• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
ইসলামের দৃষ্টিতে ঈদে মিলাদুন্নবী

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

ইসলামের দৃষ্টিতে ঈদে মিলাদুন্নবী

  • প্রকাশিত ২০ অক্টোবর ২০২১

 মাহফুজুর রহমান হোসাইনী

 

 

 

১২ রবিউল আওয়াল। জসনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী। সকল ঈদের সেরা ঈদ ঈদে মিলাদ’ এই স্লোগানে কেঁপে ওঠে রাস্তাঘাট। মিছিল, আনন্দ রেলি, মিষ্টি বিতরণ ও খাওয়া দাওয়ার ধুম পড়ে। সম্প্রতি বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিছু মুসলমান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম দিবসকে কেন্দ্র করে ১২ রবিউল আউয়ালে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করে থাকে। পূর্বে থেকেই পোস্টারিং, দেয়াল লেখন ও মাইকিং করা হয়। তবে কয়েক বছর পূর্বেও এদেশের মানুষ এই ঈদের কথা তেমন জানত না। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৭৪ সালে ‘সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ’ বন্দর নগরী চট্টগ্রামের বালুদিঘি ঘাট নিকটস্ত খানখায়ে কাদেরিয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়্যবিয়া থেকে আঞ্জুমানে রাহমানিয়া আহমাদিয়ার ব্যাবস্থাপনায় ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে জসনে জুলুসের প্রবর্তন করেন। তারপর ঢাকায় সর্বপ্রথম ১৯৮০ সালে ৯ রবিউল আউয়ালে জসনে জুলুসের মিছিল বের করা হয়।

ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করে নিজেদের আশেকে রাসূলের দাবি করে তারা। ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করা যদি আশেকে রাসূলের বহিঃপ্রকাশ বা ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হত তাহলে সাহাবি কিরাম রাযি. অবশ্যই এই ঈদ পালন করতেন। কেননা, তাঁরাই হলেন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবচেয়ে বড় আশেক ও সর্বোচ্চ অনুসারী। পৃথিবীতে তাঁরা নবী প্রেমের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কোরআন-হাদিস বা নির্ভরযোগ্য ইসলামী কোন গ্রন্থে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের সামান্যতম প্রমাণও পাওয়া যায় না। কোন ধরনের ইঙ্গিতও নাই। রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগ, সাহাবায়ে কেরামের যুগ, তাবেয়ীদের যুগ এবং তাবে তাবেয়ীদের যুগ ঈদে মিলাদুন্নবীর কোনো নাম গন্ধও ছিল না। তাহলে এটা ইসলামের ঈদ হয় কেমনে? এটা সওয়াবের কাজ হয় কেমনে? বাহ্যিকভাবে ভালো হলেই ভালো নয়, যদি ইসলামে সমর্থন-প্রমাণ না থাকে। যেমন- নামাজ সবচেয়ে বড় ইবাদত এবং সবোর্ত্তম ভাল কাজ। তথাপিও কেউ যদি ফজরের ফরজ দুই রাকাতের পরিবর্তে বাড়িয়ে চার রাকাত ফরজ পড়ে তবে অবশ্যই সে গুনাহগার হবে।

সাহাবায়ে কেরামের ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন তো দূরের কথা; তাদের থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম তারিখের স্পষ্ট কোন বর্ণনাই পাওয়া যায় না। ইসলামের সাথে ঈদে মিলাদুন্নবীর দূরতমও কোনো সম্পর্ক নেই। ঈদে মিলাদুন্নবীর প্রচলন হয়েছে নবী ও সাহাবাদের যুগের অনেক পরে। হিজরি সপ্তম শতাব্দীতে ক্রুসেড বিজেতা সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী কতৃক নিযুক্ত ইরাকের ‘এরবল’ এলাকার গভর্নর আবু সাইদ মুযাফ্ফর উদ্দিন কুকুবুরী সর্বপ্রথম ৬০৪ হিজরিতে ঈদে মিলাদুন্নবীর আনুষ্ঠানিক প্রচলন ঘটান। ঐতিহাসিকরা তাকেই মিলাদুন্নবির প্রকৃত উদ্ভাবক বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ তিনিই প্রথম এই উৎসবকে বৃহৎ আকারে উদযাপন শুরু করেন এবং সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই উৎসবের প্রচলন করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর ৫৯৩ বছর পরে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের নামে তারা চরম স্বেচ্ছাচারিতা শুরু করেন। গভর্নর নিজে তাতে অংশ নিতেন। এই অনুষ্ঠানের সমর্থনে এগিয়ে আসেন তখনকার তথাকথিত আলেম আবুল খাত্তাব ওমর বিন দেহিইয়াহ। তিনি এর সমর্থনে কোরআন-হাদিসের অপব্যাখ্যাসহ বহু জাল ও বানাওয়াট জমা করেন।

ইসলাম প্রবর্তনের এত বছর পরে যেই ঈদের আবিষ্কার তা ইসলামের কোন ঈদ হতে পারে না। ইসলামে কেবল ঈদ-উৎসব দুটি। হযরত আনাস বিন মালিক রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় পৌছে দেখলেন বছরে দুটি দিন মদিনাবাসীরা আনন্দ-ফুর্তি করে থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, এ দিন দুটি কিশের? তারা বলল, আমরা জাহেলি যুগে এই দুই দিন আনন্দ-ফূর্তি করতাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ্ তায়ালা তোমাদের জন্য এ দুদিনের পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দুটি দিন দিয়েছেন, তা হল ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর। (আবু দাউদ, হাদিস নং-১১৩৬) সহীহ হাদিস দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত ইসলামে ঈদ-উৎসব শুধু দুটি। এটা ইজমায়ে উম্মত দ্বারাও প্রতিষ্ঠিত। যদি কেউ ইসলামে তৃতীয় আরেকটি ঈদের প্রচলন করে তবে তা কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমাদের এ দ্বীনে নাই এমন নতুন কোন বিষয় কেউ প্রচলন করলে তা প্রত্যাখ্যাত। (বুখারি, হাদিস নং-২৬৯৭)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের জন্মদিবসকে ঈদ-উৎসবে পরিণত করার বিরোধিতা করে গেছেন। সাহাবি আবু কাতাদাহ রাযি. সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সোমবারে রোযা রাখার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি বললেন, এ দিনে আমার জন্ম হয়েছে এবং এ দিনে আমাকে নবুওয়ত দেওয়া হয়েছে বা আমার ওপর কোরআন নাযিল শুরু হয়েছে। (মুসলিম, হাদিস নং- ২৮০৪) অপর হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, একদিন ওমর (রা.) নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! সোমবার রোজা রাখেন কেন? তিনি উত্তরে বলেন, ‘সেদিন আমি জন্মেছি এবং মৃত্যুবরণ করব।’ (সহিহ ইবনে খুযায়মা) ঈদ-উৎসব নয়। নিজের জন্মদিবসে রোজা রেখেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। রোজা রেখে ঈদের বিরোধী করেছেন তিনি। কেননা, রোজা ঈদের বিপরীত। ঈদ মানে আনন্দ-উৎসব, খাওয়া দাওয়া, ফূর্তি করা। আর রোযা এসবের ব্যতিক্রম। এ কারণে ইসলামের দুই ঈদে রোযা রাখা নিষেধ, হারাম। সাহাবি আবু সাইদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত’ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন রোযা রাখতে নিষেধ করেছেন। (বুখারি, হাদিস নং-১৯৯১)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। তিনি বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ। তাঁর ওপর দুরূদ পড়া, তাঁকে শ্রদ্ধা করা, সম্মান করা, অনুসরণ করা ঈমানী দায়িত্ব। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা করেন নাই, বলেন নাই এবং ইসলামে যা নাই তা কখনোই করা যাবে না। কেননা, ইসলামের হুকুম-আহকাম সুনির্ধারিত। ইসলামে যা যেভাবে আছে; অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা করতে বলেছেন এবং যা নিষেধ করেছেন, হুবহু তাই অনুসরণ করতে হবে। বাড়ানো কমানোর কোনো সুযোগ নেই। পবিত্র কোরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, তোমাদের রাসুল যা নিয়ে এসেছেন তা আঁঁকড়ে ধরো, আর যা করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থেকো। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা। (সূরা হাশর, আয়াত ৭) সুতরাং ইসলামের নির্ধারিত দুই ঈদের সাথে নতুন করে তৃতীয় আরেকটি ঈদ উদ্ভাবন করা মারাত্মক গুনাহের কাজ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, সবচেয়ে নিকৃষ্টতম বিষয় হল (দীনের মধ্যে) নব উদ্ভাবিত বিষয়। প্রতিটি নব উদ্ভাবিত বিষয় বিদআদ ও প্রতিটি বিদআদ গোমরাহী। আর প্রত্যেক গোমরাহী জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। (নাসায়ী শরীফ, হাদিস নং-১৫৮৯)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের মধ্যে যে বেঁচে থাকবে সে বহু মতবিরোধ দেখতে পাবে। সাবধান! তোমরা নব উদ্ভাবিত বিষয় থেকে দূরে থাকবে। কেননা, তা গোমরাহী। তোমাদের মধ্যে কেউ সে যুগ পেলে সে আমার সুন্নত ও হেদায়েতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত অনুসরণ করবে। তোমরা এটাকে খুব মজবুত ভাবে আঁঁকড়ে ধরবে। (তিরমিজি, হাদিস নং-২৮৯১) তিনি আরও ইরশাদ করেন, আমার পূর্বে কোন জাতির কাছে আল্লাহ্ যে নবীকেই পাঠিয়েছেন, সে জাতির মধ্যে থেকে তাঁর সহযোগী ও সঙ্গী থাকত। তাঁর সুন্নতকে তারা আঁঁকড়ে ধরতো এবং তাঁর হুকুমের অনুসরণ করতো। তাদের পর এমন কিছু লোকের উদ্ভব হলো তারা যা বলতো নিজেরা তা করত না এবং এমন কাজ করত যা তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়নি। এ ধরনের লোকের বিরুদ্ধে যে হাত দিয়ে জিহাদ করবে সে মুমিন, যে মুখ দিয়ে জিহাদ করবে সেও মুমিন, যে অন্তত দ্বারা জিহাদ করবে সেও মুমিন। এরপর সরিষার দানা পরিমাণও ঈমানের স্তর নেই। (মুসলিম, হাদিস নং-১৮৮) ঈমানী দায়িত্ব হলো, প্রতিটি ক্ষেত্রে নবীজির সুন্নত ও হেদায়েতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত অনুসরণ করা; ঈদে মিলাদুন্নবীসহ দ্বীনের মধ্যে সকল নব আবিষ্কৃত বিষয় পরিহার করা এবং যথাসম্ভব প্রতিরোধ করা। কমপক্ষে অন্তর দিয়ে ঘৃণা হলেও করতে হবে। এটাই ঈমানের নিম্নস্তর। আল্লাহ্তায়ালা আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।

 

মুহাদ্দিস, জামিয়া শায়খ আবদুল মোমিন, ময়মনসিংহ

সহসম্পাদক, দৈনিক বাংলাদেশের খবর

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads