• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

ধর্ম

রবিউল আউয়াল ও আমাদের শিক্ষা

  • প্রকাশিত ১৫ অক্টোবর ২০২১

শাকিবুল হাসান

 

ইসলামী শরিয়তের বিধান অনুযায়ী মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আল্লাহর সৃষ্টি আঠারো হাজার মখলুকাতের মধ্যে মানুষ সর্বোৎকৃষ্ট। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি মানুষ আর জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছি শুধুমাত্র আমরা ইবাদতের জন্য।’ আমাদের আদি পিতা হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যত বান্দা-বান্দি দুনিয়াতে এসেছে সবাই এর অন্তর্ভুক্ত। এই মনুষ্য জাতিকে দীনের সঠিক পথ দেখিয়ে তদনুযায়ী চলার বা জীবনযাপনের জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যুগে যুগে অসংখ্য-অগণিত  নবী-রাসুল দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। তাদের প্রধান কাজ ছিল আল্লাহর নির্দেশে এই সৃষ্টি জগতে ওনার পরিচয় তুলে ধরা এবং সঠিক জীবনপদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত করা। ইসলামী জীবনপদ্ধতির দলিল বা প্রমাণস্বরূপ ‘আল-কোরআন’ দিয়েছেন। আর এ কোরআন সব নবীর শেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, আখেরি জামানার শেষ পয়গম্বর আহমদে মুস্তাফা, মোহাম্মদে মুস্তফা মহানবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর নাজিল করেছেন। সমস্ত নবী রাসুল এবং মানবজাতির আদর্শ তিনি।

 

আরবী মাসগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য মাস হলো রবিউল আউয়াল মাস। ঐতিহাসিক এ মাসে সাইয়েদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন খাতামুন নাবীয়্যিন এ ধরাপৃষ্ঠে আগমন করেন। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসের ১২ (মতান্তরে ৯, ১০) তারিখে মক্কার কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। আবার এই মাসেরই ১২ তারিখ সোমবার ৬৩ বছর বয়সে উনি পরলোকগমন করেন। বিশ্বের মুসলমানদের কাছে এ মাস অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দীর্ঘ জীবন তাঁর উম্মতের জন্য জীবন ধারণের সর্বোত্তম আদর্শ। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের মুসলিম সমাজের কতিপয় লোক ভালোবাসার নামে রাসুলের জীবনাদর্শ ও সুন্নাতকে বাদ দিয়ে রবিউল আউয়াল মাস এলে ঈদে মিলাদুন্নবী ও জসনে জুলুসের নামে নারী-পুরুষ সম্মিলিত বর্ণাঢ্য র্যালি, আনন্দ মিছিল ও শোভা যাত্রার মধ্য দিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্মদিনকে শ্রেষ্ঠ ঈদ ঘোষণা করাকে ইবাদত মনে করেন। বস্তুত এসব কার্যাবলি অমূলক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। যার কোনো শরিয় ভিত্তি নেই। একটু চিন্তু করলে দেখা যায়, রবিউল আওয়াল মাসের এ দিনটিতে রাসুলের জন্মের ব্যাপারে যথেষ্ট মতানৈক্য রয়েছে। কিন্তু এ দিনটিতে তার ইন্তেকালের ব্যাপারে কোনো মতবিরোধ নেই। তাহলে আমরা এ দিনটিতে আনন্দ উৎসব পালন করি কিসের ভিত্তিতে?

 

সত্যিকারার্থে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ভালোবাসার অর্থ হলো, তিনি যেসব গুণে গুণান্বিত ছিলেন সেগুলোর চর্চা করা ও নিজের মাঝে সেগুলোর বাস্তবায়ন এবং যেসব বিষয় তিনি পরিহার করেছেন ও পরিহার করতে বলেছেন তা পরিহার করা। এ মর্মে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনীত দীনকে তোমরা আঁকড়ে ধর, আর যা নিষেধ করেছেন তা পরিহার কর।’ (সুরা আল হাশর, আয়াত-৭) রাসুল  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে আমাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। এ প্রসেঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকে যারা পরকালে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের আশা রাখে ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মাঝে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।’ (সুরা আল আহজাব, আয়াত- ২১)

 

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ৬৩ বছরের জিন্দেগিকে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথম ভাগ হলো তাঁর জন্মের পর থেকে নবুয়ত লাভের আগ পর্যন্ত। অর্থাৎ ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত। আর দ্বিতীয় ভাগ নবুয়ত লাভের পর থেকে বাকি জীবন। প্রথম ভাগের জীবনকে বলা হয়েছে নবুয়ত লাভের দলিল। ইতিহাসবিদদের বর্ণনা অনুযায়ী ছোট থেকেই তাঁর কিছু লক্ষণ এটা প্রতীয়মান হয় যে, তিনিই হবেন আখেরি জামানার শেষ নবী। তার জীবনীতে পাওয়া যায়, ছোট বেলা থেকে নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত  সাধারণত ছেলে-মেয়েদের সামান্য কাপড় পরিধান করে বা বস্ত্রহীন করে রাখা হয়। কিন্তু মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছোটবেলা থেকেই উলঙ্গ অবস্থায় রাখা যায় নি। উলঙ্গ করতে চাইলেই চরমভাবে কান্না করতেন। আবার তাকে কখনো গান-বাজনার আসরে রাখা যায়নি বা জোর করে নিয়ে গেলেও আল্লাহর অসীম ক্ষমতায় তিনি গভীর ঘুমে আছন্ন হয়ে যেতেন। যথাসাধ্য চেষ্টা করেও কেউ তাঁর ঘুম ভাঙাতে পারেননি। কিন্তু ওই আসর বা অনুষ্ঠান শেষ হলেই আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি জাগ্রত হতেন। এছাড়াও তার শৈশব কাল থেকে আমাদের অনেক বড় একটা শিক্ষা নেওয়া বাকি আছে। আমরা জানি নবীজির জন্মদাত্রী মা আমেনা হলেও দুধ মা ছিলেন হালিমা। নবীর জীবনীতে বর্ণিত আছে, একদিন তিনি ছোট্ট  মোহাম্মদকে দুধ পান করাচ্ছিলেন। এক স্তন পান করানো হলে মা হালিমা আরেক স্তন পান করানোর চেষ্টা করছিলেন কিন্তু উনি বারবারই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন। তিনি মা হালিমার দিকে তাকিয়ে ইশারায় যেন বলছিলেন মা আমাকে জোর করছো কেন! আমার ভাগেরটা আমি পান করে ফেলেছি। বাকিটা আমার দুধভাইয়ের জন্য। এখানে শিক্ষণীয় বিষয় হলো নবী শিশু অবস্থাতেও নিজের ভাইয়ের হকটুকু রক্ষা করেছেন। আর বর্তমানে আমাদের সমাজে এক ভাই আরেক ভাইয়ের ভাগের জমি কিভাবে কেড়ে নেওয়া যায় সেই চিন্তায় মগ্ন।

 

সেই ছোট্টবলা থেকেই মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সততা আর নিষ্টার কারণে গোটা মক্কায় আল-আমিন (বিশ্বাসী) নামে পরিচিত ছিলেন। কথা দিয়ে কথা রাখতেন, কোনো অবস্থাতেই আমানতের খেয়ানত করতেন না। কিন্তু  আমাদের মুসলিম সমাজে কিভাবে অন্যের মেরে ধরে, আরেকজনের ঘাড়ে কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া যায় সেই প্রতিযোগিতা করছি। নিজেদের মধ্যে না আছে নবীর আদর্শ আর না-ই আছে নবীর সুন্নাত। শুধু ঈদে মিলাদুন্নবী পালনের নামে মসজিদে ঘটা করে খাওয়ার আয়োজন, অনুষ্ঠান করলেই দায় শেষ হয়ে যায় না। অন্যদিকে নবীজি মাটির তৈরি, না নূরের তৈরি এটা নিয়ে মুসলমান নিজেদের মধ্যে দল বানিয়েছে। এর নাম ইসলাম না। নিজের মধ্যে নবীর প্রতি মোহাব্বত পয়দা করতে হবে। তাঁর আদর্শ অনুযায়ী জীবন অতিবাহিত করার চেষ্টা করতে হবে।

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের দ্বিতীয় তথা শেষ ভাগ হচ্ছে নবুয়তপ্রাপ্তির পরবর্তী জীবন। হেরা গুহায় ধ্যানে থাকাবস্থায় সুরা আলাকের প্রথম কয়েকটি আয়াত নিয়ে হাজির হলেন জিবরাঈল (আ.)। শুরু হলো  কোরআন নাজিল। এরপর বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে ক্রমানুসারে দীর্ঘ ২৩ বছরে গোটা কোরআন তাঁর ওপর নাজিল হয়েছে। এরপর থেকে শুরু করলেন ইসলাম প্রচার বা দীনের দাওয়াত। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি অনেক অপমানিত, লাঞ্ছিত হলেও আল্লাহর নির্দেশে তিনি সর্বদা ধৈর্য ধারণ করেছেন। ধৈর্য ধারণ একটি মহৎ গুণ, যা সবার মধ্যে বিদ্যমান থাকে না।

 

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুয়ত লাভের ১৩ বছর পর অর্থাৎ ৫৩ বছর বয়সে আল্লাহর নির্দেশে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করলেন। কিন্তু এখানেও কাফির-মুশরিকরা তাঁর বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। আর এ সময়েই আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ আসে জিহাদের। নবীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেকে ইসলাম ধর্মগ্রহণ শুরু করলে কাফিররা বুঝতে পারলো এভাবে চলতে থাকলে তারা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। তাই তারা মোহাম্মদ এবং তার অনুসারীদের ধ্বংস করার পাঁয়তারা করে। তখনই  নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিহাদের ডাক দেন। তাহলে বুঝা যাচ্ছে ইসলামে জিহাদের নির্দেশ তখনই দেওয়া হয়েছে যখন ইসলাম ধর্মের ওপর আঘাত এসেছে। ধর্মকে নস্যাৎ করার, ধ্বংস করার প্রস্তুতি চলছে। আর কিছু লোক যেখানে-সেখানে জিহাদের নামে উল্টাপাল্টা বয়ান করে বেড়াচ্ছে। অযথা একটা পিঁপড়াকে হত্যা করাও ইসলামে নিষিদ্ধ। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মুসলমানের লেবাসধারী একদল মানুষ নির্বিচারে, অযৌক্তিক কারণে গণহারে মানুষ হত্যা করে সেটাকে জিহাদের নামে চালিয়ে দিচ্ছে। এদেরকে চিহ্নিত করে ইসলাম থেকে বিতারিত করতে হবে। এদের সর্বভাবে ত্যাগ করতে হবে। কারণ এরা আসলে ইসলামের শত্রু, দেশের শত্রু, গোটা মানবজাতির শত্রু। সুতরাং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের কথা চিন্তা করে নবীর জীবনাদর্শকে সঠিকভাবে বুঝে, তাঁর দেখানো আল্লাহর দীনের পথে সঠিকভাবে জীবনযাপন ও মহান আল্লাহ পাকের হুকুম পালন করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, বরেন্দ্র কলেজ রাজশাহী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads