• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

ধর্ম

আল্লামা শফী (রহ.) : জাগরণের মহানায়ক

  • প্রকাশিত ১৫ অক্টোবর ২০২১

আব্দুল্লাহ আলমামুন আশরাফী

 

আল্লামা আহমদ শফী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। একটি নাম। একটি ইতিহাস। একটি শতাব্দীর ইতিহাসকে ধারণ করে কালের কিংবদন্তির রূপ পরিগ্রহ করে মহাকালের মহা তারকায় পরিণত হয়েছিলেন। জীবনের পড়ন্ত বেলায় মাদরাসার চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে এসে একটি ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে দিয়ে চেতনার পাঠে উদ্দীপ্ত করে সুখের শান্ত সরোবরে অবগাহন করে অনন্তের পথে যাত্রা করেন। অশীতিপর এই বৃদ্ধ মানুষটির তর্জনী হেলনে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ মাইলের ছোট্ট এই জনপদটিতে কাঁপন ধরে যেত। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রুপসা থেকে পাথুরিয়া-সবুজ বাংলার দিগ-দিগন্তে ছড়িয়ে যেত তাঁর দরদপূর্ণ কথামালা। তাঁর কথা শুনতে, নরম হাতটা একটু ছুঁয়ে দিতে আপামর জনতার সে কি প্রাণান্তকর চেষ্টা-চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। এ যেন এলাম- দেখলাম আর জয় করলাম-এর জীবন্ত নমুনা। একজন আল্লামা আহমদ শফী  সত্যিকার অর্থেই ‘মুকুটহীন সম্রাটে’ পরিণত হয়েছিলেন। দলমত নির্বিশেষে সবার আস্থার  অত্যুজ্জ্বল মিনাররূপে হূদয়রাজ্য জয় করে নিয়েছিলেন।

 

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক। অত্যাচারী স্বাধীনতা হরণকারী স্বৈরাচারী ইংরেজদের কবল থেকে উপমহাদেশের আপামর জনতা স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের স্বপ্নে বিভোর। ত্যাগ তিতিক্ষা সংগ্রামের  রক্তপিচ্ছিল রাজপথ পাড়ি দিয়ে স্বাধীনতার মুক্ত আকাশে উড়াল দিতে সবাই বদ্ধপরিকর। ঠিক সেই মুহূর্তে অবিভক্ত ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চল সবুজ বাংলার স্বর্ণমানব প্রসবীনী ভূখণ্ড ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার এক অজপাড়াগাঁয়ে চোখ মেলেন শতাব্দীর কিংবদন্তী জাগরণের মহানায়ক আল্লামা আহমদ শফী (রহ.)।

 

১৯১৬ সালে রাঙ্গুনিয়ার পাখিয়ারটিলা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণকারী আল্লামা শফী ১০ বছর বয়সে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে দীনি শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। ভর্তি হন উপমহাদেশের বিখ্যাত দীনি শিক্ষাপীঠ আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায়। এখানে প্রায় এক যুগ পড়াশুনা শেষে উচ্চতর শিক্ষালাভের উদ্দেশে গমন করেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সূতিকাগার প্রাচীন শিক্ষাপীঠ ঐতিহ্যবাহী দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসায়। দেওবন্দে তিনি চার বছর সেখানকার প্রাজ্ঞ যুগশ্রেষ্ঠ আলেমদের উষ্ণ সান্নিধ্যে দীনি বিষয়ে উচ্চতর জ্ঞানার্জন করেন। বিশেষ স্বান্নিধ্য লাভ করেন উপমহাদেশের স্বাধীনতার অগ্রনায়ক দারুল উলুম দেওবন্দের খ্যাতিমান হাদিস বিশারদ ও প্রধান শিক্ষক শাইখুল ইসলাম আল্লামা সৈয়দ হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ.)-এর। আল্লামা মাদানী (রহ.) গভীর পরিচর্যায় ভবিষ্যতের মহানায়করূপে গড়ে তোলেন তরুণ আলেম আহমদ শফীকে। আধ্যাত্মিক জগতের রাহবাররূপে দীক্ষাপ্রধানপূর্বক তাঁকে খেলাফত প্রদান করে বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশে পাঠান। দেশে ফিরে তরুণ আলেম মাওলানা শফী হাটহাজারী মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন।

 

আল্লামা শফী (রহ.) ছিলেন আপাদমস্তক একজন শিক্ষক। সুদীর্ঘ একটি জীবন তিনি শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। কয়েক প্রজন্মের শিক্ষক ছিলেন তিনি। প্রায় আশি বছর শিক্ষকতার গুরুদায়িত্ব পালন করে তিনি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। হাজার বছর ধরে শিক্ষকতার ইতিহাসে এত দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালনকারী আরো কোনো শিক্ষক ছিলেন কি না সন্দেহ আছে। এ সুদীর্ঘকাল শিক্ষকতাকালে তিনি হাজার হাজার মুহাদ্দিস, লেখক, আলোচক, গবেষক তৈরিতে অসামান্য ভূমিকা পালন করে জাতিকে ঋদ্ধ করেছেন।

 

আল্লামা আহমদ শফী (রহ.) চল্লিশ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি সাধারণ শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অবশেষে মুরব্বীদের সিদ্ধান্তনুযায়ী ১৯৮৬ সালে তিনি হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক পদে নিযুক্ত হন। তিনি প্রায় তিন যুগ মহাপরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর এ পদে দায়িত্ব পালনকালে দারুল উলুমের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়। অবকাঠামোগত উন্নতি, পড়াশোনার মানোন্নয়ন, বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চতর গবেষণা বিভাগসহ যুগান্তকারী অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করে দারুল উলুমের উন্নতি অগ্রগতিতে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। এ সময় মাদরাসার সুনাম বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। স্বনামধন্য প্রাচীন শিক্ষাপীঠ বিশ্ববিখ্যাত মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট ও পিএইচডি ডিগ্রীধারী মেধাবী শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক মানের ইসলামিক স্কলার ও প্রাজ্ঞ  মুহাদ্দিসদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দান করে আল্লামা আহমদ শফী দারুল উলুমের শিক্ষার মানকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেন।

 

আজীবন শিক্ষকতায় রত থাকা আল্লামা আহমদ শফী জীবনের পড়ন্ত বেলায় দেশ, জাতি ও আপামর জনতার ধর্মীয় চেতনা রক্ষায় ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ধর্মীয় অঙ্গনে নেতৃত্বশূন্যতার এক ভয়াল মুহূর্তে তিনি এ দেশের তাওহীদি জনতার হূদয়রাজ্যের একচ্ছত্র মুকুটহীন সম্রাট হিসেবে আবির্ভূত হন। দিশেহারা জনতা সঠিক দিশা লাভ করে। এ দেশের মুসলমানদের ঈমান আকীদা সংরক্ষণের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’ নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সংগঠনটির আমীর বা প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে এদেশের তাওহীদি জনতার ঈমান আকীদা ও ধর্মীয় অনুভূতির ওপর ভয়াবহ আক্রমণকালে তের দফা দাবি উত্থাপন করে সংগঠনটি ব্যাপক আলোচনায় আসে। এ সময় আল্লামা আহমদ শফী আপামর জনতার ধর্মীয় জাগরণের মহানায়ক হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত হয়ে ওঠেন। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া তথা পুরো বাংলাদেশে ইসলামের পক্ষে ব্যাপক গণজোয়ার বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়। গুটিকয়েক মানবতার দুশমন ধর্মবিদ্বেষী নাস্তিক মুরতাদের ধর্মবিরোধী নোংরা আস্ফাালনের বিরুদ্ধে এদেশের তাওহীদি জনতা আল্লামা আহমদ শফীর নেতৃত্বে তুমুল বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ৬ এপ্রিল ঢাকার মতিঝিলে  লংমার্চ ও ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে জনতার গণজোয়ার দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়। জাগরণের মহানায়ক একজন আল্লামা আহমদ শফীর অঙ্গুলি হেলনের কারিশমা দেখে পুরো বিশ্ব অবাক তাকিয়ে রয়। অসভ্য বর্বর ধর্মবিদ্বেষীদের হূদয়ে কাঁপন শুরু হয়। একজন আল্লামা শফির হুংকারে অসভ্যদের আস্ফাালন থেমে যায়। এভাবে একজন আল্লামা আহমদ শফী ইতিহাসের মহা তারকায় পরিণত হন।

 

জাগরণের মহানায়ক আল্লামা আহমদ শফী (রহ.) গত বছর (২০২০) সেপ্টেম্বরের ১৮ তারিখে এদেশের কোটি জনতাকে কাঁদিয়ে অনন্তের পথে যাত্রা করেন। কালের মহানায়ক চেতনার বাতিঘর আল্লামা আহমদ শফীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। আল্লাহ তাকে জান্নাতের সুউচ্চ মর্যাদা দান করুন। আমিন।

 

লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads