• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

সফলতা অর্জনে শপথের ভূমিকা

  • প্রকাশিত ২৩ ডিসেম্বর ২০২১

আ. স. ম. আল আমিন

 

শপথের আরবি হলো বাইয়াত। অর্থাৎ কোনো কাজ করা বা না করার প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া। ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায়,  মুসলমানরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তিন ধরনের শপথ গ্রহণ করেছে। ১. মাতৃশপথ ২. রাজনৈতিক শপথ। ৩. চুড়ান্ত শপথ।  সকলের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, তখন মুসলমানরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে শপথ নিয়েছে এখন আমরা কার কাছ থেকে শপথ নিবো? বর্তমানে শপথ বা বাইয়াত দুইভাবে নেওয়া যায়। (১) কোন ব্যক্তির কাছ থেকে যিনি শরিয়তের সকল বিষয় জানেন  এবং মানেন। (২) কোন ইসলামী সংগঠন থেকে যা কোরআন ও সুন্নাহর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত,  মানুষ শপথ গ্রহণ দ্বরা দুটি জিনিস রক্ষার জন্য অকাতরে জীবন দিতেও দিধাবোধ করেনা, তাহলো নিজের মাতৃভূমি এবং ধর্ম। যেই কোন কাজ, সংগ্রাম, আন্দোলন  সাফল্যের জন্য শপথবদ্ধ হওয়া ছাড়া কোন বিকল্প নাই। শপথের মাধ্যমে ইসলামের সাফল্য নিম্নোক্তে তুলে ধরা হলো।

 

১. আকাবার প্রথম শপথ, যার অপর নাম মাতৃশপথ: আকাবা বলা হয় সংকীর্ণ গিরিপথকে। যা মক্কা থেকে মিনায় আসার পথে মিনার পশ্চিম পাশে একটি পাহাড়ের সংকীর্ণ গিরিপথ যা আকাবা নামে পরিচিত। (আর- রাহীকুল মাখতুম ১৮৫)   মতৃশপথ নামে নামকরণের কারণ হলো,  এই বায়য়াত শুধু ঈমান-আকীদা বিষয়ে অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়। কোন যুদ্ধ বিগ্রহের বিষয় এতে অন্তর্ভুক্ত ছিলনা। (মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ সা. ১৯১)

 

আকাবা নামক স্থানে নবুওয়তের দশম বছরে হজ্জের মওসুমে মদিনা থেকে ৬ জন ইসলাম গ্রহণ করে ছিলেন।  তারা আল্লাহর রাসুলের সাথে বায়য়াত গ্রহন করেন, যে তারা মদিনায় গিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাতের তাবলীগ করবেন। ছয় জন মিলে সিদ্ধান্ত নিলো আমাদের কওমে  বিশৃঙ্খলা বন্ধ ও ঐক্য তৈরির লক্ষ্যে মুহাম্মদের দাওয়াতের বিকল্প নাই। এই ছয় ব্যক্তিরা মদিনায় ফিরে যাওয়ার পর তারা সেখানে নতুন জাগরণ সৃষ্টি করেন। সেখানে ইসলামের দাওয়াত জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং ব্যাপক বিস্তার লাভ করতে থাকে। আনসারদের পরিবারগুলোর মধ্যে কোন পরিবারই বাদ ছিল না, সেখানে মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে আলাপ আলোচনা হয়না। নবুয়তের দ্বাদশ বছরে ১২/১৩ জন মদিনা থেকে এসে রাসুলের কাছে এই মর্মে বায়য়াত গ্রহণ করেন, যা কোরআনে উল্লেখ রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে- ‘হে নবী! ঈমানদার নারীরা যখন তোমার কাছে এসে আনুগত্যের শপথ করে যে, তারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, তাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না, জারজ সন্তানকে স্বামীর ঔরস থেকে আপন গর্ভজাত সন্তান বলে মিথ্যা দাবী করবে না এবং ভাল কাজে তোমার অবাধ্যতা করবে না, তখন তাদের আনুগত্য গ্রহণ কর এবং তাদের জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল অত্যন্ত দয়ালু।’ (আল - মুমতাহিনা - ১২) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনার এই দলটিকে কোরআন ও ইসলামের শিক্ষা দানের জন্য মুসয়াব বিন উমাইরকে নিযুক্ত করেন। তিনি এর সাথে  সেখানে তাদের নামাজের ইমামতি ও দাওয়াতী কাজও আনজাম দিতেন।

 

শপথকারীদের দাওয়াতের সাফল্য: একদিন হযরত মুসয়াব বিন উমাইর যে বাড়িতে থাকতেন সে বাড়ীর মালিক আসাদ বিন যারারা উভয়ে দাওয়াতি কাজের জন্য বের হলেন। বনু আব্দুল আশহাল ও বনু যফর গোত্রের দিকে তাদের দাওয়াত দেখে গোত্রের দুই সরদার ক্ষেপে গেলেন। কথাতো থাক দূরের কথা রেগে অবস্থা খারাপ, যেহেতু শপথকারীরা ওয়াদা করেছেন যেকোন ভাবেই রাসুলের দাওয়াত কওমে পৌঁছে দিবেন। তারাও সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, মুসয়াব বিনম্র ভাষায় বললেন, আপনি একটু  মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনুন। শুনার পর ভালো লাগলে গ্রহণ করবেন। না হয় মুখ ফিরিয়ে নিবেন, কওমের নেতা উসাইদ একটু শান্ত হলো। মুসয়াব আলোচনা শুরু করলেন এবং কোরআন পড়ে শোনালেন। তারা উসাইদকে কিছু বলার আগে তিনি ইসলাম গ্রহণের প্রতি সম্মতি প্রকাশ করলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করলেন। সাথে আমার একজন বন্ধু আছে সে এলাকার সরদার তার কথা সবাই শুনে দৌড়ে তাকে ডেকে আনলেন। ইসলামের মহান বাণী শোনালেন। কিছু বলার আগে তার বন্ধু সাদ বিন মুয়ায ইসলাম গ্রহণ করার সম্মতি প্রকাশ করেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি যখন তার গ্রামে যায় লোকেরা দূর থেকে বলতে লাগলো,  সাদের চেহারা বদলে গেছে। এসে সাদ বললেন হে আব্দুল আশহাল গোত্রের জনমন্ডলী! আমার সম্পর্কে তোমাদের মত কি? সবাই বললো, তুমি আমাদের সরদার। তোমার মতামত আমাদের মতামতের চেয়ে পরিপক্ব। সাদ বললেন,  তা হলে শুনে রাখ, তোমরা যতক্ষণ আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের উপর ঈমান না আনবে, ততক্ষণ তোমাদের নারী ও পুরুষদের সাথে কথা বলা আমার ওপর হারাম। এরপর সমগ্র গোত্রের নারী ও পুরুষেরা এক যোগে ইসলাম গ্রহণ করল। এই নেতার মাধ্যমে যখন ইসলামী আন্দোলনের শক্তি প্রভৃতি বৃদ্ধি পেল,  তখন দাওয়াতি অভিযানও জোরদার হলো এবং ঘরে ঘরে, গোত্রে গোত্রে ইসলাম ছড়িয়ে পড়লো। (মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ সা.- ১৯২)

 

২- আকাবার দ্বিতীয় শপথ: নবুওয়াতের ত্রয়োদশ বর্ষে ৬২২ ঈসায়ী সালের জুন মাসে  মদিনা থেকে ৭০ জন মুসলমান হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় আসেন। সকলের মনে ছিল অন্যরকম এক আনন্দ প্রিয়নবীর সাথে সাক্ষাৎ হবে, তারা আলাচোনা শুরু করলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে মক্কায় আর কতদিন থাকবে। যেকোন ভাবে রাসুলকে মদিনায় নিয়ে যেতে হবে। এরই প্রেক্ষিতে ১২ই জিলহজ্জ আকাবা নামক স্থান  সমাবেশের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেদিন মোট ৭৫ জন ব্যক্তি মিটিং এ অংশ নেন তাদের ভিতর ৭৩ জন পুরুষ ২জন মহিলা ছিলেন। সকলেই রাসুলের জন্য অপেক্ষা করছেন, তিনার সাথে চাচা আব্বাস রাযি. উপস্থিত হলেন। তিনি তখন ইসলাম গ্রহণ করেননি তার পরেও তিনার হিতাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। প্রথমে সমাবেশে চাচা বক্তব্য রাখেন। তিনি বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিষয় নিয়ে বক্তব্য দেন। তার পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বক্তৃতা শুরু করেন প্রথমে কোরআন তেলাওয়াত করলেন। আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি দাওয়াত দিলেন। এর পর বাইয়াত হল। উপস্থিত জনতা বলে উঠলো ইয়া রাসুলুল্লাহ আমরা কী কী বিষয় আপনার কাছে বাইয়াত করবো? তিনি বললেন নিম্নোক্ত বিষয়ের উপর।

 

১- ভালো মন্দ সকল অবস্থায় আমার কথা শুনবে এবং মানবে। ২- সচ্ছলতা অসচ্ছলতা উভয় অবস্থায়ই ধন- সম্পদ ব্যয় করবে। ৩- সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখবে। ৪- আল্লাহর পথে উঠে দাড়াবে এবং আল্লাহর আল্লাহর ব্যাপারে কারো ভয়ভীতি প্রদর্শনে পিছিয়ে যাবেনা। ৫- তোমাদের কাছে যাওয়ার পর আমাকে সাহায্য করবে এবং নিজেদের প্রান ও সন্তানদের হেফাজতের মতোই আমার হেফাজত করবে।  এতে তোমাদের জন্যে জান্নাত রয়েছে।

 

উপস্থিত প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বাইয়াতের জবাব দিলেন, আমরা আমাদের সমস্ত সহায় সম্পদ ধ্বংস এবং আমাদের গোত্রপ্রতিদের হত্যার বিনিময়ে হলেও আপনার সাহায্য সহযোগিতা অব্যাহত রাখবো বলে অঙ্গীকার করছি।  এই বায়য়াতের বিশেষ কারণে এর নাম হয়ে গেলো ‘বায়য়াতুল হারব’ বা ‘সামরিক অঙ্গীকার’। এই বায়য়াতকে ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর ও বলা হয়। বায়য়াত সম্পন্ন করার পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারো জনকে নকীব বানানোর প্রস্তাব দিলেন। তারা এই বায়য়াত নিজেদের গোত্রে বাস্তবায়ন করবে। তাঁর একথা বলার কিছুক্ষণের মধ্যে ১২ জন নকীব মনোনীত করলেন। এদের মধ্যে। ৩ জন আওস  ও ৯ জন খাযরাজ গোত্রের ছিলেন। এখান থেকে মদিনাকে কল্যানকর ও সুখী সমৃদ্ধি রাষ্ট্র পরিণতি করার দৃঢ় সংকল্প শুরু হয়। (মানবতার বন্ধু রাসুল সা. - ১৯৪)

 

৩- চূড়ান্ত শপথ ও বিজয়ের লক্ষণ:

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ষষ্ঠ হিজরত ১৪০০ সাহাবি নিয়ে হজ করার উদ্দেশে রওনা হয়ে, হুদায়বিয়ায় পৌঁছে উসমান (রা)-কে কাফেরদের নিকট প্রেরণ করেন এ বার্তা দিয়ে যে, তুমি তাদেরকে বলবে এবছর আমি শুধু ওমরা করে চলে যাব যুদ্ধবিগ্রহ করবো না। আর দুর্বল মনা মুসলমানদেরকে বলে দিও যে, ইনশাআল্লাহ অচিরেই মক্কা বিজয় হবে। উসমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু তিনি তার বিশ্বস্ত ব্যক্তি আবান ইবনে সাঈদ এর মাধ্যমে মক্কায় প্রবেশ করেন। তিনি যখন কাফেরদেরকে একথা জানালেন যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বছর শুধু ওমরা করে চলে যাবেন যুদ্ধবিগ্রহ করবেন না তখন তারা একবাক্যে সকলে না বলে দিল। আর তারা বলল তুমি চাইলে ওমরা করতে পারো কিন্তু উসমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা উত্তর দিলো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ছাড়া কখনোই আমি ওমরা করব না।

অতঃপর তারা তাকে আটকে রাখলো আর এদিকে গুজব ছড়িয়ে গেল যে তারা উসমান রাযি.-কে হত্যা করে ফেলেছে এ সংবাদ যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কর্ণকুহরে পৌঁছে ছিল তখন তিনি অনেক কষ্ট পান এবং সকল সাহাবিদেরকে নিয়ে বাবলা গাছের নিচে বায়াত গ্রহণ করেন যে, ওসমানের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া পর্যন্ত আমরা লড়াই চালিয়েই যাব। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসমান (রা)-এর হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য, বাবলা গাছের নিচে বসে সাহাবিদের থেকে যে জিহাদের বায়আত গ্রহণ করেছিলেন। তাকেই বায়আতে রিদওয়ান বলা হয়।

যেহেতু এই বায়াতের উপর আল্লাহ তা’আলা তাঁর সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন

এজন্য তাকে বায়আতে রিদওয়ান বলে। এই বায়আতটি এই বাণীর ওপর হয়েছিল যে, যতক্ষণ পর্যন্ত দেহে প্রাণ থাকবে তখন পর্যন্ত কাফেরদের সাথে আমরা লড়াই করেই যাবো। এই বায়য়াতের কথা শুনে মক্কার কোরাইশদের অন্তরে ভয় তৈরি হয়। এই শপথের মাধ্যমে স্বপ্নের মক্কা বিজয় অনেকটায় সহজ হয়।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, মাহাদুল ইকতিসাদ ওয়াল ফিকহীল ইসলামী, ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads