• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব

প্রতীকী ছবি

ধর্ম

পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব

  • প্রকাশিত ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১

আল্লাহর হক তথা ইবাদত-বন্দেগির পরেই পিতা-মাতার হক আদায়ের গুরুত্ব মহান আল্লাহ তাঁর পবিত্র  কোরআনুল কারিমের মাঝে উল্লেখ করেছেন।  আল্লাহর সন্তুষ্টি পিতা-মাতার সন্তুষ্টির ওপর নির্ভরশীল।  আল্লাহকে খুশি করার জন্য পিতা-মাতাকে আমাদের ব্যবহার  ও কার্যাবলি দ্বারা খুশি করতে হবে। তাদের প্রতি আনুগত্য থাকা আল্লাহর নির্দেশ। রাসুলে আরাবী  মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফরমান; মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। আমরা যদি ইসলাম ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মের দিকে দৃষ্টিপাত করি। তাহলে দেখা যাবে বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ  ত্রিপিটকে আছে,  পিতা-মাতার সেবা করাই সবচেয়ে উত্তম।  হিন্দুশাস্ত্রে মায়ের স্থান উল্লেখ করে বলেছে-জননী এবং জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।

মা-বাবা সাথে ভালো আচরণ করার জন্য আল্লাহরাব্বুল আলামিন সুরা নিসার ৩৬ নাম্বার আয়াতে ঘোষণা করেন। তোমরা ইবাদত করো আল্লাহর, তাঁর সাথে কোনো কিছুর শরিক করো না। আর সদ্ব্যবহার করো মা-বাবার সাথে। আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, তাওহিদের পর সমস্ত আপনজন-আত্মীয় ও সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পিতা-মাতার অধিকার সর্বাগ্রে। আল্লাহতায়ালা স্বীয় ইবাদাত-বন্দেগি ও হকসমূহের পর পরই পিতা-মাতার হক সম্পর্কিত বিবরণ দানের মাধ্যমে ইঙ্গিত করেছেন যে, প্রকৃতপক্ষে সমস্ত নেয়ামত ও অনুগ্রহ একান্তই আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে, কিন্তু বাহ্যিক উপকরণের দিক দিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আল্লাহর পরে মানুষের প্রতি সর্বাধিক ইহসান বা অনুগ্রহ থাকে পিতা-মাতার। সাধারণ উপকরণসমূহের মাঝে মানুষের অস্তিত্বের পিছনে পিতা-মাতাই বাহ্যিক কারণ। তাছাড়া জন্ম থেকে যৌবন প্রাপ্তি পর্যন্ত যে সমস্ত কঠিন ও বন্ধুর পথ ও স্তর রয়েছে, পিতা-মাতাই তাকে সেগুলোতে সাহায্য করেন এবং তার প্রতিপালন ও পরিবর্ধনের জামানতদার হয়ে থাকেন। সে জন্যই আল্লাহতায়ালা অন্যান্য জায়গায়ও পিতামাতার হকসমূহকে তার ইবাদাত ও আনুগত্যের সাথে যুক্ত করে বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছেন। ‘আমার এবং তোমার পিতা-মাতার শুকরিয়া আদায় করো।’ (সুরা লুকমান, আয়াত-১৪)

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীসমূহে যেমন পিতা-মাতার আনুগত্য এবং তাদের সাথে সদ্ব্যবহারের তাকিদ রয়েছে, তেমনিভাবে তার সীমাহীন ফজিলত, মর্তব্য ও সওয়াবের কথাও উল্লেখ রয়েছে। এক হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টির মধ্যে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টির মধ্যেই নিহিত রয়েছে।’ (তিরমিযি, হাদিস নং-১৮৯৯)

প্রত্যেক মা-বাবাই নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে পরম স্নেহে সন্তানকে বড় করে তোলেন। সন্তানকে লালন-পালন করা, তার লেখাপড়া ভরণপোষণ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে পিতা-মাতা সারাজীবন উদ্বিগ্ন থাকেন। পিতা-মাতা নিজে না খেয়ে, ভালো পোশাক না পরে, নিজের সন্তানদেরকে খাওয়ান, ভালো পোশাকটি সন্তানদের হাতে তুলে দেন। কঠোর পরিশ্রম আর সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে মা-বাবা যা আয়-রোজগার করেন, তা নিঃস্বার্থভাবে সন্তানদের জন্যই ব্যয় করেন। বটবৃক্ষের মতো মা-বাবা ছায়া দিয়ে সন্তানদের বড় করে তোলেন। সন্তানের প্রতি মা-বাবার এই যে মায়া-মমতা, তা স্বর্গীয়। সন্তানদের সর্বপ্রথম দায়িত্ব হচ্ছে পিতা-মাতাকে শ্রদ্ধা করা। তাঁদের প্রতি সবসময় বিনম্র আচরণ করা। পিতা-মাতা যেমনই হোক না কেন,  সন্তানের কাছে তার সবসময় শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি।  তাই তাঁদের অবাধ্য হওয়া কোনো ক্রমেই উচিৎ নয়। যে সন্তান পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও অনুগত,  তারা জীবনে সাফল্য লাভ করে।

আমরা যদি বিভিন্ন মনীষীর জীবনের ঘটনা পড়ি, তাহলে দেখতে পাব যে, তারা কীভাবে পিতা-মাতা সাথে বিনম্র আচরণ ও তাঁদের কথা মেনে চলতেন। যেমন; হজরত বড়পীর আব্দুল কাদির জিলানি (রা.)  ডাকাত কর্তৃক আক্রান্ত হয়েও মাতৃ-আজ্ঞা পালন করেছেন মিথ্যা কথা না বলে। এতে ডাকাত সর্দার অভিভূত হয়ে সৎপথ অবলম্ব করেছিল। হজরত বায়েজিদ বোস্তামির (রা.) অসুস্থ মাতার শিয়রে সারা রাত পানির গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে থাকার ঘটনা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মায়ের ডাকে দুর্যোগর্পূর্ণ রাতে সাঁতার দিয়ে দামোদর নদী পার হওয়ার কাহিনী কে না জানে। এরা সকলেই জীবনে সফল হয়েছেন এবং মহান ব্যক্তি হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন।

আমাদের সমাজের  অনেক পিতা-মাতা আছেন,  তাঁরা অশিক্ষিত হয়েও নিজের সন্তানকে উচ্চশিক্ষা দান করেন। আর সেই সন্তান পড়ালেখা করে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে  বিভিন্ন উচ্চপদে আসীন হয়ে নিজের পিতা-মাতা প্রতি কোনো দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন না। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা-মমতা দূরে থাক,  ন্যূনতম দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেন না। এটা সবচেয়ে পরিতাপের বিষয়। কোরআনুল কারিমের সেই আয়াতটি মনে হয়ে গেল। আল্লাহরাব্বুল আলামিন পিতা-মাতাকে কষ্ট না দেওয়ার প্রসঙ্গে সুরা বনি ইসরাইলের ২৩ নাম্বার আয়াতে বললেন; ‘তোমার প্রতিপালক হুকুম জারি করেছেন যে, তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করো না, আর পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো। তাদের একজন বা তাদের উভয়ে যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে বিরক্তি বা অবজ্ঞাসূচক কথা বলো না, আর তাদেরকে ভৎর্সনা করো না। তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বল।’

হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সে ব্যক্তির নাক ধূলিমলিন হোক, তারপর ধূলিমলিন হোক, তারপর ধূলিমলিন হোক’, সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! সে কে? রাসুল বললেন, যে পিতা-মাতার একজন বা উভয়কে তাদের বৃদ্ধাবস্থায় পেল তারপর জান্নাতে যেতে পারল না।’ (মুসলিম, হাদিস নং-২৫৫১) বৃদ্ধ অবস্থায় পিতা-মাতা সন্তানদের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় তাঁদের অসুস্থ ও স্বাস্থ্যর প্রতি অধিক নজর দিতে হবে। তাঁদের সেবা প্রতি যত্নশীল হওয়া সন্তানদের একান্ত কর্তব্য। আল্লাহরাব্বুল আলামিন প্রত্যেক সন্তানদের মাতা-পিতার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

মোহাম্মদ এনামুল হক ফজলে রাব্বী

লেখক : শিক্ষার্থী, আল হাদিস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদরাসা, চট্টগ্রাম

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads