• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
সফর মাসের জানা অজানা তথ্য

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

সফর মাসের জানা অজানা তথ্য

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ৩১ আগস্ট ২০২২

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

ইসলামী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররম। এই শব্দটি মূলত নামবাচক বিশেষ্য নয়, বরং গুণবাচক বিশেষণ। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে প্রাচীন মক্কার বছর গণনার দুটি মাস ছিল। প্রথম সফর ও দ্বিতীয় সফর। মহররম ও সফরে ছানি একই নামের দ্বিবাচনিক রূপ দেখে তা সহজেই বুঝা যায়। প্রাচীন আরব বছরের প্রথম অর্ধ বছরে তিনটি মাস ছিল। যথা সফর রবি এবং জুমাদা। এই তিনমাসের প্রত্যেকটিতে দুটি করে মাস ছিল। যেমন প্রথম সফর, দ্বিতীয় সফর। প্রথম রবি, দ্বিতীয় রবি। প্রথম জুমাদা এবং দ্বিতীয় জুমাদা। যেহেতু বছর শুরু দুই সফরের প্রথমটি অলঙ্ঘনীয় ও পবিত্র মাসগুলোর অন্যতম ছিল, তাই এর গুণবাচক আখ্যা দেওয়া হয়েছিল ‘আল মুহাররম’। ধীরে ধীরে এই গুণবাচক মহররম নামটি প্রসিদ্ধ হয়ে গেছে। আর দ্বিতীয় সফর মাসটি সফর মাস নামেই অভিহিত হয়ে আসছে। এর কোনো পরিবর্তন হয়নি এবং হবেও না। ‘সিফর’ মূলধাতু থেকে উদ্ভূত হলে ‘সফর’ মানে হবে শূন্য, রিক্ত। আর ‘সাফর’ ক্রিয়া মূল থেকে উৎপন্ন হলে অর্থ হবে হলুদ, হলদেটে, তামাটে, বিবর্ণ, ফ্যাকাশে, পাণ্ডুবর্ণ, ফিকে, ঔজ্জ্বল্যবিহীন, দীপ্তিহীন, রক্তশূন্য ইত্যাদি। তখন আরবরা সৌরবর্ষ হিসাব করত; চন্দ্রমাস গণনা করলেও ঋতু ঠিক রাখার জন্য প্রতি তিন বছর অন্তর বর্ধিত এক মাস যোগ করে ১৩ মাসে বছর ধরে সৌরবর্ষের সঙ্গে সমন্বয় করত। সুতরাং মাসগুলো মোটামুটিভাবে ঋতুতে স্থিত থাকত।

ঋতু ও ফল-ফসলের সঙ্গে আমাদের জীবনের সব ক্রিয়াকর্ম পরিচালিত হয়। ‘সাফর’ ক্রিয়া মূল, সফর মাসের গুরুত্ব ও কিছু কথা আল্লাহতায়ালা উম্মাতে মুসলিমাকে অসংখ্য নিয়ামাতের মধ্যে নিমজ্জিত করে রেখেছেন। তাঁর অন্যতম নিয়ামত হলো দিন-রাত, মাস। রাত ও দিনের জন্য চন্দ্র ও সূর্য সৃষ্টি করেছেন। এ চন্দ্র ও সূর্যকে তিনি বর্ষ গণনার মাধ্যম বানিয়েছেন। মানুষ সাধারণত অবস্থার সঙ্গে সময়কে মূল্যায়ন করে। আরব দেশে সে সময় সফর মাসে খরা হতো এবং খাদ্যাভাব, আকাল ও মন্দা দেখা দিত। মাঠঘাট শুকিয়ে বিবর্ণ তামাটে হয়ে যেত। ক্ষুধার্ত মানুষের চেহারাগুলো রক্তশূন্য ও ফ্যাকাশে হয়ে যেত। তাই তারা অবস্থার সঙ্গে মিল রেখে এই মাসের সঙ্গে একটি বিশেষণ যুক্ত করে বলত, ‘আস সাফারুল মুসাফফার’, অর্থাৎ ‘বিবর্ণ সফর মাস’। (লিসানুল আরব, ইবনু মানযুর রহ.)

জাহেল আরবরা এই মাসকে দুঃখের মাস মনে করত, এমনকি তারা এ মাসের চাঁদ দেখা থেকে পর্যন্ত বিরত থাকত এবং দ্রুত মাস শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করত। ইসলামী বিশ্বাসমতে, সময়ের সঙ্গে কোনো অকল্যাণ নেই; কল্যাণ-অকল্যাণ নির্ভর করে মানুষের বিশ্বাস ও কর্মের ওপর। তবে চন্দ্রের হিসাব আল্লাহর কাছে অধিক পছন্দনীয়। চন্দ্রের হিসাবে এখন চলছে সফর মাস। এ মাসের কিছু কথা তুলে ধরা হলো-আরবি বছরের দ্বিতীয় মাস সফর। আল্লাহর সৃষ্টি প্রতিটি দিন-রাত-মাস-বছরই ফজিলতপূর্ণ। তাই সফর মাসও এর বাইরে নয়। আল্লাহতায়ালার রহমত, বরকত, কল্যাণ পেতে হলে এ মাসে বেশি বেশি নেক আমল করতে হবে। ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত আদায়ের পাশাপাশি গভীর রজনীতে নফল ইবাদতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে প্রভুর দরবারে খালেছ নিয়তে কোনো কিছু প্রার্থনা করলে তিনি তা কবুল করেন।

অনেকে এই মাসকে একটি দুঃখের মাস মনে করেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাকে সফর মাস শেষ হওয়ার সুসংবাদ দেবে, আমি তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দেব। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং সফর মাসের শিগগিরই অবসান কামনা করেছেন। তাইতো এ মাসে বেশি বেশি নফল ইবাদত করে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতির সমুদয় অকল্যাণ থেকে মুক্ত থাকতে আল্লাহর দরবারে রোনাজারি করতে হবে। সফর মাসের হাদিসটির ব্যাপারে ইসলামী চিন্তাবিদগণ দুইটি মত তুলে ধরেছেন। প্রথমত-হাদিসটি সম্পূর্ণ জাল, মিথ্যা যা আদৌ রাসুলের হাদিস নয়, রবং যারা এ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন তাদের কেউই হাদিস সংরক্ষণকারী নয়। দ্বিতীয়ত- হাদিসটি সহিহ, তবে এ হাদিসের প্রেক্ষাপট কী তা জানতে হবে। মূলত হাদিসটি একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তা হলো- একবার হজরত আবু বকর ইসলামের দাওয়াত নিয়ে দূরের এক জনপদে সফরে যান। সে সফর থেকে ফিরতে অনেক বিলম্ব হচ্ছিল। কোনো চিঠি বা সংবাদও আসছে না। এমতাবস্থায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রিয় সাহাবির জন্য চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ওই সময় একটি চিঠি এলো, তাতে লেখা ‘হে আল্লাহর রাসুল! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আমি সফর মাস শেষে মদিনায় ফিরব। কিন্তু তখনো সফর মাসের বেশ সময় বাকি। তাই তিনি হজরত আবু বকরের অপেক্ষায় থাকাকালীন সময় সফর মাস শেষের অপেক্ষায় থাকলেন যে, কখন সফর মাস শেষ হবে। তখন তিনি ওই হাদিসটি বলেছিলেন।

তাছাড়া এ মাসের শেষ বুধবারে অনেকেই আখেরি চাহার শোম্বা পালিত করে থাকে। ফারসি শব্দ আখেরি চাহার শোম্বা অর্থ শেষ চতুর্থ বুধবার। সফর মাসের শেষ বুধবারকে ‘আখেরি চাহার শোম্বা’ বলা হয়। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সফর মাসের শেষের দিকে অসুস্থ হন। তিনি সফর মাসের শেষদিকে কিছুটা সুস্থ হন এবং গোসল করেন। এরপর তিনি পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এই অসুস্থতাতেই তিনি পরের মাসে ইন্তেকাল করেন। এ জন্য অনেকে এই দিনে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সর্বশেষ সুস্থতা ও গোসলের স্মৃতি উদযাপন করেন। এ কারণে দিনটি মুসলমানেরা ‘শুকরিয়া দিবস’ হিসেবে পালন করেন। এ দিনকে ঘিরে এমন আরো অনেক কথা প্রচলিত রয়েছে। তবে ইসলামী স্কলারদের অভিমত হলো, উপরোক্ত বিষয় এবং এ মাসের ফজিলত বিষয়ে যা কিছু বলা হয়- তার সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। এমন কোনো বর্ণনা হাদিসে নেই। আরো মজার বিষয় হলো- ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া অন্য কোনো মুসলিম সমাজে সফর মাসের শেষ বুধবার পালনের রেওয়াজ নেই। তারা জানেও না আখেরি চাহার শোম্বা কী!

উপরোক্ত বিষয় ছাড়াও অনেকেই সফর মাসকে অশুভ মনে করে থাকেন। ইসলামী শরিয়তে এরও কোনো ভিত্তি নেই। কোনো স্থান, সময়, বস্তু কিংবা কর্মকে অশুভ অথবা অমঙ্গলময় বলে মনে করা ইসলামী বিশ্বাসের ঘোর পরিপন্থি। এটা একটি কুসংস্কার। প্রাচীন আরবের মানুষেরা জাহেলি যুগ থেকেই সফর মাসকে অশুভ ও বিপদাপদের মাস বলে বিশ্বাস করতো। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের এই বিশ্বাসের প্রতিবাদ করে বলেন, ‘ইসলামে কোনো অশুভ-অযাত্রা নেই।’ ‘সহিহ বুখারি ও মুসলিম)

সফর মাসের আমল : প্রতি চন্দ্রমাসে নির্দিষ্ট কিছু আমল থাকে। সে আমলগুলো সফর মাসে করা যেতে পারে। ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে আইয়ামে বিজের তিনটি রোজার ইহতিমাম করা। প্রতি মাসে ৩টি সিয়াম পালন করার কথা হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। হাদিসের ভাষ্য, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘প্রতি মাসে তিনটি করে সিয়াম পালন, সারা বছর ধরে সিয়াম পালনের সমান।’ (বুখারি, হাদিস নং- ১১৫৯, ১৯৭৫) প্রতি সপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখার অভ্যাস করা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দুই দিন বিশেষ রোজা রাখতেন। সর্বোপরি ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতে মুয়াক্কাদা যথাযথ পালন করার সাথে সাথে নফল দান সদকার প্রতি মনোযোগী হওয়া। আর আল্লাহ সৃষ্ট সব দিন-রাত-মাসের ফজিলত অত্যধিক। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে এ মাসের প্রত্যেকটি দিন-রজনীতে ফরজ ওয়াজিব আমলের পাশাপাশি নফল নামাজ ও রোজা পালনসহ ইবাদাত-বন্দেগিতে আত্মনিয়োগ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
drmazed96@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads