• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
যে কারণে হালাল ব্যবসা হারাম হয়  (১)

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

যে কারণে হালাল ব্যবসা হারাম হয় (১)

  • সালেহীন বাবু
  • প্রকাশিত ২৯ জুলাই ২০২২

মহান আল্লাহতায়ালা মানব জাতির জন্য যখন কোনো কিছু হালাল করেছেন, তখন তা ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। আর যখন কোনো কিছু হারাম করেছেন, তখন একটা একটা নাম ধরে নির্দিষ্ট করে হারাম করেছেন। আর যখন আল্লাহতায়ালা কোনো একটা হারাম করেছেন, সাথে সাথে এর বিকল্পে অন্য কিছু সেট করেছেন। উদাহরণস্বরূপ: জিনা বা ব্যভিচার করা হারাম। এর বিকল্পে বিবাহ হালাল ইত্যাদি। অনুরূপভাবে আল্লাহতায়ালা সুদ করেছেন হারাম। এর বিকল্পে ব্যবসা করেছেন হালাল।
আল্লাহতায়ালা যা হালাল সাব্যস্ত করেন; কারো সাধ্য নেই তা হারাম করার। আর যা হারাম করেছেন; কারো সাধ্য নেই তা হালাল করার। অতএব, মানুষ ব্যবসা করতে গিয়ে যদি তাতে হারামের মিশ্রণ ঘটায় তাহলে ব্যবসা হালাল হলেও তা হারামে রূপ নেই। আর যে ব্যক্তিই এমনটা করবে আল্লাহতায়ালা তার জন্য প্রস্তুত রেখেছেন জাহান্নামের ভয়াবহতা। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, যারা সুদ খায়; তারা তার ন্যায় (কবর থেকে) উঠবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দেয়। এটা এ জন্য যে, তারা বলে, ব্যবসা সুদের মতোই। অথচ আল্লাহ ব্যবসা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতএব, যার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে উপদেশ আসার পর সে বিরত হলো, যা গত হয়েছে তা তার জন্যই ইচ্ছাধীন। আর তার ব্যাপারটি আল্লাহর হাওলায়। আর যারা ফিরে গেল, তারা আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে। (সুরা আল-বাকারা, আয়াত-২৭৫)


বর্তমান ব্যবসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় ভেজাল সংযুক্তকরণ, প্রতারণা ও মিথ্যা শপথের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। ব্যবসার বিভিন্ন সেক্টর রয়েছে। আর প্রতিটি সেক্টরে সাধারণ পদ্ধতিতে কিংবা ডিজিটাল পদ্ধতিতে হারামের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নাপাক অর্থ উপার্জনে ব্যবসায়ী ভাইয়েরা খুব বেশি তৎপর। ব্যবসায়ী ভাইয়েরা ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যবসায় লিপ্ত আছেন। সারাদিন পরিশ্রম করেন অর্থের তাগিদে। পরিশ্রমটা যদি বিফলে যায় তাহলে এর মূল্য কিইবা আছে? হালাল উপার্জনের তাগিদে ব্যবসায় লিপ্ত আছেন এবং পরিশ্রম শেষে অর্থ ও খাদ্য নিয়ে বাড়িতে ফিরেন। কিন্তু, পরিশ্রমের টাকা হারাম উপায়ে অর্জিত হওয়ার ফলে সম্পূর্ণ অর্থ ও খাদ্যগুলো কোনো হালাল কাজের পরিচয় বহন না করে হারাম কাজের পরিচয় বহন করে থাকে। পরকালে যখন উপস্থিত হবেন তখন দেখবেন যে, সব উপার্জনই ছিল হারাম। যে উপার্জন ছিল পরিশ্রমের কষ্টিপাথরে গড়া, তা আমলনামার খাতায় সাওয়াবের পরিবর্তে হারাম লিখা থাকার মুহূর্ত বড়ই বিষাদের হবে সেদিন। আর ওই মুহূর্তে দুঃখ এবং আফসোস করেও কোনো কাজে আসবে না। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, এমন এক যুগ আসবে, যখন মানুষ পরোয়া করবে না যে, সে কোথা হতে সম্পদ উপার্জন করল, হালাল হতে না হারাম হতে। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-২০৫৯)


তাই আসুন, ইসলাম আমাদের এই সম্পর্কে কী তথ্য পরিবেশন করেছে ও ব্যবসার ক্ষেত্রে আমাদের কোন কোন বিষয়ের প্রতি সঠিক জ্ঞান রাখতে হবে এবং সে অনুযায়ী আমল করার ফলাফল জানার চেষ্টা করি। এই পর্যায়ে কিছু অসৎ ব্যবসায়ীদের বৈশিষ্ট্যের চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি। যার ফলে উক্ত ব্যবসা হালাল থেকে হারামে রূপ নিচ্ছে।


প্রথম বৈশিষ্ট্য : পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘মন্দ পরিণাম তাদের যারা মাপে কম দেয়। যারা মানুষের কাছ থেকে মেপে নেওয়ার সময় পুরো মাত্রায় গ্রহণ করে এবং যখন তাদের জন্য মাপে অথবা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়।’ (সুরা মুতাফফিফিন, আয়াত : ১-৩)
উপরোক্ত আয়েতের শিক্ষা হলো ‘ওজনে কম না দেওয়া’। এই আয়াতে হুঁশিয়ারির মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা আমাদের সতর্ক করেছেন, যেন আমরা মাপে কম না দেই। যখন ব্যবসায়ীগণ নিজেরা পণ্য ক্রয় করেন তখন পূর্ণ মাত্রায় তা ওজন করে নেন। কিন্তু অন্যকে বিক্রির সময় ওজন কমিয়ে দেন। এটা চরম প্রতারণা এবং হক্ব নষ্ট। বর্তমান এই রোগটা এত বেশি প্রচলিত যার থেকে রেহায় পাওয়ার সম্ভাবনা দুরূহ। আপনি যখন কোনো ক্রেতাকে পণ্য বিক্রি করেন, তখন ওজনের সময় একটি চালের দানা পরিমাণও যদি কম দেন তা আপনার ওপর ততক্ষণ পর্যন্ত হক থেকে যাবে; যতক্ষণ না তাকে তার হক পূর্ণ করে দেন। কিংবা সে আপনাকে ক্ষমা করে দেন। অন্যথায়, কিয়ামতের দিন তার হক পরিশোধ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে নিশ্চিত। আর তা কখনো পণ্যের মাধ্যমে হবে না; বরং আপনার আমলের বিনিময়ে পরিশোধ করা হবে। কেননা সেখানে কোনো পণ্যের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকবে না।


ওজনে কম দেওয়া এবং ঠকানোর মাধ্যমে একজন ক্রেতার হক নষ্ট করা হয়। যা তার অধিকার। ক্রয়কৃত প্রতিটি দানা ক্রেতার সম্পদ। একটা দানার মাধ্যমেও প্রতারণা করা হলে তা অবশ্যই তার সম্পদ নষ্ট করা হবে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, হে মুমিনগণ, তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা। (সুরা আন-নিসা, আয়াত-২৯) অন্যত্রে বলেন, আল্লাহতায়ালা তোমাদের ন্যায়পন্থা, অনুগ্রহ ও নিকটাত্মীয়দের হক প্রদানের নির্দেশ দেন এবং অশ্লীল ও নিষিদ্ধ কার্যাবলি থেকে নিষেধ করেন। (সুরা নাহল, আয়াত-৯০)


দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য : কিছু ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্য একটা বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। আর তা হলো জুলুম করা। অর্থাৎ একটা পণ্য ১০০ টাকায় ক্রয় করে তা বহুগুণ দাম বৃদ্ধি করে বিক্রি করা। নিশ্চিত একজন ক্রেতার ওপর এটা বড় জুলুম। জুলুমের হাজার প্রকার-পদ্ধতি থাকতে পারে। মানুষ ভিন্ন ভিন্ন জুলুমের শিকার হতে পারে। কিন্তু, জুলুম শুধু জুলুমই হয়ে থাকে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘জালিমরা কখনো সফলকাম হয় না।’ (সুরা আনআম, আয়াত-৫৭) তিনি আরো ইরশাদ করেন, অচিরেই জালিমরা জানতে পারবে, তাদের প্রত্যাবর্তনস্থল কোথায় হবে।’ (সুরা আশ-শুআরা, আয়াত-২২৭) হাদিসে এসেছে, আবু জার গিফারি (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মহান প্রতিপালকের পক্ষ থেকে বর্ণনা করেন। আল্লাহ বলেন, হে আমার বান্দারা! আমি আমার জন্য জুলুম হারাম করেছি আর তা (জুলুম) তোমাদের পরস্পরের মধ্যেও হারাম করেছি। অতএব তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম কোরো না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-৬৭৩৭)


তৃতীয় বৈশিষ্ট্য : পণ্যের ত্রুটি বর্ণনা না করে পণ্য বিক্রি করা একটা অন্যতম জঘন্য প্রতারণা। বিশেষত, এই প্রতারণা করার টেকনিক হলো-১০টা ভালোর মধ্যে ১/২টা ত্রুটিযুক্ত পণ্য চালিয়ে দেওয়া যা সাধারণত আলাদা করে বিক্রি করা সম্ভব না। এই ধরনের প্রতারণাও নিষিদ্ধ। হাদিসে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি পণ্যের ত্রুটি বর্ণনা না করে (বরং গোপন করে) বিক্রয় করে, সে সর্বদা আল্লাহর গজবের মধ্যে থাকে এবং ফেরেশতারা সব সময় তাকে অভিশাপ করতে থাকে। (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-২২৪৭)
এ ছাড়াও পণ্যের ত্রুটি গোপন করার মধ্য দিয়েও ক্রয়-বিক্রয়ের বরকত কমে যায়। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হাকীম ইবনু হিযাম (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ক্রেতা-বিক্রেতা যতক্ষণ পরস্পর বিচ্ছিন্ন না হয়, ততক্ষণ তাদের ইখতিয়ার থাকবে (ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন করা বা বাতিল করা)। যদি তারা সত্য বলে এবং অবস্থা ব্যক্ত করে তবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। আর যদি মিথ্যা বলে এবং দোষ গোপন করে তবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ের বরকত মুছে ফেলা হয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-২০৭৯, ২০৮২)
একজন সৎ ব্যবসায়ীর আদর্শ কেমন হওয়া উচিত তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ ঈমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর একটি ঘটনা থেকে উপলব্ধি করা সম্ভব। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ছিলেন অতি উঁচু মানের আদর্শ ধারণকারী একজন ব্যবসায়ী। একবার তিনি তাঁর ব্যবসার সহযোগীকে কিছু পণ্য বিক্রির জন্য এই মর্মে নির্দেশনা দিয়ে পাঠান যে, এর মধ্যে যেসব পণ্য ত্রুটিপূর্ণ তা যেন ক্রেতাদের দৃষ্টিগোচরে এনে বিক্রি করা হয়। ব্যবসার সহযোগী এই নির্দেশনা ভুলে গিয়ে সমস্ত পণ্যই বিক্রি করে ফিরে আসেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এই পণ্যসমূহের বিক্রিলব্ধ অর্থ গ্রহণ না করে সমুদয় অর্থ (৩৫০০০ দিরহাম) দান করে দেন। তাঁর কাছে কোনো বিক্রেতা অজ্ঞতাবশত বাজার মূল্যের চেয়ে কম দামে কোনো পণ্য বিক্রি করতে আসলে তিনি তাদেরকে সঠিক মূল্য অবহিত করে সেই মূল্যেই সেগুলো খরিদ করতেন।


চতুর্থ বৈশিষ্ট্য : মিথ্যা শপথ গ্রহণের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করা। এই জুয়াচুরি বিষয়টা সবচেয়ে বেশি মাত্রায় লক্ষ্য করা যায় কাপড় ব্যবসায়ীদের মধ্যে। বিশেষ করে বাংলাদেশে এর মাত্রা আরো তীব্রতর রূপ ধারণ করে যখন রমজান মাস উপস্থিত হয়। ঈদের কেনা-কাটা অত্যধিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকলে, তারা এর সুযোগ ব্যবহার করে বেশি অর্থ আয়ের জন্য অসৎ পথ অবলম্বন করে থাকেন। ভিন্ন ভিন্ন কথার কারিশমা দিয়ে বলে যে, ভাই, ওয়াল্লাহ! আমার এই জিনিসটার ক্রয়মূল্য এত টাকা, আপনাকে এত টাকা দিতে হবে; না হয় আমাদের লস হবে। অথবা বলে যে, আপনাকে একেবারে কেনা দরে দিয়ে দিচ্ছি ইত্যাদি। আজব কথাবার্তা ও মিথ্যা শপথের মাধ্যমে ব্যবসা করা সম্পূর্ণ প্রতারণা এবং তা জঘন্য পাপ। এই শ্রেণির ব্যবসায়ীদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন জাহান্নামের প্রচণ্ড ভয়বহ। (আগামীকাল পড়ুন ২য় এবং শেষ পর্ব)


লেখক : শিক্ষার্থী, সরকারি সিটি কলেজ চট্টগ্রাম

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads