• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

ইসলামে আবু বকর (রা.) এর অবদান

  • প্রকাশিত ০৭ অক্টোবর ২০২১

মো. আরাফাত রহমান

 

ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) ৫৭৩ সালে মক্কার কুরাইশ বংশের বনু তাইম গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম আবু কুহাফা ও মায়ের নাম সালমা বিনতে সাখার। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণের সম্মান তাকে দেওয়া হয়। এছাড়া তিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শ্বশুর ছিলেন। রাসুলের মৃত্যুর পর তিনি খলিফা হন এবং মুসলিমদের নেতৃত্ব দেন। রাসুলের মিরাজের ঘটনা এক ব্যক্তির নিকট শুনে তিনি সাথে সাথে বিশ্বাস করেছিলেন।  মোহাম্মদের প্রতি অতুলনীয় বিশ্বাসের জন্য তাকে ‘সিদ্দিক’ বা বিশ্বস্ত উপাধি প্রদান করা হয়।

অন্যান্য আরব শিশুদের মতো আবু বকর তার বাল্যকাল অতিবাহিত করেন। দশ বছর বয়সে তিনি তার বাবার সাথে একটি বাণিজ্য কাফেলায় করে সিরিয়া যান। পরে তিনি বাণিজ্যকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। বাণিজ্যের উদ্দেশে তিনি সিরিয়া, ইয়েমেন প্রভৃতি স্থানে সফর করেন। এসব সফরের ফলে তিনি ধনী ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হয়ে উঠেন। তার পিতা বেঁচে থাকলেও আবু বকর গোত্রের প্রধান হিসেবে সম্মান পেতে থাকেন। আবু বকর শিক্ষিত ছিলেন এবং কাব্যের প্রতি তার আগ্রহ ছিল। তার স্মৃতিশক্তি ভালো ছিল এবং আরব গোত্রসমূহের বংশলতিকা নিয়ে পাণ্ডিত্য ছিল।

তরুণ বয়সে আবু বকর (রা.) একজন বণিক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন। ইয়েমেন থেকে বাণিজ্য শেষে ফেরার পর তিনি মোহাম্মাদের ইসলাম প্রচারের সংবাদ পান। এরপর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তার ইসলাম গ্রহণ অন্য অনেকের ইসলাম গ্রহণের উৎসাহ যুগিয়েছে। আবু বকরের পূর্ণ নাম আবদুল্লাহ ইবনে উসমান ইবনে আমির ইবনে আমর ইবনে কাব ইবনে সাদ ইবনে তায়িম ইবনে মুররাহ ইবনে কাব ইবনে লুয়াই ইবনে গালিব ইবনে ফিহর আল কুরাইশি। কোরআনে আবু বকরকে ‘গুহার দ্বিতীয় ব্যক্তি’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে। হিজরতের সময়  মোহাম্মদের সাথে সাওর পর্বতের গুহায় আশ্রয় নেওয়ার কারণে এভাবে সম্বোধন করা হয়েছে।

আবু বকর প্রথম যুগের ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে তিনি প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, অন্যান্য সবার ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তাদের মনে কিছু মাত্রায় দ্বিধা ছিল কিন্তু আবু বকর বিনা দ্বিধায় ইসলাম গ্রহণ করেন। আবু বকরের ইসলাম গ্রহণ অনেককে ইসলাম গ্রহণে অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের ইসলাম গ্রহণে উৎসাহ যোগান। তার দ্বারা উৎসাহিত হয়ে অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। আবু বকরের ইসলাম গ্রহণ সুদূরপ্রসারী ফলাফল এনেছিল। মক্কায় এসময় দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। দাসদের মধ্যে অনেকে ইসলাম গ্রহণ করে। স্বাধীন ব্যক্তিরা ইসলাম গ্রহণের পর বিরোধিতার সম্মুখীন হতে থাকে তবে তারা তাদের নিজ গোত্রের নিরাপত্তা ভোগ করত। কিন্তু দাসদের কোনো নিরাপত্তা ছিল না এবং তারা নির্যাতনের সম্মুখীন হয়। আবু বকর দাসদের প্রতি সদয় হয়ে অনেককে কিনে নিয়ে মুক্ত করে দেন। আবু বকরের মুক্ত করা দাসরা অধিকাংশ নারী, বৃদ্ধ বা দুর্বল ব্যক্তি ছিল।

ইসলাম প্রচারের প্রথম তিন বছর মুসলিমরা তাদের বিশ্বাস প্রকাশ্যে প্রচার শুরু করেন নি। এরপর আল্লাহর তরফ থেকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের নির্দেশ আসলে তিনি তাতে অগ্রসর হন। এরপর মুসলিমদের ওপর বিভিন্নভাবে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। আবু বকরও নিগ্রহের স্বীকার হয়েছিলেন। ৬১৭ সালে কুরাইশদের পক্ষ থেকে বনু হাশিম গোত্রকে একঘরে করে রাখা হয়। ফলে তারা মক্কার সামাজিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এর পূর্বে কিছু মুসলিম আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন। ৬২২ সালে মুসলিমরা মদিনায় হিজরত করতে শুরু করে। কয়েকটি দলে এই হিজরত হয়। মোহাম্মাদ ও আবু বকর একই সাথে হিজরত করেন।

হিজরতের সংবাদ জানতে পেরে তাদের ধরার জন্য মক্কা থেকে বিভিন্ন লোক বিভিন্ন দিকে পাঠানো হয়। অনুসন্ধানকারীরা গুহা পর্যন্ত পৌছে গেলে আবু বকর চিন্তিত হয়ে উঠেন। গুহায় তিনদিন ও তিনরাত অতিবাহিত করার পর তারা দুজন মদিনার দিকে অগ্রসর হন। তারা মদিনার শহরতলী কুবায় পৌঁছে সেখানে কিছু সময় অতিবাহিত করেন। এরপর তারা মদিনায় পৌঁছান।  মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় একটি মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। এরপর মসজিদে নববী নির্মাণ করা হয়। আবু বকর এর নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছলেন। মোহাম্মদ (সা.)  অন্যান্য সাহাবিদের ন্যায় আবু বকরের সাথে খারিজাহ বিন জাইদ আনসারিকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন। মক্কায় আবু বকর একজন কাপড় ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি মদিনায়ও একই ব্যবসা শুরু করেন।

৬২৪ সালে আবু বকর মুসলিম ও কুরাইশদের মধ্যে সংঘটিত প্রথম যুদ্ধ বদরের যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তাঁবুর প্রহরার দায়িত্বে ছিলেন। পরের বছর উহুদের যুদ্ধেও তিনি অংশ নিয়েছেন। পরে আবু বকর ইহুদি বনু নাযির গোত্রের বিরুদ্ধে অভিযানে অংশ নিয়েছেন। ৬২৭ সালে তিনি খন্দকের যুদ্ধ এবং পরবর্তী বনু কুরাইজা অভিযানে অংশ নিয়েছেন। খন্দকের যুদ্ধের সময় মোহাম্মদ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সৈনিকদের বেশ কয়েকটি দলে ভাগ করে একেক অংশ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তন্মধ্যে একটি আবু বকরের তত্ত্বাবধানে ছিল। শত্রুরা নানাভাবে পরিখা অতিক্রমের চেষ্টা করলেও আবু বকর তার দায়িত্বপ্রাপ্ত অংশে আক্রমণ ঠেকিয়ে দেন। তার নামে সে অংশে একটি মসজিদ নির্মিত হয় যা মসজিদ-ই-সিদ্দিকি বলে পরিচিতি লাভ করে।

৬২৮ সালে আবু বকর (রা) হুদায়বিয়ার সন্ধিতে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি এই সন্ধির অন্যতম সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করেন। তিনি খায়বারের যুদ্ধেও অংশ নিয়েছেন। ৬৩০ সালে তিনি মক্কা বিজয়ে অংশ নেন। ৬৩০ সালে তিনি হুনায়নের যুদ্ধ এবং তাইফ অবরোধে অংশ নেন। হুনায়নের যুদ্ধের সময় মুসলিম সেনাবাহিনী হুনায়ন উপত্যকার মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শত্রুদের তীরের সম্মুখীন হয়। অপ্রস্তুত অবস্থায় হামলা হওয়ায় মুসলিমদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়েছিল। অনেকে ছুটোছুটি শুরু করলেও কয়েকজন সাহাবি মোহাম্মদ  আবু বকরকে রক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। আবু বকর তন্মধ্যে অন্যতম।

৬৩০ সালে তাবুক অভিযানের সিদ্ধান্ত হয়। এতে সহায়তার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিমদের কাছে সাহায্যের হাত বাড়াতে বলেন। উসমান ইবনে আফফান এতে প্রায় নয়শ উট এবং একশ ঘোড়া দান করেন। উমর ইবনুল খাত্তাব তার সম্পদের অর্ধেক দান করেন। আবু বকর তার সকল সম্পদ দান করে এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তার বক্তব্য ছিল, ‘আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে আমার ও আমার পরিবারের জন্য রেখেছি’। ৬৩১ সালে মুসলিমদের একটি দল মুক্তভাবে হজের উদ্দেশ্যে মক্কা গমন করে। আবু বকর এই দলের নেতৃত্ব দেন। ইসলামের ইতিহাসে তিনি প্রথম আমিরুল হজ বা হজের নেতা হিসেবে স্বীকৃত।

বিদায় হজ থেকে ফেরার কিছুকাল পর মোহাম্মদ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। এমতাবস্থায় তিনি তার মৃত্যুর চারদিন আগ পর্যন্ত নামাজের ইমামতি করেছেন। এরপর অসুস্থতার মাত্রার কারণে ইমামতি করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি এসময় আবু বকরকে নামাজের ইমাম হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেন।  মোহাম্মদের মৃত্যু সংবাদ প্রচার হওয়ার পর উমর ইবনুল খাত্তাব অশান্ত হয়ে পড়েন এবং তা মানতে অস্বীকৃতি জানান। এসময় আবু বকর বাইরে এসে ঘোষণা করেন, তোমাদের মধ্যে যারা  মোহাম্মদ (সা.)-এর অনুসরণ করতে তারা জেনে রাখ যে, মোহাম্মদ (সা.)  মৃত্যুবরণ করেছেন। আর যারা আল্লাহর ইবাদত করতে, অবশ্যই আল্লাহ সর্বদাই জীবিত থাকবেন কখনো মৃত্যুবরণ করবেন না। আবু বকরের বক্তব্যের পর উমরের অবস্থা শান্ত হয়।

মোহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকার নিয়ে মুসলিমদের মতপার্থক্য দেখা দেয়। মুহাজির ও আনসাররা নিজেদের মধ্য থেকে নেতা নির্বাচনের পক্ষে ছিল। কিছু গোত্র পুরনো প্রথা অনুযায়ী গোত্রভিত্তিক নেতৃত্ব ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চায়। আনসাররা সাকিফা নামক স্থানে একত্রিত হয়ে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করে। এরপর আবু বকর, উমর ও আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ এখানে আসেন। সভার আলোচনায় এক পর্যায়ে উমর ইবনুল খাত্তাব আবু বকরের প্রতি তার আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহও তার অণুসরণ করেন। এরপর বাকিরাও আবু বকরকে নেতা হিসেবে মেনে নেয়।

আবু বকরের খিলাফত ২৭ মাস অর্থাৎ দুই বছরের কিছু বেশি সময় স্থায়ী ছিল। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে তাকে বেশ কিছু অস্থিতিশীলতার সম্মুখীন হতে হয় এবং তিনি তা সফলভাবে মোকাবিলা করেন। নতুন নবী দাবিকারী বিদ্রোহীদেরকে তিনি রিদ্দার যুদ্ধে দমন করেন। তিনি বাইজেন্টাইন ও সাসানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন, যা ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এসব অভিযানের ফলে মুসলিম সাম্রাজ্য কয়েক দশকের মধ্যে শক্তিশালী হিসেবে আবির্ভূত হয়। আবু বকর সর্বপ্রথম গ্রন্থাকারে  কোরআন সংকলন করেন। ইতিপূর্বে  কোরআনের বিভিন্ন অংশ বিচ্ছিন্নভাবে লিপিবদ্ধ ছিল।

এছাড়াও হাফেজরা কোরআন মুখস্থ করে রাখতেন। ইয়ামামার যুদ্ধে অনেক হাফেজ শহীদ হলে উমর ইবনুল খাত্তাব গ্রন্থাকারে  কোরআন সংকলনের জন্য আবেদন জানান। এজন্য জায়েদ ইবনে সাবিতকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এর সদস্যরা সবাই হাফেজ ছিলেন। তারা  কোরআনের সকল অংশ সংগ্রহ করে একক গ্রন্থ হিসেবে লিপিবদ্ধ করেন এবং হাফেজদের স্মৃতির সাথে সেগুলো মিলিয়ে দেখা হয়। মৃত্যুর আগে আবু বকর (রা.) কোরআনের এই কপিটি তার উত্তরসূরি উমর ইবনুল খাত্তাবকে দিয়ে যান। উমর (রা.) এর শাসনকালে এটি তার কাছেই রক্ষিত ছিল। উমর কোরআনটি তার মেয়ে ও মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রী হাফসা বিনতে উমরকে দিয়ে যান। পরবর্তী খলীফা উসমান ইবনে আফফান (রা.) এই কোরআনের আরো প্রতিলিপি তৈরি করিয়ে তা খেলাফতের বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করেছিলেন।

৬৩৪ সালের ২৩ আগস্ট হজরত আবু বকর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি বিছানায় শায়িতাবস্থায় থাকেন। আবু বকর তার উত্তরসূরি মনোনীত করার জন্য প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন যাতে তার মৃত্যুর পর মুসলিমদের মধ্যে সমস্যা দেখা না দেয়। অন্যান্য সাহাবিদের সাথে পরামর্শ করে তিনি উমর ইবনুল খাত্তাবকে তার উত্তরসূরি হিসেবে নিয়োগ দেন। ৬৩৪ সালের ২৩ আগস্ট আবু বকর মারা যান। আয়েশার ঘরে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাশে তাকে দাফন করা হয়।

 

লেখক : কলামিস্ট, সহকারী কর্মকর্তা (ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ)

সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

arafatrahman373@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads