• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
ইসলামে আনুগত্যের গুরুত্ব ও সীমারেখা

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

ইসলামে আনুগত্যের গুরুত্ব ও সীমারেখা

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২

মুফতী পিয়ার মাহমুদ

আনুগত্যের পরিচয় : আনুগত্য অর্থ মান্য করা, মেনে চলা, আদেশ ও নিষেধ পালন করা, কোনো কর্তৃপক্ষের ফরমান-ফরমায়েশ অনুযায়ী কাজ করা।  কোরআন-হাদিসের ভাষায় যাকে ‘ইতাআত’ বলা হয়। আরবিতে ইতাআতের বিপরীত শব্দ মাছিয়াত। যার অর্থ নাফরমানি করা, হুকুম অমান্য করা। প্রকৃত আনুগত্য হলো আল্লাহ ও রাসুলের যাবতীয় হুকুম আহকাম মেনে চলা। আর ইসলামের দৃষ্টিতে আনুগত্য তাকেই বলা যাবে, যেটা হবে মনের ষোলআনা ভক্তি শ্রদ্ধা সহকারে, পূর্ণ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা সহকারে, স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণা সহকারে। কোনো প্রকারের কৃত্রিমতা বা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সংকোচ-সংশয়ের কোনো ছাপ বা পরশ থাকতে পারবে না। ইসলাম ও আনুগত্য অর্থের দিক দিয়ে এক ও অভিন্ন। শাব্দিক অর্থের আলোকে ইসলামের অন্তর্নিহিত দাবি অনুধাবন করলে দেখা যাবে যে, এখানে আনুগত্যই মূল কথা। সুতরাং আমরা বলতে পারি, ইসলামই আনুগত্য অথবা আনুগত্যই ইসলাম। যেখানে, আনুগত্য নেই সেখানে ইসলাম নেই। যেখানে ইসলাম নেই, সেখানে আনুগত্য নেই।

 

আনুগত্যের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা : ইসলামে মানবের জীবন ও সমাজব্যবস্থার মূলভিত্তিই হল আনুগত্য। নিরঙ্কুশ আনুগত্য ছাড়া পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কোথাও শান্তি-শৃঙ্খলা আসে না। সর্বত্রই দেখা দেয় সীমাহীন অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা। অস্থির হয়ে উঠে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব। তাই ইসলামে ইতাআত বা আনুগত্যের গুরুত্ব যারপর নাই। আনুগত্যের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর নির্দেশ মান্য করো, নির্দেশ মান্য করো রাসুলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক তাদের। তারপর যদি তোমরা কোনো বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর যদি তোমরা আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের ওপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম।’ (সুরা নিসা, আয়াত-৫৯)

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করলো সে প্রকৃত অর্থে আল্লাহর আনুগত্য করলো এবং যে ব্যক্তি আমার নাফরমানি করলো সে প্রকৃত অর্থে  আল্লাহর নাফরমানি করলো। যে ব্যক্তি আমিরের আনুগত্য করলো সে প্রকৃত অর্থে  আমার আনুগত্য করলো এবং যে ব্যক্তি আমিরের নাফরমানি করলো সে প্রকৃত অর্থে  আমার নাফরমানি করলো।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং-৭৪৩৪) উল্লেখিত আয়াত ও হাদিসে আল্লাহ ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের আনুগত্যের সাথে সাথে উলুল আমরের আনুগত্যকে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। উলুল আমর বলতে সেই সব ব্যক্তিকেই বুঝায়, যারা মুসলিম সমাজের পরিচালক। আলেম-উলামা, ন্যায়সঙ্গত শাসক, বিচারপতি এবং সর্দার-মাতব্বরসহ নেতা-সেনাপতি সকলেই উলুল আমরের মধ্যে গণ্য।

 

আনুগত্যের সীমারেখা : ইসলাম আনুগত্যের সীমাহীন গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি তার সীমারেখাও টেনে দিয়েছে মজবুতভাবে। এ সংক্রান্ত কয়েকটি নীতিমালা উল্লেখ করা হলো।

 

১. আমির বা নেতার আদেশ শরিয়তসম্মত হতে হবে : আমির বা নেতার আদেশ ততক্ষণ মানা যাবে যতক্ষণ তিনি শরিয়াতের সীমার ভিতরে থাকেন। সীমা অতিক্রম না করেন। তার আদেশ-নিষেধ হয় কোরআন-সুন্নাহ মোতাবেক। শরিয়াতের সীমা লঙ্ঘন হলে বা তার আদেশ-নিষেধ  কোরআন-সুন্নাহ সম্মত না হলে তা মানার কোনো সুযোগ নেই। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, নিজের নেতৃবৃন্দের কথা শোনা ও মেনে চলা মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য, তা তার পছন্দ হোক বা না হোক, যে পর্যন্ত না তাকে গোনাহ ও নাফরমানির হুকুম দেওয়া হয়। আর যখন তাকে নাফরমানির হুকুম দেওয়া হয়, তখন তার সে হুকুম শোনা ও আনুগত্য করার অবকাশ নেই। (বুখারি, হাদিস নং-৭১৪৪; মুসলিম, হাদিস নং-১৮৪৯) আরেক বর্ণনায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহর নাফরমানি করে কোনো সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং-১০৯৫, ৩৮৮৯)

 

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, পাপ কাজের আদেশ না করা পর্যন্ত ইমামের কথা শোনা ও তাঁর আদেশ মান্য করা অপরিহার্য। তবে পাপ কাজের আদেশ করা হলে তা শোনা ও আনুগত্য করা যাবে না। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-২৯৫৫) হাদিসগুলোর ভাষ্য এক ও অভিন্ন। কেবল বৈধ ও শরিয়াহসম্মত ক্ষেত্রেই আমির বা নেতার ইতাআত বা আনুগত্য করা যাবে। অবৈধ ও কোরআন-সুন্নাহর খেলাফ কোনো ক্ষেত্রে আমির বা নেতার আদেশ-নিষেধ মানা যাবে না। নেতৃত্ব পাওয়ার পর কোনো নেতা যদি দীন থেকে বিচ্যুত হয়, তবে তার আনুগত্য পরিহার করতে হবে। কারণ মানুষের আনুগত্য চিরন্তন নয়।

 

২. আনুগত্যে প্রাধান্য পাবে ‘দীনদারি, যোগ্যতা ও ন্যায়ানুগতা : এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হলো আনুগত্যের প্রশ্নে ইসলাম ব্যক্তি বা বংশকে প্রধান্য দেয়নি। প্রাধান্য দিয়েছে ‘দীনদারি, যোগ্যতা ও ন্যায়ানুগতাকে। এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে বলেছিলেন ‘যদি তোমাদের নেতা হিসেবে কোনো কৃষ্ণাঙ্গ দাসকে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং সে আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদের নেতৃত্ব দেয়, তবে তার কথা শোনো এবং আনুগত্য করো। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-১৮৩৮) আরেক হাদিসে আছে; রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যদি কোনো হাবসী ক্রীতদাসকেও তোমাদের নেতা বানিয়ে দেওয়া হয় যার মাথা কিসমিসের মতো, তা হলেও তোমরা তার আনুগত্য করো। (বুখারি, হাদিস নং-৬৯৩) কাজেই আমির বা নেতার চেহারা, বংশ ইত্যাদি যেমনই হোক না কেন তিনি যদি যোগ্য হোন এবং যথাযথ পন্থায় নিয়োগ পান, তাহলে তাঁকে মানতেই হবে। অমান্য করার কোনো সুযোগ নেই।

 

৩. অন্ধ অনুকরণ নিষিদ্ধ : বিবেক-বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে কোনো কিছুর অন্ধ অনুকরণ ইসলামে অনুমোদিত নয়। যারা সত্যের বিপরীতে অন্ধ অনুকরণের অংশ হিসেবে পূর্বপুরুষের কুসংস্কার, কোরআন-সুন্নাহর বিপরীত মতবাদ ও বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে এবং সে অনুযায়ী কাজ করে পবিত্র  কোরআনের অসংখ্য স্থানে তাদের নিন্দা করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে- ‘যখন তাদের বলা হয়, এসো আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার দিকে এবং রাসুলের দিকে। তারা বলে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের যার ওপর পেয়েছি তাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। যদিও তাদের পূর্বপুরুষরা কিছু না জানে এবং সুপথপ্রাপ্ত না হয়, তারপরও তারা তাদের অনুসরণ করবে?’ (সুরা মায়িদা, আয়াত-১০৪) অর্থাৎ পূর্বপুরুষরা ভুলের মধ্যে থাকলেও কী তারা তাদের অনুসরণ করবে? তাদের তো উচিত সুপথের অনুসারী ও সত্যসন্ধানী হওয়া। পূর্বপুরুষদের ভ্রান্তিগুলোর অনুসরণ পরিহার করা।

 

৪. নেতার মন্দ প্রভাব সমাজের ওপর পড়ে : যখন কোনো সমাজের নেতা সত্যবিচ্যুত হয়, ভ্রান্ত পথে পা বাড়ায়, তখন তার মন্দ প্রভাব সমাজের ওপর পড়ে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি যখন কোনো জনপদ ধ্বংস করতে চাই, তখন তার সমৃদ্ধশালীদের ভালো কাজের নির্দেশ দিই। কিন্তু তারা সেখানে অসৎকর্ম করে। ফলে তাদের প্রতি দণ্ডাদেশ বৈধ হয়ে যায় এবং আমি তাদের সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিই।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত-১৬) তাই নেতার অনুসরণ ভেবেচিন্তে করতে হবে।

 

অন্ধ আনুগত্যের পরকালীন পরিণতি : একজন নেতার কাজ অনুসারীদের সঠিক পথ দেখানো। কিন্তু কোনো কোনো নেতা তার অনুসারীদের বিপথগামীও করেন। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, আমি তাদের নেতা বানিয়েছিলাম, তারা লোকদের জাহান্নামের দিকে আহ্বান করত, কিয়ামতের দিন তাদের সাহায্য করা হবে না। আমি এই পৃথিবীতে অভিশাপকে তাদের পশ্চাতে লাগিয়ে দিয়েছি এবং কিয়ামতের দিন তারা হবে দুর্দশাগ্রস্ত। (সুরা কাসাস, আয়াত-৪১, ৪২)

 

এ কথা ভাবার অবকাশ নেই যে, নেতা হলেই সে সুপথের অনুসারী। তাকে অনুসরণ করতেই হবে। কারণ নেতাও হতে পারে ভ্রান্তির শিকার। হতে ভ্রান্ত পথের পথিক। তাই নেতার কথা মানার আগে ভাবতে হবে, তার কথাগুলো কোরআন-সুন্নার বিচারে সঠিক, নাকি ভ্রান্ত। সঠিক হলে গ্রহণ করা। অন্যথায় পরিহার করা। অন্ধ অনুকরণ ও আনুগত্যের পরকালীন পরিণতি হবে ভয়াবহ। পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে বিষয়গুলো বিবৃত হয়েছে। পরকালে অনুসারীরা নেতাদের দোষারোপ করবে এবং  দ্বিগুণ শাস্তি দাবি করবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, তাদের দ্বিগুণ শাস্তি দাও এবং তাদের দাও মহা অভিশাপ।’ (সুরা আহজাব, আয়াত-৬৮) নেতারা অনুসারীদের কোনো অপরাধের দায় বহনে অস্বীকার করবে। ইরশাদ হয়েছে, যারা ক্ষমতাদর্পী তারা যাদের দুর্বল মনে করা হতো তাদের বলবে, তোমাদের কাছে সৎপথের দিশা আসার পর আমরা কি তোমাদের তা থেকে নিবৃত করেছিলাম? বস্তুত তোমরাই তো ছিলে অপরাধী। (সুরা সাবা, আয়াত-৩২)

 

আনুগত্যহীনতার বিশেষ কয়েকটি কারণ : আনুগত্যহীনতার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এখানে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো। (১)  আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনকে অগ্রাধিকার দেওয়া। (২)  আনুগত্যের গুরুত্ব সম্পর্কে অজ্ঞতা। (৩)  গর্ব ও অহংকার। (৪)  হিংসা ও বিদ্বেষ। (৫)  সিনিয়রিটি জুনিয়রিটি মনোভাব। (৬)  মেজাজের ভারসাম্যহীনতা। (৭) পদের প্রতি মোহ। (৮) দায়িত্বশীল পছন্দ না হওয়া। (৯)  দায়িত্বশীলের সাথে তিক্ত সম্পর্ক। (১০)  দায়িত্বশীলের ব্যাপারে সন্দেহ প্রবণতা। (১১)  মতামতের কোরবানি করতে না পারা। (১২) হূদয়ের বক্রতা। (১৩)  মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্ন করার প্রবণতা। (১৪)  নিজেকে অন্যের চেয়ে যোগ্য মনে করা। (১৫)  সুযোগ সন্ধানী/জাগতিক লাভের মনোভাব ইত্যাদি।

 

লেখক : ইমাম ও খতীব, মসজিদুল আমান, গাঙ্গিনারপাড়, ময়মনসিংহ

মুহাদ্দিস, মাদরাসা সাওতুল হেরা, সদর ময়মনসিংহ

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads