্থকড়ি। তবেই তার উদ্দেশ্য সফল হয়। আর উদ্দেশ্য অর্জনের ক্ষেত্রে যে যত বেশি ত্যাগ স্বীকার করবে, সে তত দ্রুত লক্ষ্যপানে পৌঁছতে পারবে। নতুন ফসল লাভের জন্য যেমন পুরাতন ফসলের কোরবানি দিতে হয়, তেমনি মহান রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য লাভ করার জন্য বান্দাকে তার ইবাদতের ফরজ আদায় করতে হবে। আর এ ফরজ করার পথে তাকে নিজের অর্থ-সম্পদেরও কোরবানি দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজের প্রাণও কোরবানি দেয়ার প্রয়োজন পড়ে।

 

মুসলিম উম্মাহর কোরবানি একদিক থেকে ইসলামের মূল কথারই অভিব্যক্তি এবং অন্যদিক থেকে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর ঐতিহাসিক কোরবানি ঘটনার স্মৃতিচারণ। এ কথা দুটি পরস্পর ভিন্ন মনে হলেও অভিন্ন। কারণ, প্রথম বক্তব্য দ্বারা বোঝা যায়, ইসলামের মূল কথা হলো নিজের প্রিয়তম বস্তুকে আল্লাহর রাস্তায় কোরবান করা। আর একেই পশু কোরবানির আকৃতিতে অবয়ব দান করা হয়েছে। দ্বিতীয় কথার মর্ম হলো, আজ থেকে সাড়ে চার হাজার বছর পূর্বে হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর রাস্তায় যে কোরবানি করেছেন, আমাদের কোরবানি তারই স্মৃতিচারণ মাত্র। প্রথম কথা দ্বারা ইসলামের মূল সুর প্রকাশ পায় এবং দ্বিতীয় কথা দ্বারা মুসলিম মিল্লাতের পিতার শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য ফুটে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে কথাদুটি সম্পূর্ণ এক ও অভিন্ন এবং একটির সঙ্গে অপরটি গভীরভাবে জড়িত। কোরবানির দর্শনের সঙ্গে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সম্পর্কও গভীরতর। ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক আমলকে একজন মহান ব্যক্তির জীবনের আঙ্গিকে একটি দৃষ্টান্ত। এর সাহায্যে আত্মত্যাগ ও কোরবানির মহৎ চেতনাকে অবয়ব দেয়া হয়েছে।

 

মুমিনের ত্যাগ ও কোরবানি কেবল জীবনের কয়েকটি মুহূর্তের জন্য সীমাবদ্ধ নয়। বরং এর ধারাবাহিকতা মৃত্যু পর্যন্ত চলতে থাকে। অর্থাৎ মুমিন আল্লাহর পথেই বেঁচে থাকবে এবং এ পথেই মৃত্যুবরণ করবে। পবিত্র কোরআনে মহান রাব্বুল আলামিনের ভাষ্য বলুন! আমার নামাজ, আমার সমগ্র ইবাদত, আমার জীবন, আমার মরণ সবই বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর জন্য নিবেদিত। (সুরা আনআম : ১৬২)। এ আয়াতের মর্ম হলো, মুমিন পূর্ণ সচেতনতার সঙ্গে ঈমানি জিন্দেগি ইখতিয়ার করবে এবং এ পথে সাধনা করতে করতে মৃত্যু বরণ করবে। মুমিন যে আমল ও ইবাদতসমূহের মাধ্যমে তার ঈমানের বাস্তব সাক্ষ্য প্রদান করে থাকে। তন্মধ্যে জীবনের কোরবানি হলো, সর্বশ্রেষ্ঠ আমল। যার সাহায্যে একজন মানুষ তার ঈমান ও বিশ্বাসের নিখুঁত সাক্ষ্য প্রদান করে।

 

হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর জীবন এ মহান ত্যাগ ও কোরবানির একটি প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি যখন হককে গ্রহণ করলেন, তখন তার পূর্ব-পুরুষদের ঐতিহ্যগত ধর্মকে পরিত্যাগ করতে হলো এবং প্রবহমান স্রোতের সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে চলতে হলো। তিনি এর জন্য নিজেত মাতা-পিতা, ঘর-বাড়ি, জায়গা-সম্পত্তি ও আত্মীয়-স্বজন সবই ত্যাগ করলেন। আপন দেশ থেকে বের হয়ে সারা জীবন ধরে বিচ্ছিন্ন ও যাযাবর জীবন কাটালেন। নিজের পুরো জিন্দেগিকেই দুনিয়া অর্জনের পরিবর্তে পরকালের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করলেন। এভাবে এক কঠিন জীবন অতিবাহিত করে ক্রমে তিনি বৃদ্ধ বয়সে গিয়ে উপনীত হন। তখনও তার কোনো সন্তান ছিলো না। যখন তিনি ছিয়াশি বছর বয়সে পৌঁছেন, তখন তার স্ত্রী হাজেরার গর্ভে এক ছেলে সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তার আচার-ব্যবহারও এতই শালীন ও মার্জিত ছিলো যে, অল্প সময়েই তার পিতাকে তার ভীষণ অনুরক্ত করে তোলেন। মাতা-পিতার আশা ভরসার একমাত্র স্থল এই শিশুপুত্র যখন বড় হলো এবং পিতার সঙ্গে চলাফেরা করার উপযুক্ত হলো, তখন আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় পুত্রকে তাঁর রাহে কোরবানি করার নির্দেশ দিলেন। কত বড় কঠিন পরীক্ষা! একটি পুরো বিচ্ছিন্ন ও কঠিন জীবন অতিবাহিত করার পর প্রিয় পুত্রকে পেয়ে নিজ হাতে কোরবান করে দেয়া। কিন্তু তার দৃঢ়তার ভেতর সামান্যতম ছেদও সৃষ্টি হয়নি। তিনি কাল ক্ষেপণ না করেই এ নির্দেশ পালনের জন্যে সর্বান্তকরণে প্রস্তুত হয়ে গেলেন। তদুপরি তিনি এ নির্দেশের কারণে এই মর্মে আল্লাহর শুকর আদায় করলেন যে, মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর কাছ থেকে তাঁর প্রিয়তম জিনিসটিই তলব করলেন।

