খানকার পরিচয় : পবিত্র কোরআনুল কারিমে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন, তিনি তাদের মধ্য থেকে এমন একজন রাসুল প্রেরণ করেছেন; যে তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত (সুন্নাহ) শিক্ষা দেয়। যদিও তারা পূর্বে সুস্পষ্ট গোমরাহিতে ছিল। (সুরা আলে-ইমরান, আয়াত-১৬৪) উক্ত আয়াতে মহান রাব্বুল আলামিন শেষ নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৌলিক দায়িত্ব বর্ণনা করেছেন। নবীজির মৌলিক দায়িত্ব চারটি। ১. কোরআন তেলাওয়াত। ২. পরিশুদ্ধ তথা আত্মশুদ্ধি করা। ৩. কোরআনের ইলম শিক্ষা দেওয়া। ৪. সুন্নাহ শিক্ষা দেওয়া।
দীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এই চার বিষয়ের শিক্ষা দেওয়া হয় খুব গুরুত্বসহকারে। যথাসম্ভব পর্যবেক্ষণও করা হয়ে থাকে। তবে এর মধ্যে আত্মশুদ্ধির ব্যপারটা একটু ব্যতিক্রম। আত্মশুদ্ধির মানে হলো, সকল প্রকার গোনাহ থেকে নিজেকে পবিত্র করা এবং আল্লাহর হুকুমের সামনে নিজেকে পরিপূর্ণ সমর্পণ করা। দরসি বা একাডেমিক পদ্ধতিতে আত্মশুদ্ধির সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভবপর হয়ে উঠে না। মিথ্যা বলা যাবে না, অন্যায়-খারাপ কাজ করা যাবে না, সুন্নাহ মোতাবেক চলতে হবে; এগুলোর নির্দেশ দেওয়া বা নসিহত করা আত্মশুদ্ধির অন্তর্ভুক্ত। ওয়াজ মাহফিল, মসজিদ-মাদরাসা ও বিভিন্ন বয়ানে এসব নসিয়ত করা হয়ে থাকে। এতসবের পরও দেখা যায়, গোনাহ ছাড়ছি না। সঠিক পথে চলছি না। মিথ্যা বলা, জিনা করা, অশ্লীল কাজ করা বা দেখা, গালি দেওয়া; এগুলো খারাপ জেনেও প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছি। এমনিভাবে- নামাজ পড়া ফরজ, পর্দা করা ফরজ এবং অন্যান্য ভালো কাজ জেনেও করছি না। এককথায় খারাপকে খারাপ জেনেও ছাড়তে পারছি না এবং ভালোকে ভালো জেনেও ঠিকমতো করছি না।
নবীযুগে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) নিজেদের ভেতরগত বিভিন্ন সমস্যা সরাসরি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে পেশ করতেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমাধান করতেন। হাতে কলমে তাদেরকে পরিশুদ্ধ করতেন। তারপর থেকে যুগে যুগে ওলামায়ে কেরাম নবুয়তি দায়িত্বকে সামনে রেখে খানকার ব্যবস্থা করেছেন। যেখানে মানুষ নির্দ্বিধায় মনের হালত পেশ করে। গোনাহের প্রতি আকৃষ্ট এবং নেক কাজে অনীহার বিস্তারিত হালত বর্ণনা করে। ওলামায়ে কেরাম কোরআন-হাদিসের ভিত্তিতে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করেন এবং সরাসরি আমলের মশক করিয়ে দেন। ফলে গোনাহ ছেড়ে সুন্নাহ মোতাবেক জীবন গড়া সহজতর হয়। আল্লামা শায়েখে ইমামবাড়ি (রহ.) যথার্থই বলেছেন। তিনি বলেন, ‘জাগতিক শিক্ষার স্থান হলো স্কুল, ধর্মীয় শিক্ষার স্থান হলো মাদরাসা আর মশকের মাধ্যমে আমল শিক্ষার স্থান হলো খানকা।’
‘খানকা’ ফার্সি শব্দ। অর্থ বৈঠকখানা, অলিগণের আবাসস্থল, উপসনাস্থল, ইত্যাদি। প্রচলিত অর্থে আল্লাহওয়ালাদের সম্মিলিত সাধনার স্থানকে ‘খানকা’ বলে। এ স্থানে আধ্যাত্মিক তথা আল্লাহপ্রাপ্তির বিষয়ে বাস্তব শিক্ষা দেওয়া হয়। খানকার শিক্ষাপদ্ধতির অবলম্বনের মাধ্যমে মানুষের আধ্যাত্মিক পরিবর্তন ও আত্মশুদ্ধি হয়ে থাকে। খানকার মাধ্যমে ওলামা ও সত্যবাদীদের সান্নিধ্যলাভের সুযোগ হয়। পবিত্র কোরআনুল কারিমে আল্লাহতায়ালা বলেন- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সঙ্গ (সহবত) লাভ করো।’ (সুরা-আত তাওবা, আয়াত-১১৯)
খানকায়ে হোসাইনিয়ার প্রতিষ্ঠা ও কার্যক্রম : ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সিপাহসালার সাইয়েদ হোসাইন আহমদ মাদানি (রহ.)-এর সুযোগ্য খলিফা শায়খ আবদুল মোমিন (রহ.)-এর নির্দেশনায় এবং মুফতি মাহবুবুল্লাহর তত্ত্বাবধায়নে ময়মনসিংহের মধ্য বাড়েরায় ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘খানকায়ে হোসাইনিয়া মাদানিয়া’। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আত্মশুদ্ধির কার্যক্রম এগিয়ে চলছে গুরুত্বের সাথে। দৈনন্দিক আমল, সাপ্তাহিক শবগুজারি, মাসিক শবগুজারি, ত্রৈমাসিক জোর, বাৎসরিক ইসলাহি মাহফিলসহ বিভিন্ন আত্মশুদ্ধিমূলক আমলি মশক চালু রয়েছে।
খানকায়ে হোসাইনিয়ার অন্যান্য কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে-অমুসলিমদের মাঝে দাওয়াতি কার্যক্রম, খানকা কর্তৃক পরিচালিত ছেলেদের জন্য ‘জামিয়া শায়খ আবদুল মোমিন (রহ.)’ এবং মেয়েদের জন্য ‘জামিয়া হাফসা (রা.)’ দীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জনসাধারণের জন্য কোরআন তেলাওয়াত ও জরুরি মাসায়েল শিক্ষাদান, দেশের শিক্ষাবঞ্চিত প্রত্যন্ত অঞ্চলে মকতব-মাদরাসা ও স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করা, নওমুসলিমদের দীন শিক্ষা দেওয়া, দাওয়াত ও তাবলিগে পাঠানোর ব্যবস্থা করা, দুর্দশাগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, অসহায় ছাত্র-ছাত্রীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান, শিক্ষা-উপকরণ বিতরণ, চিকিৎসা খরচ প্রদান, বই-পুস্তক প্রকাশ ও লেখালেখির মাধ্যমে দীন প্রচার, বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা এবং রক্তদান কর্মসূচিসহ আরো বিভিন্ন কার্যক্রম।
রমজানে খানকায়ে হোসাইনিয়ার আমল :
চলছে মাহে রমজান। পবিত্র মাস। আমলের মাস। গোনাহ মাফের মাস। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘ওই ব্যক্তির নাক ধুলোধূসরিত হোক, যে রমজান পেল এবং তার গুনাহ মাফ করার আগেই তা বিদায় নিল।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস নং-৩৫৪৫) রমজান মাস পেয়েও যে গোনাহ মুক্ত হতে পারল না, তার চেয়ে হতভাগা আর কেউ নেই। গোনাহ মুক্ত হতে হবে এবং গোনাহ থেকে বাঁচতে হবে পরিপূর্ণভাবে। গোনাহ থেকে বাঁচা বা তাকওয়া অর্জন করাই হলো রমজানের প্রধান শিক্ষা। ইরশাদ হয়েছে ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত- ১৮৩)
বছরের এক মাসব্যাপী সিয়াম পালনের উদ্দেশ্য নিছক উপবাস থাকা নয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া অর্জন করা। ফলে সমাজজীবনে মানুষ যাবতীয় অন্যায় ও অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকতে পারে এবং সৎ কাজ করার জন্য অগ্রসর হতে পারে। রোজার মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে খানকায়ে হোসাইনিয়াতে প্রতিবছর রমজানের পূর্ব থেকেই বিশেষ আমলি মশকের ব্যবস্থা করা হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে জমায়েত হয়। খানকার দায়িত্বশীলদের একজন মুফতি কামরুল ইসলাম জানান, এ বছর প্রায় আড়াইশ লোক রমজানের পূর্ব থেকেই খানকাতে অবস্থান করছেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, সিলেট, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, কুড়িগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সালেকিন ভায়েরা রমজানের পূর্বেই এসেছেন। রমজানের শেষ দশকের ইতেকাফ করতে আরো অনেকে আসবেন। প্রতি বছর প্রায় চরশ লোক খানকা মসজিদে ইতেকাফ করেন।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের আশায় রমজানে তারাবির নামাজ আদায় করে তার পূর্ববর্তী সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’ (বুখারি ও মুসলিম) গোনাহ মাফের আশা নিয়ে খানকায়ে হোসাইনিয়াতে তারাবি নামাজের যথাযথ হক আদায় করার চেষ্টা করা হয়। প্রতিদিন ধীরস্থিরতার সাথে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় ধরে তারাবির নামাজ আদায় করা হয়। তারাবি শেষে রাত সাড়ে ১২ টার পর প্রায় ঘণ্টাব্যাপী বয়ান হয়। এ সময় সাধারণত খানকার মুতাওয়াল্লি মুফতি মাহবুবুল্লাহ খুব দরদের সাথে আত্মশুদ্ধির দিক নির্দেশনা প্রদান করেন।
এরপর সাহরি খাওয়ার আগ পর্যন্ত ইনফেরাদি তাহাজ্জুদ, দোয়া ও জিকিরের আমল হয়। খানকায়ে হোসাইনিয়াতে রাতের পুরো সময়টাই নামাজ, তেলাওয়াত, দোয়া জিকির-আজকারের মাধ্যমেই অতিবাহিত করা হয়। রমজান শুরু হলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দীর্ঘ এক মাসের তারাবি, তাহাজ্জুদ, কোরআন তিলাওয়াত ও অন্যান্য নেক আমলের মধ্যদিয়ে কাটাতেন পবিত্র এই মাসটি। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে ঈমানি অবস্থায় এবং নিজেকে যাচাই-বাছাই করে রাতে উঠে ইবাদত করে সে তার গুনাহসমূহ থেকে এভাবে পবিত্র হয়ে যায় যেভাবে সেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল।’ (সুনানে নিসায়ী, কিতাবুস সওম)
রমজান মাসে খানকায়ে হোসাইনিয়া জীবন্ত আমলের এক মারকাজে পরিণত হয়। দিনের বেলাতেও বিভিন্ন নেক আমলের নেজাম রয়েছে। সাধারণ সাথী ভাইদের জন্য কোরআন শিক্ষা, সুন্নতের তালিম, ইস্তিগফারের আমল, দোয়া-দুরুদ নিত্যদিনের রুটিন। সারা দিনের একটি মুহূর্তও যেন অযথা নষ্ট না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা হয়। ইফতারের পূর্বে দোয়ার বিশেষ আমল হয়। ইফতারের আগে ইফতার সামনে নিয়ে তাসবিহ-তাহলিল ও তাওবা-ইসতেগফার আল্লাহর কাছে অনেক পছন্দনীয়। ইফতারের সময় আল্লাহ বান্দার সব চাওয়াগুলোই পূরণ করে দেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘ইফতারের সময় রোজাদারের জন্য এমন একটি দোয়া রয়েছে যা ফিরিয়ে দেওয়া হয় না।” (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-১৭৫৩; তাবরানি, হাদিস নং-১২২৯-১২৩০/২; বায়হাকী, হাদিস নং-৩৯০৫) অন্যত্র রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া কখনো ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। যখন রোজাদার ব্যক্তি ইফতার করে, ন্যায়পরায়ণ শাসক ও নির্যাতিত ব্যক্তির দোয়া।’ (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিজি)
লেখক : মাহফুজ হোসাইনী
মুহাদ্দিস, জামিয়া শায়খ আবদুল মোমিন (রহ.), ময়মনসিংহ
বিভাগীয় সম্পাদক, দৈনিক বাংলাদেশের খবর
mahfuuz51@gmail.com