জাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। এটি ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার মূলভিত্তি। জাকাত আদায় করা হলে মানুষের ধন-সম্পদ থেকে গরিবের হক আদায় হয়। ফলে তা হালাল ও পবিত্র হয়। আবার জাকাতের মাধ্যমে শ্রেণিবৈষম্য দূর হয়, সমাজে দারিদ্র্যের হার কমতে থাকে এবং সচ্ছল মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সে হিসেবেই জাকাত অর্থ বৃদ্ধি করা।
ইসলাম একমাত্র আল্লাহর মনোনীত জীবন বিধান। এটি বিশ্ব মানবতার মহান মুক্তির সনদ। মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, স্বাংস্কৃতিক, অর্থনেতিক, ধর্মীয় ও আন্তর্জাতিক; তথা সার্বিক জীবনের সকল সমস্যার সমাধান রয়েছে কোরআনুল কারীমে। এ শাশ্বত জীবন বিধান মানব সমাজে দ্যুাতি ছড়িয়ে পথ-পদর্শন করেছে যুগ যুগান্তরে। এর পরশে আলোকিত হয়েছে বর্বর জাহিলি সমাজ। ঘন ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত জাতি পরিণত হয়েছে গোটা বিশ্বের অনুকরণীয় আদর্শে। সে কালজ্বয়ী আদর্শ, শাশ্বত জীবন বিধান ইসলাম পাঁচটি মূলভিতিত্তির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত। ১. ঈমান বা বিশ্বাস ২.সালাত বা নামাজ ৩. সাওম বা রোজা ৪. হজ ও ৫. জাকাত। আজকের আলোচ্য বিষয় হলো-ইসলামের পাঁচটি মূলভিত্তির পঞ্চম ভিত্তি জাকাত।
জাকাত মানে পরিশুদ্ধকর। প্রত্যকে স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক মুসলমান নর-নারীকে প্রতি বছর স্বীয আয় ও সম্পত্তির একটি নির্দিষ্ট অংশ, ইসলামী শরীয়ত নির্ধারিত সীমা (নিসাব পরিমাণ) অতিক্রম করে তবে তা গরিব-দুঃস্থদরে মধ্যে বিতরণের নিয়মকে জাকাত বলা হয়। সাধারণত নির্ধারিত সীমার অধিক সম্পত্তি হিজরি ১ বছর ধরে থাকলে মোট সম্পত্তির ২.৫ শতাংশ (২.৫%) বা ১/৪০ অংশ বিতরণ করতে হয়। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে হজ এবং জাকাত শুধুমাত্র শর্তসাপক্ষে সম্পদশালীদের জন্য ফরজ।
জাকাতের নিসাব : ক. সোনা ৭.৫ তোলা=৯৫.৭৪৮ গ্রাম (প্রায়)। খ. রুপা ৫২.৫ তোলা=৬৭০.২৪ গ্রাম (প্রায়)। (আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/৩৯৪; আল ফিকহুল ইসলামী : ২/৬৬৯)
দেশি-বিদেশি মুদ্রা ও ব্যবসায়িক পণ্যের নিসাব নির্ধারণে সোনা-রুপা হলো পরিমাপক। এ ক্ষেত্রে ফকির-মিসকিনদের জন্য যেটি বেশি লাভজনক হবে, সেটিকে পরিমাপক হিসেবে গ্রহণ করাই শরীয়তের নির্দেশ। তাই মুদ্রা ও পণ্যের বেলায় বর্তমানে রুপার নিসাবই পরিমাপক হিসেবে গণ্য হবে। যার কাছে সাড়ে ৫২ তোলা সমমূল্যের দেশি-বিদেশি মুদ্রা বা ব্যবসায়িক পণ্য মজুত থাকবে, তার ওপর জাকাত ওয়াজিব হবে। যে সম্পদের ওপর জাকাত ফরজ, তার ৪০ ভাগের এক ভাগ (২.৫০ শতাংশ) জাকাত দেওয়া ফরজ। সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করে শতকরা আড়াই টাকা বা হাজারে ২৫ টাকা হারে নগদ অর্থ কিংবা ওই পরিমাণ টাকার কাপড়চোপড় বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে দিলেও জাকাত আদায় হবে। (আবু দাউদ, হাদিস : ১৫৭২; সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৬২৩)
জাকাতের শর্তসমূহ : স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক মুসলিম নর-নারীর কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে কতিপয় শর্তসাপক্ষে তার ওপর জাকাত ফরজ হয়ে থাকে। নিম্নে শর্তসমূহের আলোচনা করা হলো।
সম্পদের ওপর পূর্ণ মালিকানা : সম্পদের ওপর জাকাত ওয়াজিব হওয়ার জন্য সম্পদের মালকািনা সুনির্দিষ্ট হওয়া আবশ্যক। অর্থাৎ সম্পদ, মালিকের অধিকারে থাকা, সম্পদের ওপর অন্যের অধিকার বা মালিকানা না থাকা এবং নিজের ইচ্ছামতো সম্পদ ভোগ ও ব্যবহার করার পূর্ণ অধিকার থাকা। যে সকল সম্পদের মালিকানা সুস্পষ্ট নয়, সেসকল সম্পদের কোনো জাকাত নেই। যেমন- সরকারি মালিকানাধীন সম্পদ। অনুরূপভাবে জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য ওয়াকফকৃত সম্পদের উপরে জাকাত ধার্য হবে না। তবে ওয়াকফ যদি কোনো ব্যক্তি বা গোত্ররে জন্য হয়, তবে তার ওপর জাকাত দিতে হবে।
সম্পদ উৎপাদনক্ষম হওয়া : জাকাতের জন্য সম্পদকে অবশ্যই উৎপাদনক্ষম, প্রবৃদ্ধিশীল হতে হবে, অর্থাৎ সম্পদ বৃদ্ধি পাবার যোগ্যতাই যথেষ্ট। যেমন- গরু, মহিষ, ব্যবসার মাল, নগদ অর্থ ব্যবসায়িক উদ্দশ্যেক্রীত যন্ত্রপাতি ইত্যাদি মালামাল বর্ধনশীল অর্থাৎ যেসকল মালামাল নিজের প্রবৃদ্ধি সাধনে সক্ষম নয়, সে সবের ওপর জাকাত ধার্য হবে না। যেমন- ব্যক্তিগত ব্যবহারের মালামাল, চলাচলের বাহন ইত্যাদি।
মৌলিক প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ থাকা : সারা বছররে মৌলিক প্রয়োজন মটিয়ে যে সম্পদ উদ্ধৃত থাকবে, শুধুমাত্র তার ওপরই জাকাত ফরজ হবে। আল-কোরআনে উল্লেখ রয়েছে- লোকজন আপনার নিকট (নবীজির নিকট) জানতে চায়, তারা আল্লাহর পথে কী ব্যয় করবে? বলুন, যা প্রয়োজনের অতিরিক্ত। আল্লাহ এভাবেই তোমাদের জন্য সুস্পষ্ট বিধান বলে দেন। মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন- ‘অতিরিক্ত বলতে পরিবারের ব্যয় বহনের পর যা অতিরিক্ত বা অবশষ্টি থাকে তাকে বুঝায়।’ ইউসুফ আল-কারযাভীর মতে স্ত্রী, পুত্র, পরিজন ও পিতা-মাতা এবং নিকটাত্মীয়দের ভরণ-পোষণও মৌলিক প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত।
ঋণ মুক্ততা : নিসাব পরিমাণ সম্পদ হলেও ব্যক্তির ঋণমুক্ততা জাকাত ওয়াজিব হওয়ার অন্যতম শর্ত। যদি সম্পদের মালিক এত পরিমাণ ঋণগ্রস্ত হন, যা নিসাব পরিমাণ সম্পদও মিটাতে অক্ষম বা নিসাব পরিমাণ সম্পদ তার চেয়ে কম হয়, তবে তার ওপর জাকাত ফরজ হবে না। ঋণ পরিশোধের পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলেই কেবল জাকাত ওয়াজিব হয়। তবে এক্ষেতে দ্বিতীয় মতটি হলো : যে ঋণ কিস্তিতে পরিশোধ করতে হয় সে ঋণের ক্ষেতে যে বছর যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করতে হয়, সে বছর সে পরিমাণ ঋণ বাদ দিয়ে বাকিটুকুর ওপর জাকাত দিতে হয়। কিন্তু ঋণ বাবদ জাকাত অব্যাহতি নেওয়ার পর অবশ্যই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। অন্যথায় সে সম্পদরে ওপর জাকাত দিতে হবে।
সম্পদ এক বছর আয়াত্তাধীন থাকা : নিসাব পরিমাণ স্বীয় সম্পদ ১ বছর নিজ আয়াত্তাধীন থাকা জাকাত ওয়াজিব হওয়ার পূর্বশর্ত। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানির ক্ষেতে বছর শেষে বর্ণিত সম্পদ ও দায়-দেনা অনুসারে জাকাতের পরিমাণ নির্ধারিত হবে।
অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও পাগলের জাকাত : সম্পদের মালিক অপ্রাপ্তবয়স্ক কিংবা পাগল হলে, তার জাকাত তার আইনানুগ অভিভাবককে আদায় করতে হবে।
যৌথ মালিকানাধীন সম্পত্তির জাকাত : কোনো সম্পদে যৌথ মালিকানা থাকলে সম্পদের প্রত্যেক অংশীদার তাঁর নিজ নিজ অংশের ওপরে জাকাত দিবেন, যদি তা নিসাব পরিমাণ হয় বা তার অতিরিক্ত হয়। অর্থাৎ সম্পদের স্বীয় অংশের মূল্য অন্যান্য সম্পদের সঙ্গে যোগ করে হিসাব করে যদি দেখা যায় তা নিসাব পরিমাণ হয়েছে বা অতিক্রম করেছে তবে জাকাত দিতে হবে।
নির্ধারিত জাকাত : জাকাত নির্ধারিত হওয়া সত্ত্বেও যে পরিশোধের আগেই সম্পদের মালিকের মৃত্যু হলে তার উত্তরাধীকারগণ অথবা তার তত্ত্বাবধায়ক তার সম্পত্তি থেকে প্রথমে জাকাত বাবদ পাওনা ও কোনো ঋণ থাকলে তা পরিশোধ করবনে। এরপর অবশিষ্ট সম্পত্তি, উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টিত হবে।
তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে ন্যস্ত সম্পদের জাকাত : মালিকের পক্ষ থেকে নিয়োগকৃত আইনানুগ তত্ত্বাবধায়কের কাছে সম্পত্তি ন্যস্ত থাকলে মালিকের পক্ষে উক্ত তত্ত্বাবধায়ক সে জাকাত পরিশোধ করবেন।
বিদেশস্থ সম্পদের জাকাত : জাকাত ওয়াজিব হওয়ার জন্য সম্পত্তি নিজ দেশে থাকা শর্ত নয়। বরং সম্পত্তি অন্য দেশে থাকলেও তার ওপর জাকাত দিতে হবে।
জাকাত বণ্টনের খাতসমূহ: পবিত্র কোরআনে সুরা তাওবায় জাকাত বণ্টনে আটটি খাত আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করছেন। এই খাতগুলো সরাসরি কোরআন দ্বারা নির্দিষ্ট। আর যেহেতু তা আল্লাহর নির্দেশ, তাই এর বাইরে জাকাত বণ্টন করলে জাকাত ইসলামী শরীয়ত সম্মত হবে না। কোরআনে বর্ণিত খাতগুলো নিম্নরূপ।
১. ফকির। যার কিছুই নেই। ২. মিসকিন। যার নেসাব পরিমাণ সম্পদ নেই। ৩. জাকাত আদায়ে নিযুক্ত র্কমচারী। যার অন্য জীবিকা নেই। ৪. অমুসলিমদের মন জয় করার জন্য। ৫. ক্রীতদাস (মুক্তির উদ্দেশে)। ৬. ঋণদার ব্যক্তি। ৭. আল্লাহর পথে জিহাদে রত ব্যক্তি। ৮. মুসাফির। যিনি ভ্রমণকালে অভাবে পতিত।
জাকাত হিসাবের নিয়ম : প্রত্যেক মুসলমানকে তার যাবতীয় আয়-ব্যয়-সম্পদের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব সংরক্ষণ করতে হয়। হিসাব সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বাৎসরিক ভিত্তি একটি মৌলিক ধারণা। অর্থাৎ বছরে একটা নির্দিষ্ট দিন থেকে পরবর্তী বছরে একটি নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত যাবতীয় আয়-ব্যয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব রাখতে হয়। দিন বাছাই করার ক্ষতে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই যে, অমুক মাসে দিন নির্ধারণ করতে হবে। সাধারণত কেউ কেউ হিসাব সংরক্ষণের সুবিধার্থে হিজরি বছরে প্রথম মাস মহররমের কোনো দিন কিংবা অধিক পূণ্যের আশায় রমজান মাসের কোনো দিন বাছাই করে থাকেন। এই হিসাব সংরক্ষণ হতে হবে যথেষ্ট সূক্ষ্মতার সঙ্গে। সংরক্ষিত হিসাবের প্রেক্ষিতে ইসলাম ধর্মের নিমানুযায়ী নিসাব পরিমাণ সম্পদ হলে তবেই ওই ব্যক্তির ওপর জাকাত দেওয়া বাধ্যতামূলক (ফরজ) হয়। অন্যথায় জাকাত দিতে হয় না।
লেখক : ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
drmazed96@gmail.com