 

হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর এ ঘটনা কোরবানির ইতিহাসে একটি প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। এটি নিরেট একজন পুত্রের কোরবানি নয়; বরং মানুষের পক্ষ থেকে  তার প্রিয়তম বস্তুর কোরবানি। আল্লাহর রাস্তায় প্রিয়তম বস্তুর কোরবানির দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্য এ ধরণের একটি ছেলের নির্বাচন যথেষ্ট ছিলো। তদুপরি এ কোরবানির শেষ অবস্থাও এ ছিলো যে, বৃদ্ধ পিতা নিজেই নিজ হাতে একমাত্র ছেলের গলদেশে ছুরি চালালেন। কতই বড় ত্যাগ ও কোরবানি! হজরত ইবরাহিম (আ.)- এর কোরবানি একই সঙ্গে দুটো জিনিসের কোরবানির উজ্জ্বল উদাহরণ। একটি হলো, প্রাণের কোরবানি এবং অন্যত্র হলো, প্রিয়তম বস্তুর কোরবানি। তিনি দুটোই আল্লাহর রাহে কোরবানি করেন।

 

পবিত্র কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, আল্লাহর কাছে না পৌঁছে তাদের গোশত, আর না তাদের রক্ত, বরং তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়াই পৌঁছে। (সুরা হাজ্জ, ৩৭)। হাদিসে পাকে এরশাদ হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা দেখেন না তোমাদের মালদৌলত, দেখেন না তোমাদের বেশভূষা, দেখেন শুধুই তোমাদের অন্তর আর আমলে পরিশুদ্ধতা। (সহীহ মুসলিম : ২৫৬৪)। কোরবানি একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পালন করতে হবে, লোক দেখানো বা গোশত খাওয়ার নিয়তে কোরবানি করলে তা শুদ্ধ হবে না। শরিকি কোরবানিতে কোনো অংশীদার আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য নিয়ত করলে শরিকদের কারো কোরবানিই শুদ্ধ হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে শরিক নির্বাচন করা জরুরি। কেউ আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য কোরবানি না করে শুধু গোশত খাওয়ার নিয়ত করলে তার কোরবানি সহিহ হবে না। তাকে অংশীদার বানালে শরিকদের কারও কোরবানি হবে না। তাই সতর্কতার সঙ্গে শরিক নির্বাচন করুন। শরিকে কোরবানি করলে কারো অংশ এক-সপ্তমাংশের কম হতে পারবে না, এমন হলে কোনো শরিকেরই কোরবানি সহিহ হবে না। শরিকে কোরবানি করলে গোশত ওজন করে বণ্টন করতে হবে। অনুমান করে ভাগ করা জায়েজ নয়। তবে হাড্ডি-মাথা ইত্যাদি যেসব অংশ সাধারণত সমানভাবে ভাগ করা যায় না, সেগুলো অনুমান করে ভাগ করা যাবে। এতে সামান্য কম-বেশি হলেও সমস্যা নেই।

 

বর্তমানে আমাদের সমাজে কোরবানির এ মহান শিক্ষা অনেকাংশে তিরোহিত। এটা যেনো একটা প্রথাগত ব্যাপার দাঁড়িয়েছে। কে কত বড় পশু কোরবানি দিতে পারে। সেটি কত মূল্যের হবে ইত্যাদি গুঞ্জন সমাজের ঘরে-ঘরে, হাটে-বাজারে, অফিস-আদালতে সর্বত্রই শোনা যায়। কিন্তু এ কোরবানির মূল উদ্দেশ্য কী এ কথা আমরা বেমালুম ভুলে যাই। শুধু বড় বড় পশু জবাই করলেই কোরবানির হক আদায় হলো এমনটি ভাবার কোনো অবকাশ নেই। কোরবানির মূল উদ্দেশ্য বড় বড় পশু জবাই করা নয়। এর আসল উদ্দেশ্য হলো প্রবৃত্তি, শয়তান ও বাতিল শক্তি সকল চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় আল্লাহ ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তথা দীনে হকের জন্য সবধরনের ত্যাগ ও কোরবানির শিক্ষালাভ করা। ত্যাগ ও কোরবানির এই অনুষ্ঠানকে সার্থক ও তাৎপর্যময় করে তুলতে হলে সকল মুসলমানকে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর ত্যাগ ও কোরবানির পবিত্র অনুভূতিতে বলীয়ান হতে হবে। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর আত্মত্যাগ ও কোরবানির মহান দৃষ্টান্ত অনুসরণ ও তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে পথ চলার তাওফিক দিন। আমিন!

 

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

ahmadabdullah7860@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads