• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো নিয়ে শঙ্কা

ফাইল ছবি

প্রবাস

মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো নিয়ে শঙ্কা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১২ জানুয়ারি ২০২২

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী পাঠানো নিয়ে নতুন করে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। শ্রমিকের সব খরচ বহনে রাজি হচ্ছে না মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তারা।

অথচ চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশি কর্মীদের বিমান ভাড়াসহ মালয়েশিয়া প্রান্তের সব ব্যয় বহন করবেন নিয়োগকর্তা। এই খরচে রয়েছে রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি নিয়োগ, মালয়েশিয়ায় আনা, আবাসন, কাজে যোগদান এবং ওই কর্মীকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর খরচও। কিন্তু এসব সিদ্ধান্তে রাজি হচ্ছে না দেশটির নিয়োগকর্তারা।

তাদের বক্তব্য, কোভিড-১৯ আর বন্যায় তাদের ব্যবসা চরম ক্ষতিগ্রস্ত, সে অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন তারা। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগে সব খরচ বহন করতে গেলে তারা পারবে না। গত শনিবার (৮ জানুয়ারি) স্থানীয় সংবাদ পত্র ‘দ্যা ফ্রি মালয়েশিয়া টুডেতে দেওয়া এক বিবৃতিতে এসব কথা জানিয়েছে দেশটির নিয়োগকর্তাদের অ্যাসোসিয়েশন ‘এসএমই’।

এসএমইর সেক্রেটারি জেনারেল চিন চি চিওং গণমাধ্যমে দেওয়া বিবৃতিতে বলেন, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগে সমঝোতা স্মারকে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে তা অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘কর্মী আনতে বিমান ভাড়া, কোয়ারেনটাইন, আবাসন, চিকিৎসাসহ যে খরচ দেখানো হয়েছে তাতে লাখ টাকার ওপরে ব্যয় হবে। যা সব নিয়োগকর্তার পক্ষে বহন করা সম্ভব না।

চিন চি চিওং আরও বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে গত দুই বছর ধরে সব ধরনের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত, তার ওপরে বন্যা হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে কর্মীদের সব খরচ বহন করা আমাদের জন্য বাড়তি বোঝা। সমঝোতা স্মারকে এ বিষয়গুলো বাধ্যতামূলক বলা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার ক্ষেত্রে সব খরচ মালিককে বহন করার বিষয়টি ঐচ্ছিকভাবে বিবেচিত হওয়া উচিত।

ওই বিবৃতিতে দেশটির ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সমিতির সভাপতি কাম লিয়ান হুই বলেন, সমঝোতা স্মারকে যে বিষয়গুলোর ওপরে জোর দেওয়া হয়েছে তা মেনে না চলার কোনো বিকল্প নিয়োগকর্তার সামনে নেই। মালয়েশিয়ায় বর্তমানে শ্রমিক সংকট রয়েছে। কিন্তু সমঝোতা স্মারকে আমাদের ওপরে যে খরচের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে আশা করি দুই দেশের সরকারই তা বিবেচনা করবেন।

মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তাদের দেওয়া তথ্যমতে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে জনপ্রতি খরচ হবে ১ লাখ টাকার বেশি। এরপর কর্মীর আবাসন, চিকিৎসা এবং মেয়াদ শেষে তার দেশে ফেরত পাঠানোর খরচ তো রয়েছেই।

মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মো. ফারুক হোসেন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, এখানকার সব মালিকের পলিসি এক না হওয়ায় নানা ধরনের বিপত্তি ঘটে। আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের লঙ্ঘন হয় বেশি। যে কারণে শ্রমিক সুরক্ষার বিষয়টি অধরাই থাকে।

নতুন চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশি কর্মীদের মালয়েশিয়া প্রান্তের সব ব্যয় বহন করবেন নিয়োগকর্তা। এই খরচে রয়েছে রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি নিয়োগ, মালয়েশিয়ায় আনা, আবাসন, কাজে যোগদান এবং ওই কর্মীকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর খরচ। মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পর বাংলাদেশি কর্মীর ইমিগ্রেশন ফি, ভিসা ফি, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ইন্স্যুরেন্স, কোভিড টেস্ট এবং কোয়ারেনটাইন সংক্রান্ত খরচ বহন করার কথা মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তার। কর্মীর বীমা, চিকিৎসার বিষয়টি নিয়োগকর্তা নিশ্চিত করবেন।

দুই দেশের মধ্যে হওয়া এই চুক্তির মেয়ার পাঁচ বছর। মেয়াদ শেষে দুই পক্ষ চাইলে মেয়াদ বাড়াতে পারবে। এর বাইরেও চুক্তিতে কর্মীর বেতন উল্লেখ, মেয়াদ কতদিন, মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বেতন পরিশোধ, কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে। তবে কোনো কর্মী অবৈধ কাজে লিপ্ত হলে নিজ খরচেই দেশে ফেরত পাঠানো হবে। আর বাংলাদেশ অংশের খরচ কর্মীকেই বহন করতে হবে।

বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেসব বিষয়কে মোটা দাগে সামনে রেখে সমঝোতা স্মারকে সই হয়েছে। তা বাস্তবে কখনোই সম্ভব না। তাদের মতে, মালয়েশিয়া কখনোই সব খরচ বহন করে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেবে না।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং অ্যাজেন্সির (বায়রা) সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, মালয়েশিয়ার সঙ্গে যতবার এমন চুক্তি হয়েছে ততবারই এ বিষয় উল্লেখ ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে অনেক অদৃশ্য ব্যয় থাকবে, যা কেউ বহন করতে চাইবে না। শেষমেশ শ্রমিকদেরই বহন করতে হবে।

মধ্যপ্রাচ্যের পর বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। দেশটিতে গত দশ বছরে মোট ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৮১২ জন কর্মী পাঠানো গেছে। এর মধ্যে ২০১২ সালে ৮০৪ জন, ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৮৫৩ জন, ২০১৪ সালে গেছেন ৫ হাজার ১৩৪ জন ২০১৫ সালে গেছেন ৩০ হাজার ৪৮৩ জন, ২০১৬ সালে ৪০ হাজার ১২৬ জন, বিগত বছরগুলোতে জনশক্তি রপ্তানি নিয়ে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে নানারকম সিদ্ধান্তহীনতায় আশানুরূপ কর্মী যেতে পারেনি। কিন্তু ২০১৭ সালে গতি বেড়ে যায়, এ বছর ৯৯ হাজার ৭৮৭ জন পাঠানো গেছে। ২০১৮ সালেও এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকে, এ বছর ১ লাখ ৭৫ হাজার ৯২৭ জন কর্মী কাজ নিয়ে যায় মালয়েশিয়ায়। কিন্তু দুর্নীতি আর সিন্ডিকেটে এ বছরই বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ পুরোপুরি বন্ধ দেয় মালয়েশিয়া সরকার।

এরপরও নানা উপায়ে ২০১৯ সালে ৫৪৫ জন, ২০২০ সালে গেছেন ১২৫ জন এবং বিদায়ী বছর ২০২১ সালে মাত্র ২৮ জন কর্মী যান দেশটিতে। এবার দেশটিতে ব্যাপক আকারে কর্মী পাঠাতে সমঝোতা স্মারকে সই করা হয়।

গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর নতুন করে এ সমঝোতা স্মারকে সই করেন মালয়েশিয়ায় দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রী এম সারাভানান এবং বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ। অভিবাসন ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরে সব ধরনের সিন্ডিকেট দুর্নীতি বন্ধ করে কর্মী পাঠানোই এবারের উদ্দেশ্য।

দুর্নীতি আর সিন্ডিকেটের অভিযোগে টানা তিন বছর বন্ধ থাকা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নতুন করে এক সমঝোতা স্মারক সইয়ের মধ্য দিয়ে খুলে দেওয়ার পথ তৈরি হলেও নতুন করে এই আলোচনায় মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো নিয়ে আবারও শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads