• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

শোবিজ

তারেক মাসুদকে হারানোর এক দশক

  • বিনোদন প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৩ আগস্ট ২০২১

বাংলাদেশে খুব সচেতনভাবেই আমাদের চারপাশের জীবনটাকে যারা সিনেমার পর্দায় তুলে ধরতে চেয়েছিলেন, তাদের মাঝে একেবারেই প্রথমদিকে চলে আসে তারেক মাসুদের নাম। তারেক মাসুদকে একাধারে সিনেমার কারিগর এবং ফেরিওয়ালা বললে ভুল হবে না মোটেই। জীবনের রং আর স্বাদ ছেনে সিনেমা বানাতেন। তারপর সাদর আগ্রহ নিয়ে সেই ছবি মানুষকে দেখাতেন, দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে, কখনোবা সীমানা ছাড়িয়ে। বরেণ্য এ চলচ্চিত্রকারের মৃত্যুবার্ষিকী আজ। মানিকগঞ্জের জোকায় ২০১১ সালের এই দিনে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় তারেক মাসুদ, চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীরসহ আরও তিন চলচ্চিত্রকর্মী। তাদের এই অকাল প্রয়াণে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। এ শূনস্থান পূরণ হওয়ার নয়।

তারেক মাসুদের জন্ম ১৯৫৬ সালের ৬ই ডিসেম্বর। জন্মস্থান ফরিদপুর জেলার নূরপুর গ্রাম। ছোটবেলায় ইসলামী শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে তাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় মাদরাসায়। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তার পড়াশোনায় ছেদ পড়ে। পরে ঢাকার আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে কিছুদিন পড়ালেখা করার পর নটর ডেম কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। মূলত এ সময় থেকেই তারেক মাসুদ চলচ্চিত্র আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। তিনিই এ দেশের পরিচালকদের মধ্যে প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলনের সূচনা করেন। আরেক কিংবদন্তি মেধাবী নির্মাতা আলমগীর কবির ছিলেন তাঁর সিনেমাগুরু। আহমদ ছফার বিশেষ ভক্ত ছিলেন তিনি।

১৯৮৫ সালে তিনি নির্মাণ করেন ‘সোনার বেড়ী’ নামের আরেকটি প্রামাণ্যচিত্র। একই বছর তারেক মাসুদ তৈরি করেন ‘মুক্তির গান’। তারেক মাসুদের ‘আদম সুরত’ (দ্য ইনার স্ট্রেংথ) ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৮৯ সালে। এটি মূলত এস এম সুলতানের ওপর নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র। পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের ওপর ভিত্তি করেই তারেক মাসুদ তৈরি করেন ‘মুক্তির কথা’ ও ‘ নারীর কথা’ নামের আরো দুটি প্রামাণ্যচিত্র। ২০০২ সালে নির্মিত হয় ‘মাটির ময়না’। এটি নিঃসন্দেহে তারেক মাসুদের তৈরি অন্যতম সেরা কাজ। ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবে এটি জিতে নেয় ‘ফিপরেস্কি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিকস প্রাইজ’। এছাড়াও অস্কারে ‘সেরা বিদেশি ভাষার ছবি’ ক্যাটাগরিতে প্রথম বাংলাদেশি সিনেমা হিসেবে ‘মাটির ময়না’কে মনোনয়ন দেওয়া হয়।

তারেক মাসুদ নির্মিত আরো দুটি চলচ্চিত্র হলো ‘রানওয়ে’ (২০১০) এবং ‘অন্তর্যাত্রা’ (২০০৬)। সিনেমাগুলোতে আপাতদৃষ্টিতে জঙ্গি, মৌলবাদী কিংবা অস্তিত্বহীন চরিত্রগুলোর পেছনের গল্প তুলে এনেছেন তিনি, দেখিয়েছেন পারিপার্শ্বিকতা কীভাবে তাদেরকে ভুল পথে নিয়ে গেছে। এ দেশের প্রতিটি প্রাণ জীবনের স্বরূপ খুঁজে পাবে এই স্বপ্ন, এই প্রত্যাশা নিয়েই সিনেমা বানিয়েছেন তারেক মাসুদ।

‘রানওয়ে’র প্রদর্শনী করানোর তারেক মাসুদ জন্য ঘুরেছেন দেশের প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে। নামমাত্র মূল্যে মানুষকে সিনেমা দেখিয়েছেন। তিনি চেয়েছিলেন দেশের সিনেমা হলগুলো বাঁচুক। সিনেমা হোক জাগরণের মাধ্যম।তারেক মাসুদ জীবন যাপনে ছিলেন অতিসাধারণ। কথায়-চিন্তায়-আচরণে একটা সহজ নিঃসংকোচ আবহ পাওয়া যেত। গানও লিখতেন তিনি। তারেকের মৃত্যুর পর ক্যাথরিনের উদ্যোগে তার লেখা গান নিয়ে প্রকাশিত হয় একটি অ্যালবাম।

২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জ থেকে ‘কাগজের ফুল’ সিনেমার লোকেশন ঠিক করে ঢাকা ফিরছিলেন তারেক মাসুদ। সাথে ছিলেন সাংবাদিক মিশুক মুনীর এবং ক্যাথরিন। পথিমধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর। রক্ষা পেয়ে যান ক্যাথরিন। তারেকের মৃত্যুর পর ক্যাথরিনের উদ্যোগে এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের সাহায্যে গড়ে উঠেছে ‘তারেক মাসুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’, স্বপ্ন তারেক মাসুদের অসম্পূর্ণ স্বপ্নগুলোকে সম্পূর্ণ করা। জীবন মানুষটাকে থামিয়ে দিয়েছে তো কি? স্বপ্নগুলো পূর্ণতা পাক।

তারেক মাসুদ একজন যোদ্ধা, কবি ও চির তরুণ। সিনেমাপাগল এই মানুষটিকে দেশের বড় দরকার ছিলো। কিন্তু অদ্ভুত অসময়ে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই চলে গেলেন সেলুলয়েডের এই কবি। শুধু রেখে গেলেন স্বপ্ন জাগানিয়া কিছু কাজ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads