• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

বিশ্ব ভালোবাসা দিবস : ইসলামী দৃষ্টিকোণ

  • অনলাইন ডেস্ক
  • প্রকাশিত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২

মাহফুজুর রহমান হোসাইনী

 

১৪ ফেব্রুয়ারি। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিছুসংখ্যক তরুণ-তরুণী অবাধ মিলামেশায় মশগুল হয়ে পড়ে। ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। একে অপরের জন্য নিজের ভালোবাসার দুয়ার উন্মুক্ত করে দেয়। একজন আরেকজনের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। তাদের ভাষ্যানুযায়ী বিশ্বব্যাপী ভালোবাসার দিন এটি। যে যতো পারো ভালোবাসা দাও, ভালোবাসা নাও। সবকিছু উজাড় করে নিজেকে অপরের জন্য বিলিয়ে দাও। এভাবেই পালন হয়ে থাকে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এসবের প্রতি লক্ষ করলে সহজেই বোধগম্য হয় যে, দিবসটি উপলক্ষে তারা কি ভালোবাসার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছে, নাকি ভালোবাসাকে কলংকিত করছে?

 

ভালোবাসা মানে মনের টান। যাতে কোনোই খাদ থাকবে না। ভালোবাসা নিঃস্বার্থ। এতে কোনো স্বার্থপরতার আভাস থাকবে না। ইসলামে ভালোবাসার গুরুত্ব অপরিসীম। ভালোবাসা ঈমানের প্রতীক। একে অপরের প্রতি ভালোবাসা থাকা মুমিন মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষণ না তোমরা মুমিন হবে, আর তোমরা মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরে একে অপরকে ভালোবাসবে। আমি কি তোমাদেরকে এমন বিষয়ের কথা বলবো না, যা করলে তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি হবে? সাহাবিগণ আরজ করলেন, নিশ্চয়, ইয়া রাসুলাল্লাহ! (তিনি বললেন) তোমাদের মাঝে প্রচুর পরিমাণে সালামের প্রচলন করো।’ (মুসলিম, হাদিস নং-২০৩) সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, ‘তিনটি গুণ যার মধ্যে থাকে সে ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করতে পায়।

১. আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুল তার নিকট অন্য সবকিছু থেকে অধিক প্রিয় হওয়া। ২. একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই কাউকে ভালোবাসা।

৩. কুফুরিতে প্রত্যাবর্তন করাকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ন্যায় অপছন্দ করা।’ (বুখারি, হাদিস নং-১৬)

 

ভালোবাসা আল্লাহর দান। যার প্রতিই ভালোবাসা হোক না কেন, তা অবশ্যই শরিয়ত সমর্থিত হতে হবে। আর ভালোবাসার উদ্দেশ্য হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। কেবল আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশে কেউ যদি কাউকে ভালোবাসে তবেই সে প্রশান্তি লাভ করবে। আর আখেরাতে থাকবে তার জন্য মহাপুরস্কার। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে এমন কিছু মানুষ রয়েছে যারা নবীও নয় শহিদও নয়। কিয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে তাদের সম্মানজনক অবস্থান দেখে নবী এবং শহিদগণও ঈর্ষা করবে। সাহাবিগণ বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমাদেরকে বলুন, তারা কারা? তিনি বলেন, তারা ওই সব লোক, যারা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই একে অপরকে ভালোবাসে। অথচ তাদের মধ্যে কোনো রক্তের সম্পর্কও নেই এবং কোনো অর্থনৈতিক লেনদেনও নেই। আল্লাহর শপথ! নিশ্চয় তাদের চেহারা হবে নুরানি এবং তারা নুরের মধ্যে থাকবে। সেদিন তাদের কোনো ভয় থাকবে না, যেদিন মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত থাকবে এবং সেদিন তাদের কোনো চিন্তা থাকবে না, যেদিন মানুষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস নং-৩৫২৯)

 

ভালোবাসা পবিত্র। ভালোবাসা সম্পূর্ণই আল্লাহপ্রদত্ত। তাই প্রকৃত ভালোবাসা হওয়া চাই আল্লাহর জন্যই। দুনিয়াতে কোনো মানুষকে ভালোবাসলে তার ভালোবাসা পাওয়ার গ্যারান্টি নেই। নিশ্চিত প্রতিদানের আশা করাও যায় না। যে কোনো সময় ধোঁকার সম্ভাবনা রয়েছে। মানুষের মন মুহূর্তেই রং বদলায়। কিন্তু আল্লাহ দিয়েছেন ভালোবাসার গ্যারান্টি। আল্লাহকে ভালোবাসলে; নিশ্চিত আল্লাহও তোমাকে ভালোবাসবেন এবং প্রতিদানও দেবেন। মহাপ্রতিদান। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(হে নবী) আপনি বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তবে আমাকে অনুসরণ করো। আল্লাহও তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদেরকে তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-৩১)

 

আল্লাহতায়ালা প্রতিটি মানুষের অন্তরেই ভালোবাসা দান করেছেন। নারী-পুরুষের মাঝে দিয়েছেন এক অন্যরকম ভালোবাসার বন্ধন। নারী-পুরুষের মুহাব্বত-আকর্ষণ এটা আমাদের প্রতি আল্লাহতায়ালার অন্যরকম অনুগ্রহ-রহমত। পবিত্র কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে-‘আল্লাহর কুদরতের মধ্যে অন্যতম একটি নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকে তোমাদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাকো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও অনুগ্রহ সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে।’ (সুরা আর রুম, আয়াত-২১) সুতরাং আল্লাহর বিধান অনুযায়ীই নারী-পুরুষের এই আকর্ষণ কাজে লাগাতে হবে। অবৈধভাবে এই আকর্ষণের অপব্যবহার করে ভালোবাসাকে অপবিত্র করার অধিকার কারো নেই। বিবাহবহির্ভূত নারী-পুরুষের ভালোবাসা কখনো পবিত্র হতে পারে না। এটা ভালোবাসার নামে নষ্টামি। সামাজিক বিশৃঙ্খলা। ইসলামে এই ভালোবাসার ঠাঁই নেই। মস্ত বড় অপরাধ এটা।

 

স্বামী-স্ত্রীর সুমধুর সম্পর্কই হলো সত্যিকার অর্থে ভালোবাসা। আল্লাহতায়ালা নারী-পুরুষের মধ্যকার যেই রোমাঞ্চকর ভালোবাসা দান করেছেন সেই ভালোবাসার প্রকৃত ও আসল রূপই হলো স্বামী-স্ত্রীর প্রেম-ভালোবাসা। এই ভালোবাসার গভীরতা ও তৃপ্তি যেমন রয়েছে, তেমনি আল্লাহর কাছেও রয়েছে এর যথাযথ পুরস্কার। স্ত্রীর সাথে আনন্দচিত্তে কথা বলা, তাকে নিয়ে ফূর্তি করা, হাসি-ঠাট্টা করা, দুষ্টুমি করা, আনন্দ-উল্লাস করা, রোমাঞ্চ করা, মজা করা, এমনকী স্ত্রীকে খাইয়ে দিলেও আল্লাহর কাছে এর প্রতিদান রয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তুমি আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশ্যে যা-ই ব্যয় কর না কেন, তোমাকে তার প্রতিদান নিশ্চিতরূপে প্রদান করা হবে। এমনকী তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে যা তুলে দাও, তারও প্রতিদান দেওয়া হবে।’ (বুখারি, হাদিস নং-৫৬)

 

ইসলামেই রয়েছে ভালোবাসার যথাযথ মূল্যায়ন। স্ত্রীর সাথে ভালোবাসা করে তৃপ্তিও পাওয়া গেল, আবার আল্লাহ সওয়াবও দিলেন। শুধু তাই নয়, স্ত্রীর সাথে সহবাস করে নিজের খাহেশাত পুরা করলেও আল্লাহ সাদকার সাওয়াব দেন। হজরত আবু জার (রা.) থেকে বর্ণিত, কয়েকজন সাহাবি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! ধনীরা তো বেশি নেকির অধিকারী হয়ে গেল। তারা নামাজ পড়ছে যেমন আমরা নামাজ পড়ছি। তারা রোজা রাখছে যেমন আমরা রাখছি এবং (আমাদের চেয়ে তারা অতিরিক্ত এই কাজ করছে) নিজেদের প্রয়োজন-অতিরিক্ত মাল থেকে তারা সদকা করছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহ কি তোমাদের জন্য সাদকা করার মতো জিনিস দান করেননি? নিঃসন্দেহে প্রতিটি তাসবিহ সাদকা, প্রতিটি তাকবির সাদকা, প্রতিটি তাহলিল সাদকা, ভালো কাজের আদেশ করা সাদকা ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করা সাদকা এবং স্ত্রী মিলন করাও সাদকা। সাহাবিগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! কেউ যদি স্ত্রী মিলন করে নিজের যৌনক্ষুধা নিবারণ করে, এতেও কি সে সাওয়াব পাবে? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা কি মনে কর, যদি কেউ অবৈধভাবে যৌন মিলন করে, তবে কি তার পাপ হবে? অনুরূপভাবে যদি সে বৈধভাবে স্ত্রী মিলন করে নিজের কামক্ষুধা নিবারণ করে, তবে সে সাওয়াব পাবে।’ (মুসলিম, হাদিস নং-২৩৭৬)

ইসলামে রয়েছে ভালোবাসার যথাযথ মর্যাদা। রয়েছে বৈধ ব্যবস্থা, বৈধ সম্পর্ক। কিন্তু আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের নামে নারী-পুরুষকে অবৈধ যৌন সম্পর্কের প্রতি উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। ভালোবাসাকে ব্যভিচারে পরিণত করা হচ্ছে। যুবক-যুবতীরা অবৈধভাবে মিলামেশা করা। তাদের নোংরামি জনসম্মুখে প্রকাশ করছে। মা-বোনেরা বেপর্দাভাবে বেহায়ার মতো অর্ধ-উলঙ্গ হয়ে রাস্তায়-পার্কে ঘুরাফেরা করছে। এগুলো অনেক বড় অন্যায়। গোনাহের কাজ। হারাম ও নিষিদ্ধ। সামাজিকভাবেও এগুলো গর্হিত কাজ। কোনো মুসলমান, সুস্থ সমাজ কখনই এগুলো সমর্থন করতে পারে না। এই দিবসের দোহাই দিয়ে যারা ভালোবাসাকে কলংকিত করছে, পবিত্র সমাজকে অপবিত্র করছে, সমাজের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে; তাদের প্রতিরোধ করা ঈমানী ও সামাজিক দায়িত্ব। এই জঘন্য দিবসকে সামাজিকভাবে বয়কট করা সময়ের দাবি। যারা এই নোংরা দিবস উদ্যাপন করে সমাজ ও মুসলিম ঈমানদারদের মাঝে নোংরামি ছড়াচ্ছে তাদেরকে আল্লাহতায়ালা কঠিন হুঁশিয়ারি করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় যারা ঈমানদারদের মধ্যে ব্যভিচার-অশ্লীলতা প্রসার করতে চায়, তাদের জন্যে ইহকাল ও পরকালে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না।’ (সুরা নুর, আয়াত-১৯)

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া শায়খ আবদুল মোমিন, ময়মনসিংহ

বিভাগীয় সম্পাদক, দৈনিক বাংলাদেশের খবর

mahfuuz51@gmail.com

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads