• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
কালিমা তায়্যিবার গুরুত্ব ও দাবি

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

কালিমা তায়্যিবার গুরুত্ব ও দাবি

  • প্রকাশিত ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১

কালিমা তায়্যিবা হলো ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’। অর্থ : আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ বা মাবুদ নেই, হজরত  মোহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসুল। এই পবিত্র বাক্যটিকে ইসলামের প্রবেশদ্বার বলা হয়। এটি পাঠ করা ছাড়া কেউ মুমিন দাবি করতে পারবে না। এমনকি এটি স্বীকার করা ছাড়া যত আমলই করুক না কেন সেটা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। বাক্যটি পাঠ করার মাধ্যমে মানুষের চিন্তা-চেতনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। কোনো ব্যক্তি সারাজীবন শিরক ও কুফরিতে লিপ্ত থেকে জীবনের শেষ সময়ে এসে যদি বাক্যটি মনেপ্রাণে পাঠ করে তা হলে সেও আল্লাহর কাছে মুক্তি ও সফলতা লাভের যোগ্য হয়ে যায়।

কালিমা তায়্যিবাহ ঈমানের ভিত্তি : মূলত কালিমা তায়্যিবা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ ও মর্যাদাবান বাক্য। ঈমান হলো তিনটি বিষয়ের সমষ্টি। ক. মৌখিক স্বীকৃতি। খ. অন্তরে বিশ্বাস। গ. তদনুসারে আমল করা। উক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে মৌখিক স্বীকৃতির বিষয়টি কালিমা তায়্যিবাতে পাওয়া যায়। এটি কয়েকটি অক্ষরের সমন্বয়ে হলেও মিজানের পাল্লায় অত্যন্ত ভারী হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ সাক্ষ্য দেন যে, তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই, আর ফেরেশতা ও জ্ঞানীগণও (সাক্ষ্য দেন) ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই, তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-১৮)

তাকওয়ার বাণী : আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অতঃপর আল্লাহ তাঁর রাসুল ও মুমিনদের ওপর স্বীয় প্রশান্তি নাজিল করলেন এবং তাকওয়া বা খোদভীরুতার বাণী তাদের ওপর অপরিহার্য করেছেন এবং তারা এরই অধিকতর যোগ্য ও উপযুক্ত ছিল এবং আল্লাহ সবকিছু জানেন।’ (সুরা ফাতাহ, আয়াত-২৬) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় অধিকাংশ মুফাসসিরগণ বলেন, এখানে খোদাভীরুতার বাণী বলে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু  মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহকেই বুঝানো হয়েছে। (বায়হাকী, পৃ-১৩১, কিতাবুল আসমা ওয়াসসিফাত)

কালিমা তায়্যিবাহ গুপ্তধন আকারে সংরক্ষিত : আল্লাহতায়ালা হজরত মুসা (আ.)কে হজরত খিজির (আ.) এর সাথে সাক্ষাত করতে বলেছিলেন। উভয়ের মাঝে অনেক কথাবার্তা হয়েছিল। পবিত্র  কোরআনে সুরা কাহাফে দীর্ঘ ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বাকি রইল ওই প্রাচীর, তা ছিল নগরের দুজন এতিম বালকের এবং সেটার নিচে তাদের গুপ্ত ধন-ভাণ্ডার ছিল এবং তাদের পিতা ছিলেন সৎকর্মপরায়ণ।’ (সুরা কাহাফ-৮২) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘সেটি ছিল স্বর্ণের একটি ফলক। সেখানে সাতটি বিষয় লেখা ছিল। তম্মধ্যে সাত নম্বর বাক্যটি ছিল, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ। সুতরাং হজরত মুসা (আ.) এর সাথে হজরত খিজির (আ.)-এর ঘটনাটি হয়েছিল প্রিয়নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগমনের প্রায় কয়েক হাজার বছর পূর্বে আর তখনো এই কালিমাটিকে আল্লাহতায়ালা গুপ্তধন আকারে রেখেছিলেন।’ (তাবরানী-১৬২৯, ইমাম সুয়ুতী-তাফসিরে দুররে মনসূর : ৯/৬০০)

কবরে কালেমা তায়্যিবা এর ওপর দৃঢ়তা : কবর আখেরাতের প্রথম সোপান। প্রত্যেক মানুষকে কবরস্থ করার পর পুনরায় তার রূহ ফেরত দেওয়া হয়। সেখানে মুনকার নাকির নামক দুজন ফেরেশতা প্রশ্ন করবেন। যিনি ফেরশতাদ্বয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন তিনি সফল হবেন। অন্যথায় কবরই তার জন্য শাস্তির স্থান হিসেবে নির্ধারিত হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা ঈমানদারদেরকে মজবুত বাক্য দ্বারা মজবুত রাখেন পার্থিব জীবনে এবং পরকালে। আল্লাহ জালিমদেরকে পথভ্রষ্ট করেন। আল্লাহ যা ইচ্ছা তা করেন।’ (সুরা ইবরাহীম, আয়াত-২৭) হাদিসেপাকে রয়েছে, কবরে মুমিনকে প্রশ্ন করার জন্য ভয়ঙ্কর মুহূর্তে সে আল্লাহর সমর্থনের শক্তি নিয়ে এই কালেমার ওপর অটল থাকবে এবং লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ সাক্ষ্য দেবে। উল্লেখিত আল্লাহর বাণীটির  উদ্দেশ্যও তাই।’ (তাফসিরে তাবারী, তাফসিরে সাফওয়াতুত তাফাসির-২/৯৭, তাফসিরে মাআরেফুল  কোরআন, সংক্ষিপ্ত তাফসির, পৃ-৭১৮)

কালিমা তায়্যিবাহ নিরাপত্তার প্রতীক : কোনো অবিশ্বাসী যতই পবিত্রতা অর্জন করুকনা কেন ঈমান না আনার কারণে তারা অপবিত্র। যেই মাত্র এই পবিত্র বাক্য একনিষ্ঠতার সাথে পাঠ করলো সাথে সাথে সে পবিত্র হয়ে যায়। সহিহ মুসলিম শরিফে একটি অধ্যায় রয়েছে, ‘লোকদের বিরুদ্ধে জিহাদের নির্দেশ যতক্ষণ না তারা স্বীকার করে যে, লাইলাহা ইল্লাল্লাহু  মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসুল এবং নামাজ কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে বিধান এনেছেন তার প্রতি ঈমান আনে। যে ব্যক্তি এসব করবে, সে তার জানমালের নিরাপত্তা লাভ করবে, তবে শরিয়াতসম্মত কারণ ব্যতীত। আর অন্তরের খবর আল্লাহর কাছে। যে ব্যক্তি জাকাত দিতে ও ইসলামের অন্যান্য বিধান পালন করতে অস্বীকার করে, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার এবং ইসলামের বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইমামের গুরুত্বরোপ করার নির্দেশ।’ (সহিহ মুসলিম, অধ্যায় নং-৮) রাসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছে,  আমাকে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে যে, ‘আমি মানুষের সাথে যুদ্ধ করতে যতক্ষণ না তারা বলে, (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদার রাসুলাল্লাহ) আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য মাবুদ নেই এবং মোহাম্মদ আল্লাহ রাসুল। যখন এটা তারা বাস্তবায়ন করবে, আমার থেকে তাদের রক্ত ও সম্পদ নিরাপদ করে নিবে, তবে কালিমার হক ব্যতীত এবং তাদের হিসাব আল্লাহর ওপর।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-২৫)

প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুখনিসৃত বাণী  হাদিসে রয়েছে, হজরত আবু জার (রা.) বলেন, আমার চাচাত ভাই হজরত নুআইম আলগিফারী (রা.) ও আমি একসাথে বের হলাম রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সন্ধানে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি পাহাড়ের গুহায় আত্মগোপনে ছিলেন। তখন আবু জার (রা.) তাকে বলেন, হে মোহাম্মদ! আমরা আপনার কাছে এসেছি আপনি কী বলেন তা শুনার জন্য। তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন আমিতো এটাই বলি, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। সাথে সাথে আবু জার (রা.) ও তার সাথীরা ঈমান আনলেন।’ (আল ইসাবা ফি তামিজিস সাহাবা : ৬/৩৬৫ নং-৮৮০৯)

বেহেশতের দরজায় কালিমা লেখা : হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, (মেরাজকালে) আমি বেহেশতে প্রবেশ করার সময় এর দু-পাশে স্বর্ণাক্ষরে তিনটি লাইন লেখা দেখেছি। এক. লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। দুই. আমরা যে ভালো কাজগুলো পাঠিয়েছিলাম তা পেয়েছি। যা খেয়েছি তা থেকে উপকৃত হয়েছি। যা ছেড়ে এসেছি তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। তিন. উম্মত হলো গুনাহগার, আর রব হলো ক্ষমাশীল।’ (ইমাম সুয়ুতী, জামেউস সগীর, নং-৪১৮৬)   

কালিমা তায়্যিবা-এর গুরুত্ব : আল্লাহর সর্বোত্তম সৃষ্টি মানুষের কর্মের পুরস্কার অথবা শাস্তির মানদণ্ড হচ্ছে এই কালিমা। এটির প্রচারের জন্য আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। এক কথায় মুসলিম জাতিসত্তার ভিত্তি হলো এই কালিমাটি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি আপনার পূর্বে যে রাসুলই পাঠিয়েছি তার প্রতি ওহী দিয়েছি যে, আমি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। কাজেই তোমরা আমারই বন্দেগি করো।’ (সুরা আম্বিয়া-২৫) হজরত সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (রহ.) বলেন, মানুষের ওপর আল্লাহতায়ালার বড় নিয়ামত হলো তিনি তাদেরকে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর সাথে পরিচয় করে দিয়েছেন। পৃথিবীতে পিপাসাকাতর ব্যক্তির জন্য ঠান্ডা পানি যেমন প্রয়োজন তেমনি জান্নাতবাসীর জন্য এই কালিমা প্রয়োজন। যে ব্যক্তি এই কালিমাকে স্বীকৃতি দান করল সে তার সম্পদ এবং জীবনের নিরাপত্তা গ্রহণ করল। আর যে তা অস্বীকার করল সে তার জীবন ও সম্পদ নিরাপদ করল না। (ইবনে রজব, কালিমাতুল ইখলাছ : ৫২-৫৩) কালিমা তায়্যিবার ফলে ঈমানের সম্পদ অর্জিত হয়। তার অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত হয় এবং আল্লাহর প্রেরিত রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভলোবাসা ও অনুগত্য প্রদর্শনের মনোভাব তৈরি হয়। সারাজীবন মুমিন বান্দা পবিত্র বাক্যের আলোকে জীবন পরিচালনা করে তাহলে এর ফসল কবরে ও হাশরেও লাভ করবে।

কালিমা তায়্যিবাহর দাবি : কালিমা তায়্যিবাতে বিশ্বাসীদের কিছু অত্যাবশ্যকীয় দাবি পূরণ করতে হয়। ১। একমাত্র আল্লাহর সামনেই আত্মসমর্পণ করা এবং অন্য কারো সামনে মাথা নত না করা। আল্লাহতায়ালা বলেন,  ‘আর তোমরা তোমাদের রবের দিকে প্রত্যাবর্তন কর এবং তার কাছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করো।’ (সুরা জুমার, আয়াত-৫৪) অন্যত্র তিনি বলেছেন, অতএব তোমাদের ইলাহ তো একমাত্র ইলাহ সুতরাং তারই আজ্ঞাধীন থাক এবং বিনয়ীগণকে সুসংবাদ দাও।’ (সুরা হজ, আয়াত-৩৪) ২। শুধুমাত্র তারই ইবাদত করা। তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত না করা। আল্লাহ বলেন, ‘এবং প্রত্যেক জাতির কাছে আমি রাসুল পাঠিয়েছি এই নির্দেশ দিয়ে যে, একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগুতকে বর্জন করো।’ (সুরা আন-নাহল, আয়াত-৩৬)

৩। আল্লাহকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা ঈমান এনেছেন আল্লাহ তাদের অভিভাবক। তাদেরকে তিনি বের করে আনেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে। আর যারা কুফরি করে তাদের অভিভাবক হচ্ছে তাগুত। তারা তাদেরকে আলো থেকে বের করে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। এরাই হলো দোজখের অধিবাসী, তারা সেখানে চিরকাল থাকবে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত- ২৫৭) ৪। বিজয় অর্জনের জন্য পরীক্ষা দেওয়ার মানসিকতা তৈরি করা। কেননা বিশ্বাসীদেরকে আল্লাহতায়ালা বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে থাকেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, মানুষ কি মনে করে যে, তারা একথা অব্যাহতি পেয়ে যাবে, যে আমরা ঈমান এনেছি এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না?’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত-২)

লেখক : মাওলানা মুহাম্মদ মুনিরুল হাছান

সহকারী শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা)

চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads