• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
তুর্কির নানুতুবি শায়েখ ‘মাহমুদ অ্যাফেন্দি’

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

তুর্কির নানুতুবি শায়েখ ‘মাহমুদ অ্যাফেন্দি’

  • প্রকাশিত ১৩ অক্টোবর ২০২১

ইতিহাস বলে- যখনই মুসলিম উম্মাহ কোনো সংকটে পতিত হয়েছে তখনই আল্লাহ তাআলা তাঁর কোনো প্রিয় বান্দার দ্বারা উম্মাহকে এই সংকট থেকে উত্তরণ করেছেন। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে যখন কামাল আতাতুর্ক তুরস্ক থেকে ইসলামকে বিদায় করার সব আয়োজন সমাপ্ত করলো, তখন তার সকল আয়োজনকে রুখে দিতে যিনি নিজেকে ইসলামের পক্ষে পেশ করেছিলেন- তিনি হলেন শায়খুল ইসলাম মাহমুদ অ্যাফেন্দি।

শায়েখ মাহমুদ অ্যাফেন্দি ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে তুরস্কের অফ জেলার মিনো (বর্তমানে তাভানল্লি) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম মাহমুদ উস্তাসমানোগলু অ্যাফেন্দি।

তিনি মাত্র দশ বছর বয়সে পিতার অধীনে সম্পূর্ণ কোরআন হিফজ করেন। প্রাথমিক পড়াশোনা তার পিতার কাছে শেষ করে মাত্র ষোল বছর বয়সে পিতার ইযাজত লাভ করেন এবং শিক্ষা চালিয়ে যান। তিনি প্রথমে আরবি ও ফার্সি পড়াশোনা করে ইসলামী বিজ্ঞান অধ্যয়ন করতে যান। ১৯৫২ সালে তিনি আলী হায়দার অ্যাফেন্দির কাছে গমন করে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালে আলী হায়দার অ্যাফেন্দি তাকে ইস্তাম্বুলের ইসমাইল আঘা মসজিদের ইমাম হিসেবে নিয়োগ দেন। যেখানে তিনি ১৯৯৬ সাল  পর্যন্ত মোট ৪২ বছর ইমামতির দায়িত্বে ছিলেন।

১৯৬০ সাল নাগাদ আলী হায়দার (রহ.)-এর মৃত্যুর পর শায়েখ মাহমুদ অ্যাফেন্দি উস্তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে আধ্যাত্মিক রাহবারি বা নৈতিক দিকনির্দেশনা দিতে শুরু করেন। এখন অবধি তিনি খানকার মাধ্যমেই ধর্মীয় কাজ আঞ্জাম দিচ্ছেন।

সেক্যুলার তুরস্কে যখন মসজিদগুলোকে মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করা হয়, মাদ্রাসাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়, ধর্মীয় শিক্ষা করা হয় নিষিদ্ধ। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে এমনকি ব্যক্তিগতভাবেও ধর্ম চর্চার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ধর্মীয় ব্যক্তিদের ওপর শুরু হয় প্রচন্ড নির্যাতন, গুম, খুন। আলেম উলামারা শহরে ছেড়ে গ্রাম অঞ্চলে আত্মগোপনে চলে যেতে বাধ্য হন, সেই সময়েই শায়েখ মাহমুদ অ্যাফেন্দি ছাত্রদের আঙুলের ইশারায় সরফ-নাহু (আরবি ভাষাজ্ঞান) শেখাতেন এবং হাতের ইশারায় মাসআলা মাসায়িল পড়াতেন। এখনও তুরস্কে কিছু জায়গায় এ পদ্ধতিতে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়।

মাহমুদ অ্যাফেন্দি এক সময় গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হন। শহরের একটি পুরাতন মসজিদে অবস্থান করে দ্বীনি ইলম শিক্ষা দেওয়া শুরু করে দেন। এভাবেই তিনি টানা চল্লিশ বছর লোকদের দ্বীন শেখান।

প্রথম আঠারো বছর পর্যন্ত ধর্মদ্রোহী সৈন্যদের ভয়ে সাধারণ জনতা প্রকাশ্যে নামাজ পড়ার সাহস না পেলেও সময়ের সাথে সাথে গুটিকয়েক মানুষ সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে জামাতে নামাজ পড়া শুরু করে। একটা সময় পর আজানের ধ্বনিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ নির্দ্বিধায় মসজিদে সমবেত হতে পারা- তারই মেহনতের ফল। তিনি তুর্কি জাতির মধ্যে পুনঃজাগরণ তৈরি করতে সক্ষম হন। ইসলাম বিদ্বেষী সেক্যুলার তুরস্ককে আবার ইসলামের দিকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে শায়েখ মাহমুদ অ্যাফেন্দির অবদান স্মরণীয় ও বরণীয়।

মহান এই ব্যক্তির এ যাত্রা এতটা সহজ ছিলো না। সেজন্যে তাকে অনেক অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও কষ্ট স্বীকার করতে হয়। সেক্যুলারপন্থিরা তার ওপর অনেকবার হামলা চালায়। নব্বইয়ের দশকে একজন সরকারি মুফতিকে হত্যার অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হন। অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে সরকার তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ২০০৭ সালেও তার ওপর এক ভয়ঙ্কর হামলা হয়, আল্লাহর রহমতে তিনি সেই যাত্রায়ও বেঁচে যান। বর্তমানে পুরো তুরস্কে তার প্রচুর ভক্ত ও অনুসারী রয়েছেন। এমনকি তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানও তার শিষ্য। এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার অগণিত অনুসারী। যারা বিভিন্ন দেশেই দ্বীনের খেদমত চালিয়ে যাচ্ছেন। ইউরোপেও অনেক দ্বীনি শিক্ষাকেন্দ্র তার পৃষ্ঠপোষকতায় চলছে।

তিনি মেরিফেট অ্যাসোসিয়েশন, ফেডারেশন অব মেরিফেট অ্যাসোসিয়েশন এবং আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাহ কনফেডারেশন নামে কয়েকটি সংগঠনও পরিচালনা করেন। তুর্কি ভাষায় তার লিখিত কোরআনে কারিমের আঠারো খণ্ডের বিশাল এক তাফসির গ্রন্থ রয়েছে। ২০১৩ সনে তুরষ্কে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে তুর্কিতে দ্বীনি শিক্ষা প্রচার-প্রসারে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ইমাম কাসেম নানুতবি এওয়ার্ড প্রদান করা হয়। এই কনফারেন্সে বিশ্ববরেণ্য আলেমদের সামনে সায়্যিদ আরশাদ মাদানি শায়েখ মাহমুদ আফেন্দিকে তুর্কির ‘কাসেম নানুতুবি’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

লেখক : আবু মুকাম্মিল সাইফ

তরুণ আলেম, শিক্ষার্থী, মা’হাদুল ফিকরি ওয়াদ্দিরাসাতিল ইসলামিয়া, ঢাকা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads