• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
‘আখেরি চাহার সোম্বা’ ভিত্তিহীন দিবস

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

‘আখেরি চাহার সোম্বা’ ভিত্তিহীন দিবস

  • প্রকাশিত ০৬ অক্টোবর ২০২১

ইমামুল ইসলাম মোড়ল

মানুষ তার নিজ মতবাদে বিশ্বাসী। যে ব্যক্তিটি জীবনের সর্বস্ব দিয়ে আল্লাহতায়ালার নৈকট্য হাসিলের চেষ্টা করে যাচ্ছে; তার দাবি সে সঠিক পথে আছে। অপরদিকে যে ব্যক্তিটি নিজের খেয়ালখুশি মতো দিনাতিপাত করছে, শয়তানের তাঁবেদারি করছে; তারও দাবি সেও সঠিক পথে আছে। হাস্যকর না? এই শেষোক্ত অধম শ্রেণির কাছে আপনি বিষয়টি ধরিয়ে দিতে চাইলে, তারা আপনার সামনে যুক্তির ঝুড়ি পেশ করবে। নিজের মতো কিভাবে সাব্যস্ত করা যায়, তার যত সব চেষ্টা করতে থাকবে। কোনো সময় তো, সঠিক বুঝতে পেরেও মানহানির ভয়ে অপরপক্ষের দেয়াল ঠেলতে থাকবে। এ কেমন যেন, ‘বিচার যাইহোক তালগাছটা আমার’।

আমার লেখা পড়তে পড়তে হয়তোবা আপনি একগাল হেসে ভাবছেন-আর যাই হোক, আমি কিন্তু এই দলের না। কিন্তু ভেবেছেন কি? আমার আপনার মনের মাঝে এমন কিছু বিশ্বাস আছে, যা আপনি কখনো ভুল প্রমাণে মানতে নারাজ।

শরিয়তের ব্যাপারেও কিন্তু এর ব্যতিক্রম নয়। একটু খুলে বলি, আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো দলের মতের ওপর বিশ্বাসী। কেউ হানাফি, কেউ তাবলীগি, কেউ আহলে হাদিস, কেউ পীরপূজারী। এসব দলের উচ্চশ্রেণির ব্যক্তি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত কেউ কি হলফ করে বলতে পারবে, তাদের মতে এমন কোনো বিশ্বাস নাই, যা ভ্রষ্ট। যেখানে সালফে সালেহীন, প্রসিদ্ধ ইমামগণ পর্যন্ত নিজেদেরও ভুল হতে পারে বলে জাতিকে সাবধান করে গেছেন। তাদের ইমান, তাদের আল্লাহভীরুতা, তাদের আমল; আর আমাদের ইমান, আল্লাহভীরুতা, আমল এক নিক্তিতে মেপে দেখুন তো? কেমন তারতম্য হয়। সেখানে তারা ভুল স্বীকার করলেও আমরা ভুলের ঊর্ধ্বে বলে দাবি করছি।

প্রত্যেক মুসলমানের ইমানি দাবি যে, যখন নিজের ভুল বুঝতে পারবে, তখন সে ভুলের অন্ধকার গুহা থেকে বের হয়ে আসবে। তাই আজকে এমন একটি বিষয় নিয়ে আলোকপাত করতে যাচ্ছি, যেটার বিশ্বাসে আমাদের সবারই গলদ রয়েছে।

এখন সফর মাস। এই মাসব্যাপী তেমন কোনো ভ্রান্ত বিশ্বাস না থাকলেও মাসের শেষের দিকে একটা দিন রয়েছে। যার নাম ‘আখেরি চাহার সোম্বা’। সফর মাসের শেষ বুধবার এই দিবসটি অনেকেই পালন করেন। এ বছর সফর মাসের শেষ বুধবার হলো আজ। আজকে অনেকেই অজ্ঞতাবশত বা দুনিয়াবি স্বার্থে এ দিবস পালন করার আয়োজন করেছে। কিন্ত, এ দিবস ইসলামে আছে কিনা বা ইসলাম সমর্থিত কিনা; তা জানা অতীব জরুরি।

‘আখেরি চাহার সোম্বা’ এটা আরবী নয়, ফারসি। শরিয়ত বিশুদ্ধ ইবাদত, আমল ও অনুষ্ঠানের নাম আরবীতে না হয়ে ফারসিতে হবে এটা কল্পনা করা যায় না। যার নামেই এতো গলদ তার ভিতর ফাঁকা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেশ তো দূরের কথা, যাদের মাতৃভাষা ফারসি তারা দিবসটি পালন না করলেও বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এই দিনে বিভিন্ন আমল করে থাকে। এমনকি এই দিবস এবং দিবসসংক্রান্ত আমল ও ফজিলত সম্পর্কে বাজারে কিছু বই-পুস্তকও পাওয়া যায়। যা শরিয়তের মানদণ্ড থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। আর পাঠকগুলো তা যাচাই-বাছাই না করেই আমলের প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। অনির্ভরযোগ্য ও ভিত্তিহীন ওইসব কিতাব অনুযায়ী এই দিবসের প্রেক্ষাপট হলো : ‘এক ইহুদি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জাদু করে। ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এজন্য তিনি মসজিদে যেতে পারেন নাই। সফর মাসের শেষ বুধবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গোসল করেন এবং তিনি সুস্থ হয়ে মসজিদে সালাত আদায় করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই গোসলই জীবনের শেষ গোসল। তাই সাহাবায়ে কেরাম শুকরিয়াস্বরূপ সিয়াম পালন করেন এবং নফল সালাত আদায় করেন। আর সেজন্যই আমরা তার উম্মত হিসেবে আমাদেরকেও এই দিনে বিভিন্ন আমল করা আবশ্যক।’

শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে এই দিবস পালনের প্রেক্ষাপট ও আমল কোনোভাবেই নির্ভরযোগ্য দলিলের ভিত্তিতে প্রমাণিত নয়। এই দিবসের অনির্ভরযোগ্য কারণগুলো হলো। প্রথমত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এক ইহুদি জাদু করেছিল। এটা ঠিক। কিন্তু গোসলের মাধ্যমে সুস্থতার তারিখ হিজরি সফর মাসের শেষ বুধবার, এটা ঠিক নয়। বরং দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। ইমাম ইবনে কাসির (রহ.) ও হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) তাদের স্ব স্ব কিতাবে এমনটাই  উল্লেখ করেছেন। (ফাতহুল বারী, কিতাবুল মাগাজী, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)

দ্বিতীয়ত, বলা হয় এরপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর গোসল করেননি। এটাও ঠিক নয়। কারণ সহিহ হাদিসে স্পষ্ট আছে, এই ঘটনার পর এক রাতে এশার সালাতের পূর্বে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গোসল করেছিলেন। (সহিহ বুখারি, মুসলিম) তৃতীয়ত, সাহাবায়ে কিরাম এই দিনে রোজা রেখেছিলেন ও নফল সালাত আদায় করেছিলেন। এ বক্তব্য মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও মনগড়া; যা কোনো সহিহ হাদিসে পাওয়া যায় না। চতুর্থত, কোনো দিবসকে শরিয়তসম্মত করতে হলে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট দলিল প্রমাণ আবশ্যক। অথচ এ বিষয়ে কোরআন-হাদিস তো দূরের কথা সাহাবি, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈনসহ সালফে সালেহীন পর্যন্ত এই দিবসকে ঘিরে কোনো আমল করেছেন বলে প্রমাণ মেলে না।

পঞ্চমত, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাফেরদের কাছে দাওয়াত পৌঁছাতে গিয়ে শত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেন। আবার আল্লাহতায়ালা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি দিয়েছেন। তাকে অসংখ্য নিয়ামতও দান করেছেন। এসব উম্মতের জন্য অবশ্য সুসংবাদের। তারপরও এসব খুশির দিনকে ইবাদত হিসেবে গণ্য করে সাহাবায়ে কেরাম কোনো আমল করেছেন বলে হাদিস পাওয়া যায় না। তাই ‘আখেরি চাহার সোম্বা’সহ আরো অন্যান্য দিবস যা ইসলামে প্রমাণিত নয়, তা ইসলামের নামে বা ফজিলত মনে করে পালন করা বেদাত ও ভিত্তিহীন।

শুধু এখানেই শেষ নয়, বাংলার মাটিতে অনেক আমল রয়েছে, যা ইসলামী শরিয়ার মানদণ্ডে নয়। তবুও মানুষ এসব মনগড়া আমল করে সমাজে মুত্তাকির শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। এমনকি এসব দিনে স্কুল-কলেজ-মাদরাসা সরকারি ছুটি ঘোষণা করে একদিনের জন্য হলেও ছাত্রদেরকে  ইলমের বরকত থেকে দূরে রাখা হচ্ছে। ধিক্কার যখন দিচ্ছিই, তাহলে এখান থেকে নামধারী কিছু আলেম বাদ যাবে কেন? তারাই তো মূলহোতা। যারা নিজেদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওয়ারিশ, ইসলামের নায়ক বলে দাবি করেন। অথচ তারাই সাধারণ মানুষের সহজ-সরল মগজ বের করে নিজেদের তৈরি মগজ ঢুকিয়ে দিয়ে ব্যবসার পুঁজি তৈরি করেছে। এরা নায়ক নামের খলনায়ক।

আজ আমাদের ঘুনে ধরা সমাজে শত মনগড়া আমল ও শত কুসংস্কার। আজ শুধু সফর মাসের কথাই বলি, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, পুরা সফর মাসে যত বালা-মুসিবত নাজিল করা হয়; সেই পরিমাণ বালা-মুসিবত নাজিল করা হয় সফর মাসের শেষ বুধবারে। এগুলো হাদিস নয়। নিজেদের স্বার্থে তৈরিকৃত হাদিস। যদিও তৎকালীন আরবে সফর মাস নিয়ে কুসংস্কার অনেক আগে থেকেই ছিল। সেসব বিশ্বাসকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাতিল বলে ঘোষণা দেন। সব মিলিয়ে এ কথায় চূড়ান্ত যে, শুভ-অশুভ কুসংস্কার বলে কিছুই নেই। ইসলামের প্রতিটি বিধান মানবজাতির জন্য কল্যাণের। তাই মানুষের যা কিছু কল্যাণকর ইসলাম তা বৈধ এবং মানুষের জন্য যা কিছু অশুভ  অকল্যাণকর ইসলাম তা অবৈধ ঘোষণা করেছে। সালাত আদায় করা, সাওম পালন করা, জাকাত দেওয়া এগুলো নিঃসন্দেহে শুভ ও কল্যাণকর কাজ। অপরদিকে মদ খাওয়া, জিনা করা, সুদ খাওয়া, ঘুষ খাওয়া অশুভ ও অকল্যাণকর কাজ। প্রত্যেক মানুষের শুভ-অশুভ বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা থাকা ইমানি দায়িত্ব।

আপনিতো আশরাফুল মাখলুকাত, বিবেকসম্পন্ন, বুদ্ধিমান প্রাণী। আপনি অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে নিশ্চিত কুয়ার  ভেতর পতিত হবেন। এই কাণ্ড দেখে যদি কেউ আপনাকে সামনে ভীতিকর অবস্থা অভিহিত করে মোড় ঘুরিয়ে দেন, তাহলে আপনার কি উচিত হবে না? সঠিক পথ নির্ণয় করে, ভুল থেকে বের হয়ে আসা। সেই সাথে সাহায্যকারীর জন্য কল্যাণের দোয়া করা। আল্লাহতায়ালা সবাইকে সুমতি দান করুন এবং সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads