• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

ধর্ম

আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের গুণাবলি

  • প্রকাশিত ১৪ অক্টোবর ২০২১

মুফতি আনিছুর রহমান

 

আল্লাহতায়ালা  মানুষকে সমগ্র সৃষ্টিজগতের শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে তৈরি করেছেন। জ্ঞান-গরিমা, বিদ্যাবুদ্ধি, কার্যদক্ষতা ও জীবনব্যবস্থা থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক সর্বদিক থেকেই মানুষ অন্যান্য সকল সৃষ্টি থেকে ব্যতিক্রম ও প্রাগ্রসর। জীবন ও জগতের সবকিছুতে মানুষের স্বকীয়তা-অনন্যতা ও বৈশিষ্ট্য দেদীপ্যমান। আল্লাহতায়ালা মানুষকে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ এমনকিছু গুণাবলি দিয়ে সৃষ্টি করেছন যা পৃথিবীর সকল সৃষ্টিকুল থেকে মানুষকে সামগ্রিকভাবে আলাদা করে তুলেছে। আল্লাহতায়ালা কোরআনুল করিমে ইরশাদ করেন, ‘আমি আদম সন্তানদের মর্যাদাশীল করেছি। (সুরা বনি ইসরাইল-৭০)। ‘আমি মানুষকে সুন্দরতম গঠন দিয়ে তৈরি করেছি।’ (সুরা তিন-৪)।

পবিত্র কোরআনুল করিমে বিভিন্ন স্থানে আল্লাহতায়ালা মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। সুরা আল বাকারায় ফেরেশতাদের  অনুযোগের কথা উল্লেখ করেছেন। ফলে মানুষের মান-মর্যাদা ফুটিয়ে তোলার মধ্যে পরিপূর্ণরূপে সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়েছে। মানুষের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ হলো ঈমানদারগণ। তবে ঈমানদারদের স্তরেরও তারতম্য রয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যারা মানবজগতের মধ্যে বিশেষ মর্যাদাবান। তারা সকল প্রকারের কর্ম, ইবাদত-বন্দেগি ও কার্যকলাপের দ্বারা সর্বদা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্যপরশ কামনায় মগ্ন থাকেন এবং প্রতিনিয়ত নিজেদের প্রভুর কাছে নিজেকে আত্মসমর্পিত রাখেন। ফলে তারা আল্লাহর সর্বাধিক ভালোবাসা ও করুণা লাভে ধন্য হন। তাদের মধ্যে বিশেষ কিছু গুণাবলি এমন রয়েছে যেগুলোর ফলে মহান আল্লাহতায়ালা তাদেরকে অত্যধিক ভালোবাসেন এবং তাদের প্রতি বিশেষ করুণা করে থাকেন।

আল্লাহর পূর্ণ দাসত্ব : মানুষ যেহেতু আল্লাহর ‘আব্দ’ বা দাস, সে হিসেবে দাসের কাজ হচ্ছে সদা প্রভুর আদেশ-নিষেধের অনুগত থাকা। প্রভুর সামনে দাসের আশা-আকাঙ্ক্ষা কিংবা ইচ্ছা-অনিচ্ছা বলতে কিছু থাকে না। তার সবকিছু আল্লাহর মর্জির ওপর নির্ভরশীল হয়। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রকৃতপক্ষে বান্দা হওয়ার যোগ্য, সে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সবকিছুই আল্লাহর ইচ্ছাধীন ছেড়ে দেয়।  এবং সর্বদা আল্লাহর আদেশ-নিষেধ অবনত মস্তকে পালন করে। এজন্যই ইসলাম শব্দের অর্থ হচ্ছে পূর্ণ আত্মসমর্পণ।  অর্থাৎ আল্লাহর সকল হুকুম-আহকাম বিনা দ্বিধা-সংকোচে এবং যুক্তিতর্ক ব্যতিরেকে মেনে নেওয়া। এজন্য একজন খাঁটি মুমিনের প্রথম পরিচয় হবে আল্লাহর হুকুম-আহকাম সর্বতোভাবে ও অকুণ্ঠচিত্তে মেনে চলা।

 

শিরক থেকে বেঁচে থাকা : আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্যতম একটি গুণ হলো, আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে ডাকে না। (সুরা ফুরকান-৬৮)। ‘শিরক’ করা বা কোনো কিছুকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করা সবচেয়ে মারাত্মক গুনাহ। আল্লাহতায়ালা সব গুনাহ মাফ করলেও শিরকের গুনাহ মাফ করবেন না। হজরত লোকমান (আ.) তাঁর ছেলেকে উপদেশ দিয়েছেন, ‘হে পুত্র! তুমি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শিরক কোরো না। নিশ্চয় শিরক সবচেয়ে বড় গুনাহ।’ (সুরা লোকমান-১৩)।

পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করা : আল্লাহতায়ালা বলেন, আল্লাহর বান্দা হলো তারা, যারা জমিনে নম্রভাবে চলাফেরা করে। (সুরা ফুরকান-৬৩)। অর্থাৎ তাদের চালচলনে বিনয়, নম্রতা ও নিরহঙ্কার প্রকাশ পায়। আত্মগরিমা ও দাম্ভিকতা দেখা যায় না। তাদের দৃষ্টি নিম্নগামী হয়ে থাকে এবং তারা দৃঢ় পদক্ষপে পথ চলে। আল্লাহভীতির কারণে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সদা নমনীয় থাকে এবং যত্রতত্র সেগুলোর অনাধিকার চর্চা থেকে বেঁচে থাকে। প্রকৃতপক্ষে তারা দুর্বল-ভীরু কিংবা অক্ষম নয়। বরং আল্লাহভীতি ও আখিরাতের চিন্তা তাদের অতি নম্র, সহনশীল এবং নমনীয় ও স্বল্পভাষী করে রাখে।

মূর্খজনোচিত আচরণের বিপরীতে শান্তির বার্তা : আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মূর্খরা যখন তাদের সঙ্গে বািবতণ্ডা করে তখন তারা বলে, তোমাদের ওপর সালাম বা শান্তি বর্ষিত হোক।’ (সুরা ফুরকান-৬৩)। এখানে সালামের অর্থ মুসলমানরা পরস্পর দেখা-সাক্ষাতে অভিবাদন জানানের ধর্মীয় সালাম নয়। বরং ঐ মূর্খের শান্তি-সুখ ও নিরাপত্তা কামনা করা এবং বুঝিয়ে দেওয়া যে, তোমার অজ্ঞতাপ্রসূত আচরণের জবাব আমি মূর্খতা দিয়ে দেব না। তোমার সঙ্গে ঝগড়াও করব না। বরং তোমার শান্তি-সমৃদ্ধি ও মঙ্গল হোক, সেটাই আমি কামনা করি। আল্লাহতায়ালা অন্য জায়গায় বলেছেন, ‘ভালো ও মন্দ কখনো সমান হতে পারে না। মন্দকে ভালো আচরণ দ্বারা প্রতিহত করো। অতএব যার সঙ্গে তোমার শত্রুতা রয়েছে, সে হয়তো তোমার পরমপ্রিয় বন্ধু হয়ে ওঠবে।’ (সুরা ফুসসিলাত-২৫)।

সিজদা ও নামাজরত অবস্থায় রাত কাটানো : আল্লাহতায়ালা বলেন, যারা তাদের রবের ইবাদতে সিজদা ও দণ্ডায়মান অবস্থায় রাত্রিজাগরণ করে।’ (সুরা ফুরকান-৬৪)। যারা ইবাদতের নিমিত্তে নিদ্রা ও শয্যা ত্যাগ করে রাত্রিজাগরণ করে, তারা নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রিয় বান্দা। শেষ রাতের তাহাজ্জুদ নামাজ সকল রাতের নেক বান্দাদের অভ্যাস ছিল। এ নামাজ মুমিনের মান-মর্যাদা বৃদ্ধি করে। প্রভুর সাথে সম্পর্ককে দৃঢ় ও মজবুত করে। তারা ইলম অর্জন-বিতরণ, দাওয়াত-তাবলিগ ও আপন কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে। অন্যত্র আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদের পার্শ্বদেশ শয্যা থেকে পৃথক থাকে। তারা তাদের পালনকর্তাকে আশা ও আশঙ্কায় ডেকে থাকে এবং তাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে।’ (সুরা সিজদা-১৬)। অন্যত্র আল্লাহতায়ালা আরো বলেছেন, ‘তারা রাতের বেলা খুব স্বল্প আরাম গ্রহণ করে এবং শেষপ্রহরে ক্ষমা-মার্জনা কামনা করে।’ (সুরা জারিয়াত ১৭-১৮)। আল্লাহর নিষ্ঠাবান বান্দারা রাতে বিছানা ত্যাগ করে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিতে নিমগ্ন হয়। প্রভুর করুণা ও পুণ্য লাভের আশায় তারা নামাজ-জিকির এবং ইস্তেগফারে ব্যাকুল হয় ও আত্মসমাহিত হয়।

আরেকটি গুণ হলো, ‘তারা যখন খরচ করে তখন তারা অযথা ব্যয় করে না, কৃপণতাও করে না। বরং মধ্যপন্থা অবলম্বন করে।’ (সুরা ফুরকান-৬৭)। শরিয়তের পরিভাষায়, আল্লাহর অসন্তুষ্টিতে অপাত্রে খরচ করাকে অপব্যয় বলে, যদিও তা অতি সামান্য হোক। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, তারা অপব্যয় করে না এবং কার্পণ্যও করে না। কোরআনের অন্য জায়গায় আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।’ (সুরা বনি ইসরাইল-২৭)।

 

লেখক : ইমাম ও খতিব

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads