• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
কোরবানি সম্পর্কে মৌলিক কিছু কথা

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

কোরবানি সম্পর্কে মৌলিক কিছু কথা

  • অনলাইন ডেস্ক
  • প্রকাশিত ০৮ জুলাই ২০২২

নিজামুল ইসলাম নিজাম

কোরবানির পরিচয় : কোরবান শব্দের আভিধানিক অর্থ নিকটবর্তী হওয়া বা নৈকট্য লাভ করা। আর শরিয়তের পারিভাষায়, আল্লাহতায়ালার নৈকট্য হাসিলের উদ্দেশে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট চতুষ্পদ জন্তু জবাই করার নাম হচ্ছে কোরবানি।

কোরবানির ফজিলত : সাহাবায়ে কেরাম একদিন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! কোরবানি কী? জবাবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘এটা তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর সুন্নাত (রীতিনীতি)। তাঁকে আবারো জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! এতে আমাদের জন্য কি ফজিলত (পুণ্য রয়েছে)? তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে বললেন, ‘(কোরবানির জন্তুর) প্রতিটি লোমের পরিবর্তে (একটি করে) নেকি রয়েছে।’ তাঁরা আবারো জিজ্ঞাসা করলেন, পশম বিশিষ্ট পশুর বেলায় কি হবে? (পশুরতো পশম অনেক বেশি)। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, পশমওয়ালা পশুর প্রতিটি পশমের পরিবর্তেও একটি করে নেকি রয়েছে। (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-৩১২৭) অপর একটি হাদিসে বর্ণিত আছে। হজরত আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোরবানির দিন পশু কোরবানির চাইতে আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় আর কোনো আমল নেই। কেয়ামতের দিন জবেহ করা পশুকে তার শিং ও খুরসহ হাজির করা হবে। কোরবানির জন্তুর রক্ত জমিনে পড়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা খোলা মনে এবং সন্তুষ্টিচিত্তে কোরবানি কর। (জামে তিরমিযি, হাদিস নং- ১৪৯৩)

কোরবানি কার ওপর ওয়াজিব : কোরবানি আদায় করা ধনী গরিব সবার ওপরে ওয়াজিব নয়। কেবলমাত্র প্রত্যেক সামর্থ্যবান, স্বাধীন, পূর্ণ প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর ওপর কোরবানি আদায় করা ওয়াজিব। এছাড়াও কয়েকটি শর্ত একইসঙ্গে যার মধ্যে পাওয়া যাবে শুধু তার ওপরেই নির্দিষ্ট দিনে কোরবানি আদায় করা ওয়াজিব হবে। ১. মুসলমান হওয়া। কেননা অমুসলিমের ওপর শরিয়তের কোনো বিধান আরোপিত হয় না। ২. স্বাধীন হওয়া। কেননা পরাধীন ব্যক্তির ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। ৩. পূর্ণ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া। কেননা নাবালকের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। ৪. মুকিম তথা নিজ এলাকায় অবস্থান করা। কেননা মুসফিরের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। ৫. এবং নেসাব পরিমাণ অর্থ-সম্পদের মালিক হওয়া। কেননা গরিব, মিসকিন, অসহায়ের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। আর ইসলামী শরিয়তে সর্বনিম্ন নেসাব পরিমাণ সম্পদ হচ্ছে, সাড়ে ৫২ তোলা রুপা অথবা বাজারদর অনুযায়ী তার সমপরিমাণ টাকা। আর বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী সাড়ে ৫২ তোলা রুপার সমমূল্য হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। সুতরাং বলা চলে, যার মালিকানায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা ১০ জিলহজ সুবহে সাদিকের পূর্বে থাকবে, তার ওপরেই কোরবানি আদায় করা ওয়াজিব হয়ে যাবে। উল্লেখ্য, জাকাতের নেসাব অবশ্যই পূর্ণ এক বছর মালিকানায় থাকতে হয় আর কোরবানি আদায়ের ক্ষেত্রে নেসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর মালিকানায় থাকা প্রয়োজন নাই।

কোরবানির হুকুম : আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অধিকাংশ আলেমের মতে, ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী প্রত্যেক সামর্থ্যবান, স্বাধীন, মুকিম, মুসলমানের ওপর ১০ থেকে ১২ জিলহজের যেকোনো তারিখে কোরবানি আদায় করা ওয়াজিব। আর যে ব্যক্তি  স্বাধীন, মুকিম মুসলমান এবং নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও কোরবানি আদায় করে না, তার ব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কোরবানি করে না, সে যেন অবশ্যই আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-৩১২৩)

কোন কোন পশু দ্বারা কোরবানি জায়েজ : অধিকাংশ ওলামা ও ফোকাহায়ে কেরাম বলেছেন, ৬ টি নির্দিষ্ট চতুষ্পদ জন্তু দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ। ১. গরু, ২. মহিষ, ৩. উট, ৪. ছাগল, ৫. ভেড়া ও ৬. দুম্বা। উল্লিখিত ৬ টি চতুষ্পদ জন্তু ছাড়া অন্য কোনো জন্তু দ্বারা কোরবানি দিলে কোরবানি সহিহ হবেনা। যেমন : হরিণ অথবা গৃহপালিত প্রাণী হাঁস, মুরগি, কবুতর দিয়ে কোরবানি দেওয়া।

যে ধরনের পশু কোরবানির জন্য জায়েজ নয় : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায়, কোরবানির পশু অবশ্যই রিষ্টপুষ্ট ও সুস্থ-সবল, রোগমুক্ত হতে হবে। কেননা দুর্বল রোগাক্রান্ত ত্রুটিপূর্ণ পশু দ্বারা কোরবানি সহিহ হয় না। তাই অবশ্যই ত্রুটিমুক্ত কোরবানির পশু নির্বাচন করতে হবে। কোরবানিকৃত পশুর মাঝে যে সব দোষত্রুটি থাকলে কোরবানি সহিহ হয় না তার কয়েকটি দোষত্রুটি নিচে তুলে ধরা হলো।

১. প্রথমত গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা  উট এ ছয় প্রকার চতুষ্পদ জন্তু ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী দ্বারা কোরবানি সহিহ হয় না। ২. যে পশুর উভয় চোখ অন্ধ এমন পশু দ্বারা কোরবানি সহিহ হয় না। ৩. যে পশুর এক চোখ অন্ধ, লেংড়া, খোড়া এমন পশু দ্বারা কোরবানি সহিহ হয় না। ৪. দাঁতহীন পশু দ্বারা কোরবানি সহিহ হয় না। ৫. যে পশু জন্মগতভাবে কানহীন এমন পশু দ্বারা কোরবানি সহিহ হয় না। ৬. যে পশুর স্তনের মাথা কাটা এমন পশু দ্বারা কোরবানি সহিহ হয় না। ৭. যে পশুর একতৃতীয়াংশ কান কাটা এমন পশু দ্বারা কোরবানি সহিহ হয় না। ৮. যে পশুর একতৃতীয়াংশ লেজ কাটা এমন পশু দ্বারা কোরবানি সহিহ হয় না। ৯. এবং যে পশু অতিশয় দুর্বল হওয়ার কারণে ঘাস খায় না এবং হাঁটতে চলতে পারে না।

কোরবানির পশুর বয়সসীমা : সাধারণত গরু, মহিষ, উট, ছাগল, ভেড়া এবং দুম্বা দ্বারা কোরবানি করা হয়। আর উল্লিখিত ৬ প্রকার চতুষ্পদ জন্তুর বয়সসীমা হচ্ছে, গরু ও মহিষের বয়স পূর্ণ ২ বছর হতে হবে। ছাগল, ভেড়া এবং দুম্বার বয়স কমপক্ষে ১ বছর হতে হবে এবং উটের বয়স কমপক্ষে পূর্ণ ৫ বছর হতে হবে। তবে ৬ মাসের ছাগল, ভেড়া এবং দুম্বাকে যদি পূর্ণ ১ বছরের ছাগল, ভেড়া এবং দুম্বার মত রিষ্টপুষ্ট দেখা যায়, তাহলে তা দ্বারা কোরবানি সহিহ হবে।

কোরবানি কবুল হওয়ার শর্ত : কোরবানি আল্লাহর নিকট কবুল হওয়ার শর্ত দুটি। প্রথম শর্ত হলো, নিয়ত সহিহ করা। কোরবানিদাতার নিয়ত সহিহ না থাকলে কোরবানি কবুল হবে না। অর্থাৎ মানুষকে দেখানো কিংবা মাংস খাওয়ার উদ্দেশে পশু জবাই করলে কোরবানি হবে না; বরং কোরবানি করতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে রাসুল! আপনি বলুন, নিশ্চয় আমার সালাত, কোরবানি, জীবন মরণ একমাত্র বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহতায়ালার জন্যই।’ (সুরা আনআম, আয়াত নং-১৬২) অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে রাসুল! আপনি আপনার প্রভুর উদ্দেশে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন।’ (সুরা কাওসার, আয়াত নং-২) এছাড়াও নিয়তের ব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রসিদ্ধ একটি হাদিস আছে। হজরত উমর রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয় সমস্ত আমল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। আর মানুষ যা নিয়ত করে তা-ই সে পায়।’ (বুখারি, হাদিস নং-১)

দ্বিতীয় শর্ত : হালাল উপায়ে অর্জিত সম্পদ দ্বারা কোরবানি করা। কেননা সম্পদ যদি হারাম উপায় অর্জিত হয় তা হলে কোরবানি আদায় হবে না। আল্লাহতায়ালা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ব্যয় করো তোমাদের অর্জিত হালাল সম্পদ থেকে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত নং-২৬৭) সুতরাং সর্বপ্রথম আমাদের নিয়ত সহিহ করতে হবে এবং সম্পদ হালাল উপায়ে অর্জিত হতে হবে।

হজরত ইবরাহীম (আ.) তার আদরের একমাত্র সন্তান ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য। সেদিন যদি দুম্বা কোরবানির পরিবর্তে ইসমাইল কোরবানি হতো! তা হলে প্রতিবছর আমাদের আদরের সন্তানদেরকে কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব হয়ে যেত। ইবরাহীম (আ.) খালেস নিয়তে নিজ পুত্রকে আল্লাহর জন্য কোরবানি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য, আমরা অন্তরকে ঠিক রেখে খালেস নিয়তে সন্তান তো দূরের কথা, সাধারণ একটা পশুকে আল্লাহর জন্য কোরবানি দিতে পারি না। আর কোরবানি হচ্ছে তাকওয়ার পরীক্ষা। আল্লাহ দেখতে চান কে এই তাকওয়ার পরীক্ষায় সফলতা লাভ করে আর কে এই তাকওয়ার পরীক্ষায় হেরে যায়। এজন্যই আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘কোরবানির রক্ত-মাংস কোনো কিছুই আল্লাহতায়ালার নিকট পৌঁছে না, শুধু তোমাদের তাকওয়া আল্লাহর নিকট পৌঁছে।’ (সুরা হজ, আয়াত নং-৩৭) এ সম্পর্কে হজরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা তোমাদের শরীর এবং তোমাদের আকৃতি দেখেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমল দেখেন।’ (বুখারি, হাদিস নং-৫১১৪)

কোরবানিদাতার ওপর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হচ্ছে, কোরবানির মাংস বণ্টনের ক্ষেত্রে অপর কাউকে দান সম্পর্কে খোঁটা না দেওয়া এবং কষ্ট না দেওয়া। দান করে খোঁটা দেওয়ার ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে এবং কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান-খয়রাত বরবাদ করো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত নং- ২৬৪) এ সম্পর্কে হাদিসেও এসেছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা তিন ব্যক্তির সাথে কথা বলবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না। তারা হলো ১. লুঙ্গি-কাপড় পায়ের গিঁটের নিচে যে ঝুলিয়ে পরে। ২. দান করে যে লোকের কাছে দানের কথা বলে বেড়ায় এবং ৩. মিথ্যা কসম খেয়ে যে পণ্য বিক্রি করে।’ (মুসলিম, হাদিস নং-১০৬)

সুতরাং যারা কোরবানি দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছেন তারা যেন নিয়তকে কোরবানির আগ মুহূর্তে হলেও পরিশুদ্ধ করে নেন। নচেত কোরবানিকৃত পশুর গোশত শুধু খাওয়া হবে; কিন্তু আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি হাসিল হবে না।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads