• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

শাফায়াতের আদ্যোপান্ত

  • প্রকাশিত ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১

মো. নাজমুস সাকিব

 

শাফায়াত শব্দটি মূলত আরবি ‘শাফয়ুন’ শব্দ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। এর অর্থ হলো এক বস্তুর সাথে অনুরূপ বস্তুর মিলন সাধিত করা। সাথি হওয়া, কারণ প্রতিবেশী ‘শুফআর’ দাবির মাধ্যমে বিক্রয়কৃত জমিকে তার মালিকানার সাথে মিলিয়া নেয়। অনুরূপভাবে দুই রাকাত নামাজকেও ‘শাফআ’ বলা হয়। কেননা এক রাকাতের সাথে অপর রাকাত মেলানো হয়। আর অনুরূপভাবে সুপারিশ করার অর্থ হলো অপরাধী ব্যক্তি তার সুপারিশের জন্য আল্লাহর কোনো মকবুল বান্দার সাথে তাকে মিলিয়ে নেয়। তাই সুপারিশ ও সাহায্য করাকে শাফায়াত বলা হয়।

শাফায়াতের শাব্দিক অর্থ জোড়া ও যুগল; দোয়া, সুপারিশ, মধ্যস্থতা ইত্যাদি। সুপারিশকারীকে শাফি এবং এর বহুবচন শুফায়া বলা হয়। শাফায়াত সাধারণত দিনি বিষয়, বিশেষ করে কেয়ামত প্রসঙ্গে হয়ে থাকে। এভাবেই কোরআন ও হাদিসে এর ব্যবহার পরিদৃষ্ট হয়। শাফায়াতের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে-সুপারিশ, মাধ্যম ও দোয়া বা প্রার্থনা। পারিভাষিক অর্থ হলো : অপরের জন্য কল্যাণ প্রার্থনা করা। (আল ইরশাদ ইলা সহিহিল ই’তিক্বাদ, ২৬৭)। আল্লামা ইবনুল আসির (রহ.) শাফায়াতের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন-‘পরস্পরেরর মাঝে অপরাধ ও গুনাহ্ ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন করা।’ (শরহে সহিহ মুসলিম)। আল্লামা মুকাতিল (রহ.) শাফায়াতের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন-অর্থাৎ ‘শাফায়াত হলো শেষ বিচারের দিন পাপী লোকদের শাস্তি হতে মুক্তি দেওয়ার জন্য নবী-রাসুলগণ এবং সালেহিন তথা আউলিয়ায়ে কেরাম কর্তৃক আল্লাহতায়ালার নিকট সুপারিশ করা।’

(ক.) ঐ সকল বান্দা যাদের পাপ ও পুণ্য সমান সমান হবে। তাদেরকে বেহেশতে প্রবেশ করানোর জন্য প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহুতায়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুপারিশ করবেন। বেহেশতের দরজা উন্মুক্ত করার জন্য নবী করিম সাল্লাল্লাহুতায়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুপারিশ করবেন। যারা আজাবের উপযোগী হবে তাদের আজাব হালকা করার জন্য সুপারিশ। যেমন-প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহুতায়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর চাচা আবু তালেবের আজাব হালকা করার জন্য সুপারিশ করবেন। বিশেষভাবে মদিনাবাসীদের জন্য নবীজি সাল্লাল্লাহুতায়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুপারিশ করবেন। পৃথকভাবে নবী করিম সাল্লাল্লাহুতায়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর রওজা শরিফ জিয়ারতকারীদের জন্য সুপারিশ করবেন। কেয়ামতের ভয়াবহ ও সংকটময়কালে সাধারণ মানুষ যখন আতঙ্কগ্রস্ত ও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে, তখন কেবল নুরে মুজাসসাম হাবিবুল্লাহ হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলবেন, ‘হে আল্লাহ পাক, আঁপনি আঁমার উম্মতকে মাফ করুন।’ তিঁনিই সর্বপ্রথম শাফায়াত করার অনুমতিপ্রাপ্ত হবেন। এটাই শাফায়াতে কুবরা বা মহাসুপারিশ। মহান আল্লাহ পাক বলেন, ‘কে সে, যে তার অনুমতি ব্যতীত তাঁর কাছে সুপারিশ করবে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত নং ২৫৫)।

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহুতায়ালা আনহু হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উঁনাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কিয়ামতের দিন কোন ব্যক্তি আঁপনার শাফায়াতের বেশি হকদার হবে? হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে আবু হুরায়রা! আপনার হাদিস শেখার আগ্রহ দেখে আঁমার ধারণা ছিল যে, আপনার পূর্বে এ বিষয় সম্পর্কে কেউ জিজ্ঞাসা করবে না। যে ব্যক্তি অন্তর থেকে ইখলাসের সাথে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করবে, কিয়ামতের দিন সে ব্যক্তি আঁমার শাফায়াতের সবচেয়ে বেশি হকদার হবে।’ (বুখারি) ব্যাখ্যা : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বপ্রথম শাফায়াতে কুবরার অনুমতি পাবেন। আর এরপরে আল্লাহর অনুমতিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মতিতে অন্যরা সুপারিশ করার ক্ষমতা পাবেন।

(খ.) আম্বিয়া, আউলিয়া, শুহাদা, বুজুর্গ, পীর-দরবেশ, সাধারণ মোমিনদের শাফায়াত। উনারাও আল্লাহ পাক উঁনার কাছ থেকে শাফায়াত করার অনুমতিপ্রাপ্ত হবেন। এটাকে শাফায়াতে সুগরা বা শাফায়াতে আম্মা বলা হয়। কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন : ‘সেদিন শাফায়াত কার্যকর হবে না, অবশ্য স্বয়ং রহমান কাউকে উহার অনুমতি দিলে এবং তার কথা শুনতে পছন্দ করলে অন্য কথা/দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দেবেন ও যার কথায় তিঁনি সন্তুষ্ট হবেন সে ছাড়া কারো সুপারিশ সেদিন কোনো কাজে আসবে না।’ (সুরা ত্বাহা, আয়াত নং-১০৯)। ‘সুপারিশ বা শাফায়াতকারী কেউ নেই, তবে যদি আল্লাহর অনুমতির পর শাফায়াত করে (তাহলে অন্য কথা)।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত নং-৩)। ‘তিঁনি যার ওপর সন্তুষ্ট তিঁনি ছাড়া আর কেউ তাঁর নিকট সুপারিশ করতে সক্ষম নয়।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত নং-২৮)। ‘যেদিন ‘রুহ’ ও ফেরেশতারা কাতারবন্দি হয়ে দাঁড়াবে, কেহই কোনো কথা বলবে না-সে ব্যতীত, যাকে পরম দয়াময় অনুমতি দেবেন এবং যে যথাযথ কথা বলবে।’ (সুরা নাবা, আয়াত নং-৩৮)। ‘দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দেবেন এবং যার কথায় সন্তুষ্ট হবেন সে ছাড়া কারো সুপারিশ সেদিন কোনো উপকারে আসবে না।’ (সুরা ত্বো-হা, আয়াত নং-১০৯)।

এক বর্ণনা অনুযায়ী শরিয়তসম্মত শাফায়াত ৮ প্রকার। তথা কোরআন-হাদিস স্বীকৃত শাফায়াত হচ্ছে সর্বমোট আট প্রকার। ইসলামী আকিদার কিতাবপত্রে মোট আট প্রকার শাফায়াতের উল্লেখ রয়েছে। একে শাফায়াতে মুছতাবাও বলা হয়। আবার শাফায়াতে মাকবুলাও বলা হয়-(ক.) ‘আশ্ শাফায়াতুল উজমা’ বা সর্ববৃহৎ শাফায়াত যা মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য খাস। আর্থাৎ আল্লাহতায়ালা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শাফায়াতে কুবরা’ ও মাকামে মাহমুদের মর্যাদা দান করবেন। হাশরের মাঠে দীর্ঘকাল অবস্থানে ক্লান্ত লোকেরা বিচারের আবেদন জানালে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সৃষ্টিকুলের বিচারকাজ শুরু করার প্রার্থনা জানাবেন রাব্বুল আলামিনের দরবারে। (খ.) সৃষ্টির বিচার ও তাদের হিসাবনিকাশ শেষ হলে জান্নাতিদের জান্নাতে প্রবেশের অনুমতিদানের জন্য রাসুলের শাফায়াত। (গ.) চাচা আবু তালিবের শাস্তি হালকা করার জন্য রাসুলের শাফায়াত। এই তিন প্রকারের শাফায়াত আমাদের নবীজির একক বৈশিষ্ট্য। এতে আর কেউ শরিক নন। (ঘ.) একাত্মবাদে বিশ্বাসী গুনাহগার মুমিন বান্দা, যারা জাহান্নামের উপযুক্ত কিন্তু তাদেরকে জাহান্নামে না পাঠানোর জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফায়াত। (ঙ.) যেসব গুণাহগার মুমিন একাত্মবাদে বিশ্বাসী হয়েও জাহান্নামে প্রবেশ করবে তাদেরকে জাহান্নাম হতে বের করার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাফায়াত করবেন। (চ.) বেহেশতবাসীদের মধ্যে কোন কোন বেহেশতির দরজা ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফায়াত (ছ.) যাদের নেকি-বদি, পাপ-পুণ্য সমান হবে তাদেরকে বেহেশতে প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফায়াত। তারা ‘আহলে আ’রাফ বলে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। (জ.) কোনো কোনো উম্মতকে বিনা হিসাব ও আজাবে বেহেশতে প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার জন্য রাসুলের শাফায়াত। যেমন-তিনি উক্কাশা বিন মিহসান (রা.)-এর জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করেছিলেন যে, তাকে যেন সেই সত্তর হাজার লোকের অন্তর্ভুক্ত করা হয় যাদেরকে বিনা হিসাব ও বিনা আজাবে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। (শরহুল আকিদাতিল ওয়াসিতিয়্যা, পৃ. ১৫৭-১৫৮, শরহুল আকিদাতিত তাহাভিয়া পৃ. ২২৭-২২৮)।

শাফায়াত শব্দটি পবিত্র কোরআনের ১৯ সুরায় ২৫টি আয়াতে রয়েছে। পঁচিশটি আয়াত দুটি ভাগে বিভক্ত। যথাক্রমে-জালিম ও কাফিরদের কোনো সুপারিশকারী নেই। পক্ষান্তরে ঈমানদারদের সুপারিশকারী থাকবে। শাফায়াতের বিষয়টি নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিয়ে তা আল্লাহর অনুমতিসাপেক্ষে হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ‘কে আছে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর কাছে সুপারিশ করতে পারে।’ (সুরা শুরা, আয়াত নং-২৫)। ‘যেদিন ‘রুহ’ ও ফেরেশতারা কাতারবন্দি হয়ে দাঁড়াবে, কেহই কোনো কথা বলবে না-সে ব্যতীত, যাকে পরম দয়াময় অনুমতি দেবেন এবং যে যথাযথ কথা বলবে।’ (সুরা নাবা, আয়াত নং-৩৮)। ‘সুপারিশ বা শাফায়াতকারী কেউ নেই, তবে যদি আল্লাহর অনুমতির পর শাফায়াত করে (তাহলে অন্য কথা)।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত নং ৩)। ‘তাঁর অনুমতি ব্যতীত কোনো শাফায়াতকারী নেই।’ (সুরা জুমার, আয়াত নং-৪৪০। তখন কারো সুপারিশ করার অধিকার থাকবে না, করুণাময় আল্লাহর কাছ থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ ছাড়া। (সুরা মারিয়াম, আয়াত নং-৮৭)।

ওসমান ইবনে আফফান (রা.) হতে বর্ণিত-তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন তিন শ্রেণীর লোক শাফায়াত করবেন-নবীগণ, অতঃপর ওলামাগণ (ওলি-আউলিয়া), অতঃপর শহীদগণ।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)। হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহুতায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত-হজরত মোহাম্মাদ মোস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন : কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণির লোক সুপারিশ করবে। (ক.) নবী-রাসুল আলাইহিমুস সালাম। (খ.) উলামায়ে কিরাম (বা আউলিয়া কেরাম) রহমাতুল্লাহি আলাইহি। (গ.) শহীদগণ।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ শরিফ, মিশকাত শরিফ ৫৩৭০)।

শাফায়াত শব্দটি পবিত্র কোরআনের ১৯ সুরায় ২৫টি আয়াতে রয়েছে। পঁচিশটি আয়াত দুটি ভাগে বিভক্ত : যথাক্রমে-জালিম ও কাফিরদের কোনো সুপারিশকারী নেই, পক্ষান্তরে ঈমানদারদের সুপারিশকারী থাকবে। শাফায়াতের প্রভাব ও ফলাফল সম্পর্কে দুটি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে-১. শাফায়াত গুনাহকে মুছে দেয় ও শাস্তিকে লাঘব করে। ২. শাফায়াতের মাধ্যমে পুণ্য বৃদ্ধি পায় ও মর্যাদার উত্তরণ ঘটে।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads