• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

প্রতিনিধি দলের সাথে বিশ্বনবী (সা.) এর আচরণ

  • প্রকাশিত ৩১ জানুয়ারি ২০২২

আ.স.ম আল আমিন

 

পৃথিবীতে বিভিন্ন ধর্ম ও নানান রকমের মানুষ বাস করে। সকলেই চায় সমাজে শান্তিতে বসবাস করতে। ব্যক্তিগত,  পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক,  অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় জীবনে বিভিন্ন কারণে একে অপরের সাথে কোন না কোন বিষয়ে অমিল থাকে। ক্ষমতা ও বংশীয় অহংকারে কেউ কারো কাছে ছোট হতে চায় না। বর্তমানের ন্যায় ইসলামের প্রথমযুগেও এমনটি ছিল; বরং সে সময় আরো বেশি ছিল। তখন সমাধানের জন্য  বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে প্রতিনিধি পাঠিয়ে নিজেদের  ভুল বুঝাবুঝির সমাধান করা হতো। দলীয়, বংশীয় এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে প্রতিনিধির রিপোর্টকে সবাই গুরুত্ব দিত। ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায়, বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধি দল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে এসে নিজেদের ভুল বুঝতে পারে এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উত্তম আচরণ দেখে গোত্রের সবাই ইসলামের পতাকাতলে শামিল হন। তার কিছু উদাহারণ নিম্নোক্ত তুলে ধরা হলো।

 

প্রতিনিধি দলকে কিছু হাদিয়া দেওয়া : মদিনায় প্রথম আগমনকারী  প্রতিনিধি  দল মুযাইনা গোত্র। তা অনেক বড় একটি  গোত্র। কুরাইশদের সাথে তাদের বংশধারা কিছুটা  মিল রয়েছে। প্রখ্যাত সাহাবি নুমান বিন মুকরিন এই গোত্রেরই লোক। হিজরি ৫ম বছর এই গোত্রের প্রায় চারশ লোক রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাজির হয় এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। মদিনা থেকে ফেরার সময় তাদেরকে পাথেয় হিসেবে প্রচুর খেজুর দেওয়া হয়।

 

প্রতিনিধি দল অফিস রুলের বরখেলাপ করলেও তাদের সাথে ভালো আচরণ করা : বনু তামীম গোত্রের লোকেরা ইসলামের প্রথম যুগে  বড় বড় নেতা আকরা বিন হাবেস, যাবারকান, আমর ইবনুল আহতাম, নঈম বিন ইয়াযীদ এবং উয়াইনা বিন হিসন ফাযারীস রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে আসে। এই দলের আগমনে মদিনায় উৎসবের আমেজ তৈরি হয় এবং চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। তারা মসজিদে প্রবেশের সময় অনেকটা অমার্জিতভাবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কক্ষের কাছে গিয়ে চিৎকার করে ডাকছিল- ‘ও  মোহাম্মদ,  মোহাম্মদ! বাইরে এস।’ এই ঘটনা উপলক্ষে সুরা হুজরাত নাজিল হয় এবং মুসলমানদের ভদ্র ও মার্জিত আচরণ শিক্ষা দেওয়া হয়। তারা যদিও ইসলাম গ্রহণের মনোভাব নিয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, কিন্তু আরবীয় আভিজাত্যবোধে তাদের স্বভাবে তখনো অক্ষুণ্ন ছিল। তারা অভিলাষ প্রকাশ করলো যে, উভয়পক্ষের বাগ্মী ও কবিদের মধ্যে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হোক। আসলে আরবের অভিজাতশ্রেণির গোত্রগুলোর স্বভাবই এ রকম ছিল যে, বুদ্ধি, মেধা ও প্রতিভার দিক দিয়ে কাউকে নিজের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর না দেখে তার নেতৃত্ব তারা মেনে নিতে পারতো না। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেধার প্রতিযোগিতার এই মঙ্গলজনক প্রস্তাব মেনে নিলেন।

 

বনু তামীম গোত্রের নামকরা বক্তা ছিল আতারিদ বিন হাজের। সে নিজ গোত্রের শ্রেষ্ঠত্ব, মর্যাদা, ধনবল ও জনবল ইত্যাদির প্রশংসা করে এক মনোজ্ঞ ভাষণ দিল। ভাষণের শেষে বললো, ‘যারা আমাদের সমকক্ষ হবার দাবিদার, তারা এ ধরনের যোগ্যতা ও প্রতিভার পরিচয় তুলে ধরুক।’ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইংগিতে ইসলামী আন্দোলনের এক বক্তা ছাবেত বিন কায়েস পাল্টা ভাষণ দিতে উঠলেন। তিনি এক উদ্দীপনাময় ভাষণে ইসলামী আন্দোলনের গুণগত শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরে তার দাওয়াতের দিকটাকে জোরদার করে প্রকাশ করলেন এবং এটাকেই ইসলামী সমাজের গৌরবের প্রধান উৎস বলে অভিহিত করলেন।

 

এরপর বনু তামীমের খ্যাতনামা কবি যাবারকান বিন বদর একটা কবিতা আবৃত্তি করলো। তার একটা বাক্য হলো।

‘আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ। কেউ আমাদের সমকক্ষ নয়। আমাদের মধ্যে রাজা রয়েছে। আমরা উপাসনালয় নির্মাণ করি।’ এ সময় ইসলামী আন্দোলনের বিপ্লবী কবি হাসসান বিন ছাবিত ‍উপস্থিত ছিলেন না। তাঁকে ডেকে আনা হলো। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘ওঠো হাসসান, এই কবির কবিতার জবাব দাও।’ জবাবে হাসসান যে কবিতা পাঠ করলেন তা ইবনে হিশাম উদ্ধৃত করেছেন। প্রতিনিধিদল স্বীকার করলো, তাদের বক্তা ও কবির চেয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবিতা ও বক্তা শ্রেষ্ঠ। অতপর সমগ্র দল ইসলাম গ্রহণ করলো।

 

প্রতিনিধি দলের দাম্ভিকতাকে ঠান্ডা মাথায় জওয়াব দেওয়া : কুরাইশদের সামরিক তৎপরতায় সহযোগী ছিল বনু আসাদ গোত্র। ৯ম হিজরিতে এই গোত্রের প্রতিনিধি দল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে নিজেদের ইসলাম গ্রহণের কথা জানায়। তবে এই জানানোর ভঙ্গিতে আরবদের স্বভাবগত দাম্ভিকতার কিছু রেশ ছিল। তারা খানিকটা কৃতিত্ব প্রদর্শনের ভঙ্গিতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললো ‘আপনি তো কোনো প্রচারক দল আমাদের কাছে পাঠাননি। আমরা নিজ থেকেই ইসলাম গ্রহণ করেছি।’ এই মনোভাব রদ করার জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জওয়াব দিলেন ‘নিজেদের ইসলাম গ্রহণকে একটা অনুগ্রহ হিসেবে আমার কাছে পেশ করো না; বরং এটা আল্লাহরই অনুগ্রহ যে, তিনি তোমাদেরকে ইসলামের পথে চালিত করেছেন।’

 

এরপর তারা জাহেলি যুগের বিভিন্ন রীতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সকল প্রশ্নের উত্তর দিলেন। সব শেষে তারা জানতে চায়, চিঠি লেখা জায়েয কিনা? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটা তো কোনো একজন নবীই চালু করেছেন। এর চেয়ে ভালো বিদ্যা আর কি হতে পারে। হজরত আবু বকর সিদ্দিকের খেলাফত আমলে এই গোত্রের তালহা বিন খুয়াইলিদ নামক এক ব্যক্তি মিথ্যা নবুয়তের দাবি তুলেছিল।

 

সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য প্রতিনিধি দলকে পথ খরচ দেওয়া : বাল্লী গোত্র ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ বসতি। তারা নবম হিজরির রবিউল আউয়াল মাসে এই গোত্রের প্রতিনিধিরা তাদের নেতা রুয়াইফি বিন ছাবেতের সাথে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। তারা তিন দিন মদিনায় অবস্থান করেন। অতপর রওনা দেওয়ার সময় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের খেজুর ও পথ খরচ দেন। তাছাড়া বনু সাদ হুযাইম গোত্রের কয়েক ব্যক্তি একটি প্রতিনিধি দল আকারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশে হজরত বিলাল (রা.) এই দলকে পথখরচ হিসেবে কিছু অর্থ উপহার দেন। তাদের ফিরে যাওয়ার পর সমগ্র গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে এবং ইয়ামান অঞ্চলের বাহরা গোত্রের তেরো ব্যক্তির একটি প্রতিনিধি  দল মদিনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করে। কয়েকদিন অবস্থান করে ইসলামের বিধান সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জনের পর তারা ফিরে যায়। তাঁদেরকেও রীতি মোতাবেক পথখরচ দেওয়া হয়।

 

আত্মীয়তার সম্মানে প্রতিনিধি দলের দাবি গ্রহণ করা : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তায়েফ থেকে ফেরার সময় বনু হাওয়াযিন গোত্রের বন্দি ও গনিমত মালের সমাধানের জন্য ১০ দিন অপেক্ষা করলেন। তার পর তাদের একটি প্রতিনিধি দল মুসলমান হয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাজির হন। তারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আকুতি মিনতি করে বলেন, আপনার অনেক আত্মীয়স্বজন আমাদেরই গোত্রের লোক। এমনকি আপনার দুধমাতাও এ গোত্রের লোক ছিলেন। তাই আমরা আপনার কাছে আমাদের বন্দিদের মুক্তি ও  গনিমতের মাল ফেরত চাচ্ছি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে বললেন, আমি তো অনেক সময় ধরে তোমাদের অপেক্ষা করছিলাম। তোমাদের দেরি হওয়ার কারণে গনিমতের মাল বণ্টন করে দিয়েছি। এখন তা আর ফেরত নেওয়া সম্ভব নয়। তোমাদের জন্য এখন অপশন দুটি হয়তো বন্দিদের মুক্তি, না হয় গনিমতের মাল। এখন তোমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারো। তাদের প্রতিনিধি দল বন্দিদের  মুক্তিকে বেছে নিয়েছে। কোন বর্ণনায় রয়েছে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গনিমতের মালের নিজের অংশ তাদেরকে ফেরত দিয়ে দেন।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, মাহাদুল ইকতিসাদ ওয়াল ফিকহীল ইসলামী, ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads