• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
রবিউল আউয়াল এবং রহমতের নবী (সা.)

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

রবিউল আউয়াল এবং রহমতের নবী (সা.)

  • প্রকাশিত ০৩ নভেম্বর ২০২১

চলছে রবিউল আউয়াল মাস। এ মাসটি মুসলিম বিশ্বের কাছে খুবই তাৎপর্যমণ্ডিত। প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী ১২ রবিউল আউয়ালে প্রিয়নবী দুজাহানের বাদশাহ সাইয়্যেদুল মুরসালিন খাতেমুন নাবীয়্যিন শাফিউল মুজনেবীন রহমতুল্লিল আলামিন হাবীবে খোদা হজরত মোহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন। যিনি বিশ্বনবী, আখেরী নবী। যার শুভাগমনে ধন্য সমগ্র জগৎ। আলোকিত মক্কার মরুপ্রান্তর, যার কারণে চিরভাস্বর মদিনাতুল মুনাওয়ারাহ। স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যাকে লক্ষ্য করে ইরশাদ করেছেন, সমগ্র জগদ্বাসীর জন্য আমি আপনাকে রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি। ওই আয়াত প্রমাণ করে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গোটা সৃষ্টি জগতের জন্য রহমত। আরও ইঙ্গিত বহন করে আল্লাহ জগৎসমূহের রব এবং তার প্রিয়বন্ধু হজরত মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন এ জগৎসমূহের রহমত। আল্লাহর রুবুবিয়্যাত তথা মালিকানা যে পর্যন্ত বিস্তৃত, বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়ত সে পর্যন্ত ব্যাপৃত।

মহানবী হজরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন যে বরকতপূর্ণ ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত রবিউল আউয়ালে সংঘটিত সঙ্গত কারণেই সে মাসটি উম্মতে মোহাম্মদী তথা জগদ্বাসীর কাছে সম্মানিত, তাৎপর্যমণ্ডিত ও মহিমান্বিত। এমনকি বছরের মাস সমূহের মধ্যে রবিউল আউয়াল মাসের শ্রেষ্ঠত্ব, গুরুত্ব ও মহত্ত্ব সবচেয়ে বেশি ও অতুলনীয়। আবার এ মাসের ১২ তারিখেই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাওলার ডাকে সাড়া দিয়ে এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।

প্রাক-ইসলামী যুগে যখন চরম উচ্ছৃঙ্খলতা, পাপাচার, দুরাচার, ব্যভিচার, মিথ্যা, হত্যা, লুণ্ঠন, মদ্যপান, জুয়ায় ভরপুর ছিল। অন্যায়-অপরাধ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য, নৈরাশ্য আর হাহাকার বিরাজ করছিল আইয়ামে জাহেলিয়াত যখন চলছিল ঠিক সে সময় মানবতার মুক্তির দিশারী সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ও সর্বশেষ নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা জাহানের হিদায়েতের জন্য আবির্ভূত হলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন বিশ্ব মানতার জন্য আল্লাহর এক অনন্য রহমতস্বরূপ প্রেরিত।

হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত মক্কা নগরীর কুরাইশ গোত্রের বনি হাশিম বংশে জন্মগ্রহণ করেন। হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সুবহে সাদেকের সময় জন্মগ্রহণ করেন। তার মায়ের নাম আমিনা এবং পিতার নাম আব্দুল্লাহ। শিশু বয়স থেকেই আল্লাহ তাকে কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করে নেন। জন্মের আগে পিতা, ৬ বছর বয়সে মা আমিনাকে হারান। আর ৮ বছর বয়সে তার দাদা মৃত্যুবরণ করেন। ইয়াতিম শিশু বড় হয়ে উঠে চাচার সযত্ন ভালোবাসায়।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ: সঠিক দিকনির্দেশনার জন্য মহান আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। প্রত্যেক নবী-রাসূলই তাদের উম্মতের সংশোধনের জন্য উত্তম চরিত্র প্রদর্শন করেছেন। তেমনিভাবে সার্বিক জীবনে সর্বোৎকৃষ্ট চরিত্র ও মহৎ গুণাবলি প্রতিষ্ঠার জন্যই আল্লাহতায়ালা সর্বশেষ নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্ববাসীর জন্য আদর্শ করে পাঠিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি সচ্চরিত্রের মহান আদর্শের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত।’

মহানবী হজরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জীবনে নবী-রাসূলদের যাবতীয় মহৎ গুণাবলির সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি ছিলেন ঐশী বাণী পবিত্র আল-কোরআনেরই জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। সাহাবায়ে কেরাম উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.)-কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করলে, আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘তোমরা কী কোরআন পাঠ করো না? জেনে রাখো! পুরো কোরআনই হলো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র।’ অর্থাৎ তিনি ছিলেন আল-কোরআনের বাস্তব নমুনা। (মুসনাদ আহমদ, হাদিস : ২৫৮১৩) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জীবনের সর্বক্ষেত্রে মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের বিধান বাস্তবায়ন করে উম্মতকে দেখিয়েছেন। উকবা ইবনে আমির (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে সাল্লাল্লাহু আলাইহি নবী ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তুমি তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করো। তোমার প্রতি যে জুলুম করে, তুমি তাকে ক্ষমা করে দাও। তোমাকে যে বঞ্চিত করে, তুমি তাকে প্রদান করো। (মুসনাদ আহমদ, হাদিস : ১৭২১২)

এই ছিল রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ। তিনি ছিলেন সততার মূর্তপ্রতীক। জীবনে কোনোদিন তিনি মিথ্যার আশ্রয় নেননি। প্রতি মুহূর্তে তিনি সত্যকে লালন করেছেন। পুরো পৃথিবী যখন কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল, চারদিকে জাহেলিয়াতের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল, অন্যায়-অবিচার, জুলুম নির্যাতন, শির্ক, বেদাতের কর্মকাণ্ড, বর্বরতার লু-হাওয়া যখন পৃথিবীকে ভারী করে তুলেছিল, এমন সময় তিনি দুনিয়ায় আগমন করে অমানিশার অন্ধকার দূরে ঠেলে বিশ্বভুবনে সত্যের আলো জ্বেলে দিয়েছিলেন। তাকে ‘আল-আমিন’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়ছিল। তার কাছে মানুষ তাদের মূল্যবান সম্পদ গচ্ছিত রাখত এবং নিরাপদ মনে করত।

জীবনে কোনো দিন তিনি কাউকে কটুকথা বলেননি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খারাপ লোকের সঙ্গেও উত্তম আচরণ করতেন। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবার সঙ্গেই উত্তম আচরণ করতেন। তিনি ছিলেন ক্ষমাশীল, উদার মানসিকতার অধিকারী। তিনি কষ্টের প্রতিদান দিতেন ক্ষমা দিয়ে। মক্কা বিজয়ের ইতিহাস তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যেই কাফের-মুশরিকরা প্রতি মুহূর্তে তাকে নির্যাতন করত, দুষ্ট ছেলেদের তার পেছনে লেলিয়ে দিত, যাদের অত্যাচারে নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করতে হলো, সেই কাফেরদের ওপর যখন তিনি জয়ী হলেন, কোনো ধরনের শাস্তি না দিয়ে বা প্রতিশোধ না নিয়েই তিনি সবাইকে ক্ষমা করে দেন।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দানশীল। তার কাছে কেউ কিছু চাইলে তিনি না করতেন না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো নিজের জন্য প্রতিশোধ নিতেন না। তিনি মানুষকে সৎকাজের আদেশ দিতেন আর অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিতেন। তিনি অপছন্দনীয় কথা থেকে বিরত থাকতেন। কাউকে নিরাশ করতেন না, আবার মিথ্যা প্রতিশ্রুতিও দিতেন না। তিনটি বিষয় থেকে তিনি দূরে থাকতেন। এক. ঝগড়া-বিবাদ। দুই. অহংকার করা। তিন. অযথা কথাবার্তা বলা। এই তিনটি কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন উম্মতদের। শেষনবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনই হয়েছিল বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ। তিনি সর্বদা উম্মতের কল্যাণ চিন্তায় থাকতেন। তার বর্ণিত হাদিসগুলো কেয়ামত পর্যন্ত উম্মতকে পথের দিশা দেখিয়ে যাবে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশাল হাদিসে ভান্ডার থেকে চয়ন করে উম্মতের জন্য বিশেষ কয়েকটি উপদেশ এখানে সন্নিবেশিত করা হয়েছে।

১. যদি পরিপূর্ণ ঈমানওয়ালা হতে চাও, তবে উত্তম চরিত্র অর্জন করো। ২. যদি সবচেয়ে বড় আলেম বা জ্ঞানী হতে চাও, তবে তাকওয়া (আল্লাহ ভীতি) অর্জন করো। ৩. যদি সবচেয়ে বেশি সম্মান পেতে চাও, তবে মানুষের নিকট হাত পাতা (অন্যের ওপর ভরসা করা, ভিক্ষা করা) বন্ধ করে দাও। ৪. যদি আল্লাহর নিকট বিশেষ সম্মান পেতে চাও, তবে অধিক পরিমাণে আল্লাহর জিকির করো। ৫. যদি রিজিকের প্রশস্ততা চাও, তবে সর্বদা অজুর সঙ্গে থাকার চেষ্টা করবে। ৬. যদি সমস্ত দোয়া কবুল হওয়ার আশা রাখো, তবে অবশ্যই হারাম থেকে বেঁচে থাকবে। ৭. যদি কেয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে গুনাহমুক্ত উঠতে চাও, তবে সহবাসের পর দ্রুত পবিত্র হয়ে যাবে। ৮. যদি কেয়ামতের দিন আল্লাহর নূর নিয়ে উঠতে চাও, তবে মানুষের ওপর জুলুম করা ছেড়ে দাও। ৯. যদি আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে চাও, তবে আল্লাহর ফরজ বিষয়াদির প্রতি যত্নবান হও। ১০. যদি জাহান্নামের আগুন নেভাতে চাও, তবে দুনিয়ার বিপদাপদে সবর করো। ১১. যদি আল্লাহতায়ালার রাগ বা গোস্বা থেকে বাঁচতে চাও, তবে গোপনে সদকা করো, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে চলো এবং মানুষের ওপর রাগ করা ছেড়ে দাও।

আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এসব উপদেশ মেনে চলার তওফিক দান করুন। এক কথায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদর্শ হলো তুলনাহীন। তিনি বিশ্বভুবনের অদ্বিতীয় আদর্শের অধিকারী। পুরো মানবজাতির জন্য তার আদর্শ অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। অতএব, আমাদের উচিত হবে- রসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের এই মাসকে কেন্দ্র করে আমরা বেশি বেশি করে নামাজ, কোরআন শরীফ তেলাওয়াত, দরুদ শরীফ পড়ে তার ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তার মহান আদর্শ ও সুন্নতকে আঁঁকড়িয়ে ধরে ইহকালীন ও পরকালীন অগ্রগতি ও মুক্তিলাভে সাফল্যমণ্ডিত হওয়া। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বত ও পরকালীন নাজাত আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে নসিব করুন। আল্লাহুম্মা আমিন।

লেখক : এস. এম. মাঈন উদ্দীন রুবেল

কবি ও প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads