• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
২৫ বছর ধরে অন্যের ঘরে বসবাস

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

আজ বিশ্ব রক্তদাতা দিবস

রক্তদান অত্যন্ত সওয়াবের কাজ

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ১৪ জুন ২০২২

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

আজ ১৪ জুন, মঙ্গলবার। বিশ্ব রক্তদাতা দিবস ২০২২। যারা স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদান করে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচাচ্ছেন তাদেরসহ সাধারণ জনগণকে রক্তদানে উৎসাহিত করাই এ দিবসের উদ্দেশ্য। ১৯৯৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিক রক্তদান দিবস পালন এবং ২০০০ সালে ‘নিরাপদ রক্ত’ এই থিম নিয়ে পালিত বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০০৪ সালে প্রথম পালিত হয় বিশ্ব রক্তদান দিবস। ২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য অধিবেশনের পর থেকে প্রতিবছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ দিবস পালনের জন্য তাগিদ দিয়ে আসছে। ইতিমধ্যে ১৮২ টি দেশ সম্পৃক্ত হয়েছে এ আন্দোলনে। বাংলাদেশেও অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পালন করা হয়। আবহমানকাল ধরে মানবদেহের জন্য রক্তদান এবং রক্ত গ্রহণের ব্যবহার চলছে। রক্তদান ধর্মীয় দিক থেকেও অত্যন্ত পুণ্য বা সওয়াবের কাজ। এটি এমন একটি দান যার তাৎপর্য সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘একজন মানুষের জীবন রক্ষা করা সমগ্র মানবজাতির জীবন রক্ষা করার মতো মহান কাজ।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত-৩২)

নিঃসন্দেহে রক্তদান একটি বড় ইবাদত। আর ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষের মহামূল্যবান জীবন ও দেহ সুরক্ষায় রক্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য তরল উপাদান। যেকোনো দুর্ঘটনায় শরীর থেকে রক্ত ঝরে গেলে দেহের অভ্যন্তরে অন্ত্র বা অন্য কোনো অঙ্গ থেকে রক্তক্ষরণ হলে অস্ত্রোপচারের জন্য রক্তের খুব প্রয়োজন। প্রসবজনিত অপারেশনের সময় বা বড় ধরনের দুর্ঘটনার মতো নাজুক অবস্থায় রক্ত দেওয়া অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়ে। মানবদেহে রক্তশূন্যতার জন্য রক্ত গ্রহণের যেমন বিকল্প নেই, তেমনি রক্তের চাহিদা পূরণের জন্য রক্ত বিক্রয় বৈধ নয়। তবে বিনামূল্যে রক্ত না পেলে রোগীর জন্য রক্ত ক্রয় করা বৈধ, কিন্তু এতে বিক্রেতা গুনাহগার হবে।

মানবতার কল্যাণে এটি একটি বিশেষ ও উত্তম উদ্যোগ। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিষয়টি জানা তাই সব মানুষের জরুরি। বিশেষ করে যে ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংস্থা এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে তাদের জন্যে। এ নিবন্ধে ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো। রক্ত মানুষের শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। কিন্তু মানুষে মানুষে কতো তফাৎ! কেউ রক্ত দেয়। আবার কেউ রক্ত নেয়। কেউ কেউ তো এমনো আছে, যারা রক্ত বইয়ে দিয়ে নিষ্ঠুর জিঘাংসায় লিপ্ত হয়। খুন-পিয়াসী ‘খুনিয়া’ হয়ে ওঠে। মানবতার গায়ে এঁকে দেয় কলংক-চিহ্ন। কিন্তু এ রক্তই অন্যজন ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও মানবতার অমর চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মুমূর্ষু ভাইয়ের জন্য আনন্দচিত্তে ও অকাতরে বিলিয়ে দেয়। শুধু সওয়াব-পুণ্যের আশায়; আর একটুখানি হাসির ঝিলিক দেখতে।

রক্ত সাধারণত শরীর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর নাপাক হিসেবে সাব্যস্ত হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় (প্রয়োজন ও কারণ ছাড়া) এক জনের রক্ত অন্যের শরীরে স্থানান্তর করা নিষিদ্ধ। তাই রক্ত গ্রহণের বিকল্প নেই, এমন অসুস্থ ব্যক্তিকে রক্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে নিম্নের বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে।

এক. যখন কোনো অসুস্থ ব্যক্তির জীবননাশের আশংকা দেখা দেয় এবং অভিজ্ঞ ডাক্তারের মতে তার শরীরে অন্যের রক্ত দেওয়া ব্যতীত বাঁচানোর কোনো পন্থা না থাকে, তখন রক্ত দিতে কোনো অসুবিধা নেই; বরং এ ক্ষেত্রে ইসলাম আরো উৎসাহ দিয়েছে। দুই. রক্ত দেওয়া প্রয়োজন। অর্থাৎ, অসুস্থ ব্যক্তির মৃত্যুর আশংকা নেই বটে, কিন্তু রক্ত দেওয়া ছাড়া তার জীবনের ঝুঁকি বাড়ে অথবা রোগমুক্তি বিলম্বিত হয়; এমন অবস্থায় রক্ত দেওয়া জায়েজ ও জরুরি। তিন. যখন রোগীর শরীরে রক্ত দেওয়ার খুব বেশি প্রয়োজন দেখা দেয় না, বরং রক্ত না দেওয়ার অবকাশ থাকে; তখন অযথা রক্ত দেওয়া থেকে বিরত থাকা চাই। চার. যখন জীবননাশের এবং অসুস্থতা বিলম্বিত হওয়ার আশংকা থাকে না, বরং শুধুমাত্র শক্তি বৃদ্ধি এবং সৌন্দর্য বর্ধনের উদ্দেশ্য হয়; সে অবস্থায় ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক রক্তদান জায়েজ নয়।

রক্ত ক্রয়-বিক্রয়ের বিধান : রক্ত বিক্রি জায়েজ নয়। কিন্তু যে শর্তের ভিত্তিতে রক্ত নেওয়া জায়েজ সাব্যস্ত হয়েছে, ওই অবস্থায় যদি যথা রক্ত বিনামূল্যে পাওয়া না যায়, তখন তার জন্য মূল্যে দিয়ে রক্ত ক্রয় করা জায়েজ। তবে যে রক্ত দিবে তার জন্য রক্তের মূল্য নেওয়া জায়েজ নয়। (জাওয়াহিরুল ফিকহ, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৩৮)

অমুসলিমের রক্ত মুসলিমের শরীরে স্থানান্তরের বিধান : অমুসলিমের রক্ত মুসলিমের শরীরে স্থানান্তর জায়েজ। মুসলিম আর অমুসলিমের রক্তে কোনো প্রভেদ নেই। কিন্তু শরিয়তসিদ্ধ কথা হলো, কাফের-ফাসেকের স্বভাবে মন্দ ও নিন্দনীয় প্রভাব রয়েছে। কারণ তারা নাপাক ও হারাম খাদ্য গ্রহণের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। আর এতে করে খাবারের প্রভাব রক্ত-মাংসে পড়ে। তাই সে ক্ষেত্রে অমুসলিমের মন্দ স্বভাব-চরিত্রের প্রভাব মুসলিমের স্বভাব-চরিত্রে রক্তের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হওয়ার বেশ আশংকা থেকে যায়। এজন্য শিশুর জন্য পাপাচারী মহিলার দুধ পান করা মাকরুহ করা হয়েছে। সুতরাং এসব ক্ষতির দিকে লক্ষ করে, অমুসলিমের রক্ত নেওয়া থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকা উচিত। (জাওয়াহিরুল ফিকহ, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৪০)

স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে রক্তদানের বিধান : স্বামীর রক্ত স্ত্রীর শরীরে, স্ত্রীর রক্ত স্বামীর শরীরে প্রবেশ করানো জায়েজ। তারা একে-অপরের জন্য অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের মতো। তারা একে-অন্যকে রক্ত দিলে বিয়ের ওপর কোনো প্রভাব পড়ে না। বৈবাহিক সম্পর্কও যথারীতি বহাল থাকে। (জাওয়াহিরুল ফিকহ, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৪০)

রক্তদানের ইতিহাস : ১৪৯২ সালে অষ্টম পোপ যখন স্ট্রোক করেন তখনকার চিকিৎসকরা ধারণা করেছিলেন, পোপের মনে হয় শরীরের কোথাও রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এই ভেবে পোপকে বাঁচানোর জন্য ১০ বছর বয়সের তিনজন ছেলের শরীর থেকে রক্ত বের করে পোপকে পান করানো হয়েছিল। যেহেতু তখন রক্তনালি বলে কিছু আছে, সেটাই জানা ছিল না। তাই সবাই ভাবত রক্ত খেলেই সেটা শরীরে ঢুকে পড়বে। মাত্র একটা স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে সেই তিন বাচ্চার রক্ত নেওয়া হয়েছিল। দুঃখজনক হলো, রক্ত নেওয়ার ফলে তিনটা বাচ্চাই মারা যায়। কিন্তু পোপ বেঁচে যায়। সবাই ধারণা করেছিল, সেই রক্তের জন্যই পোপ বেঁচে গেছেন। পরের বছর পোপ সেকেন্ড স্ট্রোক করে মারা যান কোনো ঘোষণা ছাড়াই। তারপর থেকে কেউ আর রক্ত দিতে সাহস করেনি।

১৬১৬ সালে ইংরেজ চিকিৎসক ডা. উইলিয়াম হার্ভের গবেষণার মাধ্যমে মানুষ প্রথম জানতে পারে যে, মানবদেহের অভ্যন্তরে রক্ত প্রবাহিত হয়। ১৬৬৬ সালে ডা. রিচার্ড লোয়ার সফলভাবে প্রথমবারের মতো একটি কুকুরের দেহ থেকে আরেকটি কুকুরের দেহে রক্ত সঞ্চালনের পরীক্ষা চালান। ১৬৭৮ সালে রক্ত পরিসঞ্চালনের ব্যাপারে পোপের নিষেধাজ্ঞা। ১৮১৮ সালে ডা. জেমস ব্লান্ডেল নামে একজন ইংরেজ ধাত্রীবিদ্যাবিশারদ রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্য একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যা দিয়ে সফলভাবে একজন সুস্থ মানুষের দেহ থেকে আরেকজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের দেহে রক্ত পরিসঞ্চালন করে তাকে বাঁচিয়ে তোলা হয়। তিনিই প্রথম বলেন, একজন মানুষের শরীরে কেবল আরেকজন মানুষের রক্তই দেওয়া যাবে।

১৯০১ সালে ভিয়েনার ডা. কার্ল ল্যান্ডস্টেনার দেখান, মানুষের রক্তের প্রধানত চারটি গ্রুপ রয়েছে- A, B, AB এবং O. প্রথমবারের মতো মানুষ বুঝল যে, গত ২৭২ বছর ধরে তাদের ভুলটা ঠিক কোথায় হচ্ছিল। তিনি ১৯৪০ সালে আবার Rh group আবিষ্কার করেন, যা আমরা পজিটিভ-নেগেটিভ রক্ত বুঝতে পারি। ১৯১৬ সালে প্রথমবারের মতো সফলভাবে সংরক্ষিত রক্তকে আরেকজনের দেহে প্রবেশ করানো হয়। এ ধারণা থেকেই ফ্রান্সে বিশ্বের প্রথম ব্লাড ব্যাংকের সূচনা করেন একজন আমেরিকান সেনা কর্মকর্তা ও মেডিকেল গবেষক অসওয়াল্ড হোপ রবার্টসন। ১৯২১ সালে লন্ডনের কিংস কলেজ হাসপাতালে ব্রিটিশ রেড ক্রসের সদস্যরা সবাই একযোগে রক্ত দেন। সূচিত হয় বিশ্বের প্রথম স্বেচ্ছা রক্তদানের দৃষ্টান্ত।

কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার (১৮৬৮-১৯৪৩) অস্ট্রিয়ান বংশোদূত বিজ্ঞানী; যিনি মূল রক্তের গোষ্ঠীগুলো আবিষ্কার করেছিলেন (এ, বি, ও)। ১৪ জুন, ১৯০১ সালে তিনি এই গ্রাউন্ড ব্রেকিং আবিষ্কার করেছিলেন এবং প্রথম বার প্রমাণ করলেন যে একই গ্রুপ থেকে রক্ত সঞ্চয়ে কোনো ক্ষতি নেই। এরপরেই তার দুই সহযোগী আলফ্রেড ভন ডেকাস্টেলো আর আদ্রিয়ানো স্ট্রুলি AB গ্রুপটি শনাক্ত করেন। তবে রক্ত সঞ্চয়ের দীর্ঘ ইতিহাসের মোড় নেওয়ার ঘটনা ঘটে ১৯০৭ সালে। নিউইয়র্কের মাউন্ট সিনাই হাসপাতালের আরেক বিশিষ্ট চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী রুবেন ওটেনবার্গই প্রথম রক্তের সংক্রমণ করেছিলেন কার্ল ল্যান্ডস্টেইনের ফলাফল। ফিলিপ লেভাইন (১৯০০-১৯৮৭) ১৯৪১ সালে রকফেলার মেডিকেল ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ফিলিপ লেভাইন আর এইচ অ্যান্টিজেন আবিষ্কার করেছিলেন। যদি থাকে তবে আমরা যেকোনো রক্তের গ্রুপকে ইতিবাচক বলি এবং যদি তা না থাকে তবে আমরা একে নেতিবাচক বলি।

পরিশেষে... স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদানকারী আড়ালে থাকা সেসব মানুষের উদ্দেশে, এসব অজানা বীরের উদ্দেশে, উৎসর্গীকৃত ১৪ জুনের বিশ্ব রক্তদান দিবস। তাই আসুন জীবন সংহারী রোগ থেকে আর্ত মানুষকে বাঁচাতে নিজে রক্ত দেই। অন্যকে রক্তদানে উৎসাহিত করি। রক্ত দিন! বাঁচান একটি প্রাণ! এক ব্যাগ রক্ত দিয়ে শুধু একটি নয় ক্ষেত্র বিশেষে চারটি প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। কেননা এক ব্যাগ রক্তকে এর উপাদান হিসেবে চারটি ভাগে ভাগ করে চারজনের দেহে সঞ্চালন করা সম্ভব। উপাদানগুলো হলো: ‘রেড ব্লাড সেল, প্লেটলেট, প্লাজমা এবং ক্রিওপ্রিসিপিট’ এক একজনের জন্য এক একটি উপাদান প্রয়োজন হয়। তাই আপনার এক ব্যাগ রক্ত বাঁচাতে পারে চারটি প্রাণ। রক্ত দিন! বাঁচান একটি প্রাণ! আর মুমূর্ষু লোকের জীবন রক্ষা ও জনসেবামূলক কাজে যেহেতু ধর্মীয় বিধিনিষেধ নেই, সেহেতু নাগরিক সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য ‘বিশ্ব রক্তদাতা দিবস’ (১৪ জুন ২০২২) উদ্যাপনের মতো কর্মসূচি ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখবে নিঃসন্দেহে।
লেখক : এম এম কামিল হাদিস, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা

প্রতিষ্ঠাতা : জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
drmazed689@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads