• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

ইসলামে পুত্রবধূর অধিকার (দুই)

  • প্রকাশিত ০৪ জানুয়ারি ২০২২

তানভীর সিরাজ

 

(পূর্ব প্রকাশের পর)

পারিবারিক জীবনে প্রচলিত ভুলে স্ত্রীর অধিকার : ইসলামি আইন পুত্রবধূকে সম্পূর্ণভাবে এই অধিকার দিয়েছে যে, সে চাইলে তার স্বামীকে তাগিদ দিতে পারে আলাদা ব্যবস্থা করার। আর ইসলামী আইননুসারে তার স্বামীর ওপর আবশ্যক যে, সে তার সেই প্রাপ্য অনিভার্যভাবে আদায় করবে। অন্যদিকে আমাদের সমাজে ধারণা করা হয় সেই পুত্রবধূ সবচেয়ে ভালো, যে তার শ্বশুরালয়ে নিজের আরাম-শান্তি, ইজ্জত-সম্মান সবকিছু কোরবান করে দিতে পারবে। এটি ইসলামী শিক্ষা এবং দীক্ষা নয়। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও।’ (সুরা রুম, আয়াত-২১) সুতরাং স্ত্রী হলো স্বামীর অন্তরের প্রশান্তি ও আনন্দলাভের জান্নাতি পাথেয়। রান্নাবান্না ও খাবার প্রস্তুত করার দায়িত্বও তার কাঁধে নয়। বরং স্বামী তার সাধ্যানুযায়ী এসব আঞ্জাম দিতে হবে। স্ত্রীর জন্য পৃথক বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে অন্তত তাকে মূল ঘরের একটি কামরা সম্পূর্ণরূপে আলাদা করে দেবে, যেন তাতে সে যে কোনো প্রয়োজন পূর্ণ স্বাধীনতার সাথে পূরণ করতে পারে। নিজের যাবতীয় জিনিসপত্র নিরাপত্তার সাথে রাখতে পারে এবং স্বামীর সাথে স্বাধীনতার সাথে মেলা-মেশা, ওঠা-বসা ও কথাবার্তা বলতে পারে। এমন একটি আলাদা কামরা দেওয়া স্বামীর ওপর আবশ্যক। যা ইসলামী আইনে ওয়াজিব। অতি অবশ্যই পালনীয়। (কোরআন-হাদিসের আলোকে পারিবারিক জীবন, হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী, পৃ-২২)

 

একটু সহনশীল হোন : বিধানদাতা বা আল্লাহপাক বড়ই সুন্দর বলেছেন, ‘তোমরা জমিনবাসীর ওপর রহম করবে তো আসমানের অধিবাসীরাও তোমাদের প্রতি দয়া অনুগ্রহ করবে।’ গণমাধ্যমে শাশুড়িকতৃক পুত্রবধূর নির্যাতনের কান্নার ভেসে আসা হাজারো আওয়াজ। স্বামীসহ স্ত্রীকে মানসিক ট্রল করে যৌতুকের লোভে, কখনো শাশুড়ি পুত্রবধূর বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে যখন একটু উনিশ-বিশ হয়। এমনকি এক পত্রিকায় চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল যেখানে মনোকষ্টমাখা ভাষায় লিখেছে পুত্রবধূ ‘আমি পাইলসের রোগে আক্রান্ত ছিলাম, তাই টয়লেটে সময় বেশি ব্যয় হতো বলে শাশুড়ি আম্মা আমাকে বলতেন, মেয়েটি বুড়ি হয়ে গেছে।’ আমরা যদি ভাবি তাহলে খুব সহজেই বোঝবো যে, নিজের মেয়ে হলে আরো বেশি সময় অতিবাহিত করলে বলতো, মেয়ে আমার খুব অসুস্থ। অসুন্দর কিছুই বলতো না। তবে এখানে অসহ্য হওয়ার কারণ হলো, পুত্রবধূ পরের মেয়ে। আবার দেখুন পুত্রবধূ একটু গরিবের মেয়ে হলে আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গেলে নিয়ে যায় না তাকে; বরং তাকে ঘরেই রেখে যায়। আবার যদি সে ধনী ছেলের বউ হয় তখন ঠিকই নিয়ে যায় স্বাদরে। তাতে মোটেই লজ্জা হয় না, ভুলও হয় না। গরিব ছেলের বউ পরিবারে এভাবে নিয়মিত অপমানিত হয়। এই সম্পদই আজ সম্মান ও অসম্মানের কারণ। সে যদি খুব যত্নশীল, চরিত্রবান মেয়েও হয় তবুও তার অপরাধের সীমা থাকে না। আবার যদি সে একটু জ্ঞানী, পড়াশোনা আছে-এমন মেয়ে হয় তাহলে সে একটু জ্ঞানগর্ব কিছু বললে তখন বউ হয়ে যায় অহংকারী, আরো কতকিছু। মধ্যবিত্ত পরিবারে নারী জাতি আজ বড়ই অসহায়।

 

সন্দেহ ও ভুল বুঝাবুঝি : প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে সমস্যার মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো কানাঘুষা। ঠিক একইভাবে প্রায় পরিবারে সমস্যার সূচনা হয় এই কানাঘুষা থেকেই। ছোট বয়সেও আমরা শুনেছিলাম দেয়ালেরও কান আছে। আসলে দেয়ালের পিঠে যখন মানবীয় কান ঠেকে তখনই দেয়ালের কান গজায়, আর তখনই যা ঘটার ঘটে। এই জন্য বিশ্বমানবতার শান্তির দূত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই উঁকিঝুঁকি থেকে সম্পূর্ণ নিষেধ করেছেন। কারণ এখান থেকেই সমস্ত সমস্যা জন্ম নেয়। ধরুন, আপনি সস্ত্রীক রাত্রিযাপন করছেন এমন সময় সারা দিনের সব দুঃখ-সুখের গল্পে মেতে উঠেছেন এখন তৃতীয় ব্যক্তি কিছু শুনে না শুনে সকাল জাগতেই পরিবারের অন্য সদস্যদের বলতে শুরু করলো-তারা স্বামী স্ত্রী এমন এমন কথা বলেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। মোদ্দাকথা, আংশিক শুনে বর্ণনা শুরু করেছে! সেই থেকেই ঝগড়া না হওয়া পর্যন্ত এই ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটে না। যে কারণে কিছুদিন পর পর ঝগড়া লেগেই থাকে প্রায় যৌথপরিবারে।

 

সবকথায় সাড়া না দেওয়া : পরিবার এমন একটি সংগঠন যেখানে দশমুখের দশকথা দশরকম। তাই সবকথার দ্রুত প্রতিউত্তর না দিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে সবার মন রক্ষা হয়-এমন সমাধান খুঁজে বের করা। স্ত্রী বলে সারা দিন কাজ করি। আর মা ও বোন বলে, আমাদের বাসায় এমন কি আর কাজ আছে যে, সারা দিন কাজ করতে হবে? বাবা প্রথমে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলেও একসময় অবশ্য মা ও বোনের সাথে অভিন্ন মত পোষণ করেন। এটি বেশ স্বাভাবিক। অভিন্ন হওয়ার একটি বড় মিল হলো তারা সবাই একই পরিবারভুক্ত। এখন আপনি স্বামী হিসাবে আপনি কী উত্তর দিবেন? একদিকে মা-বাবা অন্যদিকে স্ত্রী। মা-বাবার সাথে বেয়াদবি করা যাবে না। আর দাম্পত্যজীবনের অন্যতম আকর্ষণ হলো স্ত্রী-প্রেম। আবার এই প্রেমময় আচরণ না থাকা আর না দেখানো স্বামীর অযোগ্যতা প্রমাণের প্রথম কারণ। অথচ স্বামীর ওপর আবশ্যক ছিল, স্ত্রীর জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা। তাও করে না, আবার তার মনোরঞ্জমেরও চেষ্টা করবে না তা কী করে হয়!

 

স্ত্রী শুধু সেক্স নিবারণের যন্ত্র নয় : স্ত্রী শুধু সেক্স নিবারণের যন্ত্র নয়; বরং স্ত্রীর কাছে স্বামীর যেমন ভালোবাসা পাওয়ার উপযুক্ত অধিকার আছে তেমনি স্ত্রীরও পূর্ণ অধিকার আছে। বলা যায় আরো বেশি। কারণ স্ত্রী তার মা-বাবা, ভাইবোন-সহ পরিবারের সবাইকে ছেড়ে স্বামীর মহব্বত ও স্বামীর দিকে তাকিয়ে চলে এসেছে আর স্বামী যদি তার প্রতি ভালোবাসা না দেখায় তাহলে পাষাণ প্রাণী বলে পরিগণিত হবে। তাই স্বামী হিসাবে আপনাকে এমন উত্তর নির্বাচন করতে হবে যে প্রতিউত্তর সবার মন জয় করে এবং মনোরঞ্জক হয়।

 

অধৈর্য না হওয়া : পারিবারিক জীবনে অধৈর্য না হওয়া। কারণ দাম্পত্যজীবনের অন্যরকম সৌন্দর্য হলো উত্থান ও পতন। যখন পারিবারিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে থাকে তখন কালো সাদাতে প্রশংসিত হয়। আর কষ্টের মুখ দেখলেই বলে দেয় মেয়েটি অনাস্তিয়া, বা কুলক্ষ্মী!

 

পারিবারিক জীবনে সম্পদ মায়া-মহব্বত বাড়িয়ে দেয়। বয়োজ্যেষ্ঠ এক ভুক্তভোগী বলেছেন, যখন নামমাত্র টাকা-পয়সা আয় করি, তখন আমার স্ত্রীকে অনেক লাঞ্ছিত হতে হতো। দীর্ঘদিন পরে বাসায় গিয়েও অপমানের কারণে স্ত্রী অভিমান করে কাছেও আসতো না। তখন অতৃপ্ত, ব্যথিত ও দীর্ঘদিনের ক্ষুধার্ত চাহিদা নিয়ে আবারো ফিরে আসতে হতো কর্মস্থলে। আমার অন্য ভাইয়েরাও খুব একটা সচ্ছল নয়। অথচ আমার আয় করা সব ইনকাম মাকে দিতাম। আমার ছেলেরাও ভালো খেতে পারতো না। আর এদিকে অন্য ভাইয়ের বউয়েরা মায়ের সাথে তালমিলিয়ে চলার কারণে তারা খুব ভালো, প্রশংসিত। ইত্যাদি, ইত্যাদি।

 

সামাজিকভাবে অমিল : কুফু না মিলা। কুফু বা সমতা না হলে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই বিভিন্ন পেরেশানির শিকার হয়। এই সমতা একাধিক প্রকার। বংশগত সমতা ও অর্থনৈতিক সমতা। অর্থনৈতিক সমতাকেই আজকাল বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। বংশগত সূত্রে যদি উভয়ের মাঝে অনেক তফাৎ হয় তখন এক পক্ষের কথা, মনের ভাব আর সম্বোধন অন্য পক্ষ বুঝে না। যদি অর্থনৈতিক সমতা না থাকে তা হলে তো কথাই নাই। যে পক্ষ তুলনামূলক অর্থবিত্তে সমৃদ্ধশালী নয়, তারা যতই ভালো হোক না কেনো, আর যতই পরহেজগার হোক না কেনো তাদের তেমন একটা গুরুত্ব থাকে না সম্পদশালী আত্মীয়দের কাছে। যেকারণে স্বামী-স্ত্রীর মাঝেও মধুর মিলনে অভিভাবকদের কান ভারি করায় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে মনমালিন্য সৃষ্টি হয়। তাই বিয়ের আগে কুফুর কথা মাথায় রেখে ছেলেমেয়ের বিয়ে নিয়ে ভাবা উচিৎ। অন্যথায় দিন ফুরাতেই দুঃশ্চিন্তার বোঝা বহন করতে কচিকাচা ছেলেমেয়েদের।

 

আসল কথায় ফিরে আসি। বলে ছিলাম আচার-আচরণ বিষয়ে। বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত বিশ্ব নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘প্রকৃত মুমিন সেই, যার হাত ও মুখ থেকে অপর মুসলমান (নর-নারী) নিরাপদ থাকে।’ তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিৎ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার আগেই আমাদের আচরণে কষ্ট পাওয়া মানুষগুলোকে খুঁজে বের করা এবং তাদের কাছে ক্ষমা চাওয়া। অর্ধ জাহানের বাদশাহ হযরত উমর রা. খোদ বায়তুল্লাহকে সম্বোধন করে বলেছেন, ‘হে, বায়তুল্লাহ, তোমার ইজ্জত আর সম্মান অনেক বেশি সত্য, তবে তোমার চেয়েও অধিক সম্মানি ইজ্জতের বিষয় হলো একজন মুমিন নরনারীর জান এবং মাল।’

সবশেষে বলবো, ইসলাম অনুযায়ী পরিবার সাজাতে হবে। বিয়ে করে স্ত্রীর জন্য আলাদা ব্যবস্থা করো। আর মা-বাবারও উচিত হলো, ছেলেকে বিয়ে করিয়ে হাসিমুখে ছেলে-পুত্রবধূর জন্য আলাদা ব্যবস্থার জন্য গুরুত্ব দেওয়া। আবার আলাদা হয়ে মা-বাবার হক আদায়ে এক বিন্দুও যেন গাফলতি না হয়, সেদিকেও শতভাগ খেয়াল রাখতে হবে ছেলেকে। আল্লাহ আমাদের সহিহ বুঝ দান করুন। আমিন।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads