• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

বাংলাদেশ

টার্গেট কিলিং আতঙ্কে পাহাড়ি নেতারা

  • প্রকাশিত ০৬ মে ২০১৮

জীতেন বড়ুয়া, খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি

পার্বত্য চট্টগ্রামে শুরু হয়েছে চারটি পাহাড়ি সংগঠনের ভয়াবহ টার্গেট কিলিং। বাড়ছে লাশের মিছিল। খুন-পাল্টা খুনে ব্যবহূত অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানিতে আতঙ্কের জনপদ এখন পার্বত্য চট্টগ্রাম। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে, জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ, জেএসএস এমএনলারমা গ্রুপ ও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক- এ চারটি পাহাড়ি সংগঠন কার্যত একে অপরকে আধিপত্য রক্ষার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।

গোপন সূত্রে জানা গেছে, টার্গেট কিলিংয়ের আতঙ্কে রয়েছেন ইউপিডিএফ সমর্থিত খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান চঞ্চুমনি চাকমা, পানছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সর্বোত্তম চাকমা, পাহাড়ের একাধিক উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যানসহ চার সংগঠনের হেভিওয়েট নেতারা। এ বিষয়ে মতামত জানতে সদর উপজেলা ও পানছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যানের একাধিক নাম্বারে মুঠোফোনে বার বার চেষ্টা করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চার পাহাড়ি সংগঠনের সমর্থিত নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউপি চেয়ারম্যানরা বর্তমানে নিজ নিজ নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাইরে কোথাও আমন্ত্রণ, নিমন্ত্রণ থাকলেও সেগুলো বাতিল করছেন। নিজ ঘরেও অবস্থান নিচ্ছেন না একাধিক জনপ্রতিনিধি। মুঠোফোনও বন্ধ অনেকেরই।

বেসরকারি হিসাবে, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে গত ৫ মাসে টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয়েছেন অন্তত ১৮ নেতাকর্মী। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন এমএন লারমা গ্রুপের নেতা নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তার সহযোগী রূপম চাকমা। শক্তিমানের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে পরদিনই মহালছড়ির বেতছড়িতে খুন হন ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দলের আহ্বায়ক তপন জ্যোতি চাকমাসহ ৪ নেতাকর্মী ও মাইক্রোচালক মো. সজীব।

ফিরে দেখা রক্তাক্ত পাহাড় : গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালের ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম (শান্তিচুক্তি) চুক্তির পর থেকে চলতি বছরের ৪ মে পর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলায় সামাজিক অপরাধের বাইরে খুন হয়েছে ২ হাজার ২৩৯ জন। অপহূত হয়েছে ২ হাজার ৩৯৬ জন। নিহতের বেশিরভাগই বাঙালি। বাঙালিরা খুন হয়েছেন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও চাঁদাবাজির জের ধরে এবং অধিকাংশই পাহাড়িদের হাতে। আর নিহত পাহাড়িদের অধিকাংশই অন্তঃকোন্দলে।

গত বছরের ৫ ডিসেম্বর রাঙামাটিতে অনাধি রঞ্জন চাকমা (৫৫) নামে ইউপিডিএফ সমর্থক ইউপি সদস্যকে হত্যা করা হয়। এ হত্যার জন্য নতুন গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফকে দায়ী করে পুরাতন ইউপিডিএফ। সেদিন সকালে অনাধিকে চিরঞ্জীব দোজরপাড়া এলাকার নিজ বাসা থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। একই দিন রাঙামাটির জুরাছড়িতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অরবিন্দ চাকমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আওয়ামী লীগ এ হত্যাকাণ্ডের জন্য সন্তু লারমার জেএসএসকে দায়ী করে। এক দিন পরই ৭ ডিসেম্বর রাঙামাটি শহরে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহসভানেত্রী ঝর্ণা খীসার বাসায় হামলা চালিয়ে তাকে কুপিয়ে জখম করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর রাঙামাটি সদর উপজেলার বন্দুকভাঙ্গায় ইউপিডিএফকর্মী ও সংগঠক অনল বিকাশ চাকমাকে হত্যা করা হয়। ইউপিডিএফ এ হত্যাকাণ্ডের জন্যও নতুন ইউপিডিএফকে দায়ী করে। ৩ জানুয়ারি বিলাইছড়ি উপজেলায় যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিশ্বরায় তংচঙ্গ্যাকে গুলি করা হলে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এ ঘটনার জন্য জনসংহতিকে দায়ী করা হয়। একই দিন খাগড়াছড়ি জেলা শহরে স্লুইসগেট এলাকায় প্রকাশ্যে হত্যা করা হয় ইউপিডিএফের শীর্ষ নেতা মিঠুন চাকমাকে। এ হত্যার জন্যও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিককে দায়ী করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় সুভাষ চাকমা নামে এক ইউপিডিএফ কর্মী গুলিতে নিহত হন। ১৭ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি শহরের হরিনাথপাড়া এলাকায় দীলিপ কুমার চাকমাকে হত্যা করা হয়। তিনি ইউপিডিএফের সাংগঠনিক দায়িত্বে ছিলেন। ১১ মার্চ বাঘাইছড়িতে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় ইউপিডিএফ কর্মী নতুন মনি চাকমাকে। ১৮ মার্চ রাঙামাটির কুতুছড়ি থেকে অপহরণ করা হয় ইউপিডিএফ সমর্থিত হিল উইমেন্স ফেডারেশন নেত্রী মন্টি চাকমা ও দয়াসোনা চাকমাকে। ৩২ দিন পর মুক্তি পান তারা। ১২ এপ্রিল পাল্টাপাল্টি হামলায় মারা যান তিনজন। রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলায় ইউপিডিএফ কর্মী জনি তঞ্চঙ্গ্যাকে (৪০) হত্যার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জেএসএসের (এমএন লারমা) সাধন চাকমা (৩০) ও কালোময় চাকমাকে (২৯) হত্যা করা হয়। ১৬ এপ্রিল ইউপিডিএফের দুই অংশের বিরোধে খাগড়াছড়ি শহরের পেরাছড়া এলাকায় সন্ত্রাসী হামলায় সূর্য বিকাশ চাকমা নামে একজন নিহত হন। ২২ এপ্রিল খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার মরাটিলা এলাকায় ইউপিডিএফ ও জেএসএসের (এমএন লারমা) মধ্যে গোলাগুলিতে সুনীল বিকাশ ত্রিপুরা (৪০) নামে এক ইউপিডিএফ নেতা নিহত হন।

সর্বশেষ নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান জেএসএসের (এমএন লারমা) অন্যতম শীর্ষ নেতা শক্তিমান চাকমার পরদিনই নিহত হন ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের অন্যতম শীর্ষ নেতা তপন জ্যোতি চাকমা বর্মা, একই দলের নেতা সুজন চাকমা, সেতুলাল চাকমা, টনক চাকমা এবং তাদের গাড়িচালক। শনিবার নিহতদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বরিশালে নিয়ে দাফন করা হয় চালক সজীবকে।

জানা যায়, শান্তিচুক্তির পর ২০১৫ সালে জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফের মধ্যে অলিখিত সমঝোতা হলে সংঘাত বন্ধ থাকে। কিন্তু ২০১৭ সালে ১৫ নভেম্বর ইউপিডিএফ ভেঙে গণতান্ত্রিক ইউপিডিফের জন্ম হয়। নবগঠিত ইউপিডিএফের হাতে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে ৪ মে পর্যন্ত আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে উভয় পক্ষের অন্তত ৩৫ জন নিহত হয়েছে।

চার সংগঠনে অস্থির পার্বত্য চট্টগ্রাম : দীর্ঘ দুই দশকের সশস্ত্র সংঘাত নিরসনে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলে সবার প্রত্যাশা ছিল পাহাড়ে প্রতিষ্ঠিত হবে বহু কাঙ্ক্ষিত শান্তি। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের সময় পাহাড়িদের একটি অংশ এর বিরোধিতা করে ইউনাইটেড পিপলস অব ডেমোক্র্যাটিকস ফ্রন্ট ইউপিডিএফ নামে আরেকটি সংগঠনের জন্ম দেয়। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রসীত বিকাশ খীসা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সন্তু লারমার একক নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে জনসংহতি সমিতি ভেঙে জেএসএস এমএন লারমা নামে আরেকটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। ইউপিডিএফ ভেঙে ২০১৭ সনের ১৫ নভেম্বর জন্ম নেয় গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ নামে আরেকটি সংগঠন। সংগঠনগুলোর ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে প্রতিনিয়ত সবুজ পাহাড় রক্তে লাল হয়ে উঠছে। অস্ত্রধারীদের হাতে জিম্মি হয়ে আছে পার্বত্য এলাকার প্রতিটি পাহাড়ি ও বাঙালি পরিবার।

কিলিং মিশনে অবৈধ অস্ত্র : ইউপিডিএফ ভেঙে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠার ৫ মাসের মাথায় পাহাড়ে কিলিং মিশনে বাড়ছে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার। প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে শুধু খাগড়াছড়িতেই অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হয়েছে প্রায় ২৪টি। আর চলতি বছরের জানুয়ারিতেই তিনবার অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। তবে অধিকাংশ আসামিই বর্তমানে জেলহাজতের বাইরে রয়েছে।

ইউপিডিএফ নেতা নিরন চাকমা বলেন, ‘পাহাড়ের সমস্যা রাজনৈতিক। সংঘাতের জন্য সন্তু লারমা দায়ী। তিনি সরকারের এজেন্ট। আগে সরকার তার নিজস্ব বাহিনী দিয়ে যা করত, এখন সন্তু লারমাকে দিয়ে তা করানো হচ্ছে।’

রাঙামাটির পুলিশ সুপার আলমগীর কবির বলেন, ‘আঞ্চলিক দলগুলোর সশস্ত্র তৎপরতা ও বেপরোয়া হত্যার ঘটনাকে সরকার গুরুত্বসহকারে নিয়েছে। এখন সরকার যেভাবে নির্দেশনা দেবে, সেভাবেই পদক্ষেপ।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads