• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
৩০ সিন্ডিকেটে স্বর্ণপাচার

সংগৃহীত ছবি

বাংলাদেশ

৩০ সিন্ডিকেটে স্বর্ণপাচার

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ১৫ মে ২০২২

বাংলাদেশ বিমানকে ঘিরে স্বর্ণপাচারের শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। উদ্ধার হওয়া স্বর্ণের ৭৩ ভাগই বাংলাদেশ বিমানে বহন করা হয়েছে। সম্প্রতি এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিমানকে ব্যবহার করে ৩০টি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। এর মধ্যে ৭টি বিদেশি। আর শাহজালাল বিমানবন্দরকেন্দ্রিক রয়েছে ১১টি।

৩০ সিন্ডিকেটে স্বর্ণপাচার : দেশের তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে ৩০টি সিন্ডিকেট স্বর্ণ পাচার করে থাকে। এর মধ্যে ৭টি বিদেশি সিন্ডিকেট রয়েছে। দেশের ২৩টি সিন্ডিকেটের মধ্যে ১১টি সরাসরি আর ১২টি মানি এক্সচেঞ্জের আড়ালে। ১১টি দেশি সিন্ডিকেটের মধ্যে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘিরেই রয়েছে ৭টি। বাকি ৪টির মধ্যে ৩টি চট্টগ্রামের শাহআমানত বিমানবন্দর ও ১টি রয়েছে সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরকে ঘিরে।

স্বর্ণপাচার নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। সমপ্রতি তৈরি করা এই প্রতিবেদনটিতে স্বর্ণপাচারকারী সিন্ডিকেট কারা জড়িত তার বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিকট প্রেরণ করা হয়েছে।

গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ সকল সিন্ডিকেটের মূলহোতারা দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। কিছু দেশীয় সিন্ডিকেট বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় স্বর্ণের চালান বিমানবন্দর থেকে পার করে দেন। আর এর বিনিময়ে মাসিক অথবা প্রতি বার অনুযায়ী উৎকোচ গ্রহণ করেন।

প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, দেশে মানি এক্সচেঞ্জের আড়ালে স্বর্ণপাচার করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে আলামিন মানি এক্সচেঞ্জ, ফারহান মানি এক্সচেঞ্জ, অনিক মানি এক্সচেঞ্জ, ঢাকা মানি এক্সচেঞ্জ, প্যারামাউন্ট মানি এক্সচেঞ্জ ও জাকির মানি এক্সচেঞ্জ। এর মধ্যে ফারহান মানি এক্সচেঞ্জের মালিক হারুনুর রশিদ গোয়েন্দা পুলিশের হাতে একবার আটকও হয়েছিলেন।

বিদেশে যেগুলো মানি এক্সচেঞ্জ রয়েছে এর মধ্যে হলো আলামিন মানি এক্সচেঞ্জের মালিক মামুন আল আজাদ ওরফে সুমন। গত ২ বছর আগে বিদেশি অর্থসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। পরবর্তীতে জামিন নিয়ে সে দুবাই অবস্থান করছে। দুবাইয়ে শফিউল আজম পিন্টু নামের আরেক ব্যক্তি বিভিন্ন নামে প্রতিষ্ঠান দিয়ে এই স্বর্ণ পাচার করে থাকেন। দুবাইয়ের এমরান মানি এক্সচেঞ্জের মালিক এমরান হোসেন স্বর্ণ চোরাচালানের একজন গডফাদার হিসেবে পরিচিত। দুবাই থেকে যেসব স্বর্ণ দেশে আসে তার অধিকাংশই তিনি পাচার করে থাকেন। আর সব লেনদেনের হিসাবনিকাশও হয় তার প্রতিষ্ঠান থেকে। বিমানের অনেক সদস্য দুবাই গিয়ে তার আতিথেয়তায় থাকেন। শাহীন নামের আরেক ব্যক্তি। যিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ছদ্মনাম ব্যবহার করে স্বর্ণ পাচার করে থাকেন। হাসান ও আব্বাস চট্টগ্রামের শাহআমানত বিমানবন্দর ব্যবহার করে যেসব স্বর্ণপাচার হয় তা তাদের নেতৃত্বে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে যে ১১টি স্বর্ণের সরাসরি সিন্ডিকেট রয়েছে তার মধ্যে অধিকাংশই চট্টগ্রামে থাকেন। চট্টগ্রাম জুয়েলারি সমিতির সভাপতির পুত্র জসিম এই সিন্ডিকেটের অন্যতম গডফাদার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

সোনা চোরাচালানের নিরাপদ মাধ্যম বাংলাদেশ বিমান : গোয়েন্দা তথ্য বলছে, বিভিন্ন সময়ে সোনার যত বড় চালান ধরা পড়েছে তার ৭৩ ভাগই বাংলাদেশ বিমানের। গোয়েন্দাদের অভিযোগ, বিমানকর্মীদের সহযোগিতা ছাড়া উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ খুলে সোনা লুকিয়ে রেখে পাচার করা সম্ভব নয়। চোরাচালান বন্ধে এসব ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত চান শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।

২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারি। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং-৭৭৭ এর বিমান থেকে যাত্রীদের মালামাল রাখার স্থান (কার্গো হোল) থেকে ১৪ কেজি সোনা উদ্ধার করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। কালো কাপড়ে সেলাই করে সেখানে সোনার বারগুলো লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু যেখানে সোনার বারগুলো লুকিয়ে রাখা হয়েছিল সেগুলো কখনো সাধারণ যাত্রীর পক্ষে লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। ঘটনার পরদিন ১৫ জানুয়ারি সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আবুল হোসেন বাদী হয়ে দুজনের নাম উল্লেখ করে বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন। ওই দুজন হলেন বাংলাদেশ বিমানের মেকানিক এমরানুল ইসলাম ও ওসমান গনি। মামলায় বলা হয়, ‘উড়োজাহাজের টয়লেটের নিচ বরাবর কার্গো হোলের উড়োজাহাজের বডিসংলগ্ন প্লাস্টিকের প্যানেল খুলে ওই সোনা জব্দ করা হয়। আসামি এমরানুল ও ওসমান সংঘবদ্ধচক্রের অন্য সদস্যদের সহায়তায় সোনা বাইরে পাচার করতেন।

বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতি নিবন্ধন খাতা পর্যালোচনায় দেখা যায়, সে সময় বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন এমরানুল। তাকে তখন বিমানের প্রধান প্রকৌশলীর কক্ষে হাজির হতে বলা হয়। এরপর তাকে মোবাইল ফোনে ডাকা হয়। কিন্তু সেদিন তিনি সেখানে হাজির হননি।

এরপর ২০১৩ সালের জুলাইয়ে ১২৪ কেজি সোনার সবচেয়ে বড় চালানটি বাংলাদেশ বিমানেই এসেছিল। এছাড়া ২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি কাতারের দোহা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকায় আসা বাংলাদেশ বিমানের (বিজি ০২৬) একটি ফ্লাইটে অভিযান চালানো হয়। বাংলাদেশ বিমানের সিটের নিচ থেকে তখন সাড়ে সাত কেজি ওজনের স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ থেকে ৬৪ কেজি সোনা উদ্ধার করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। কাঠের চারটি ক্যারেটের কাঠামোর মধ্যে লুকিয়ে রাখা সোনার বার পাওয়া যায়। এই সোনাগুলো ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুর থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসেই (বিজি০৮৫) ঢাকা আসে।

অপরদিকে, ২০১৯ সালের ২৩ নভেম্বর ৭ কেজি ১৯০ গ্রাম সোনাসহ বিমানকর্মীকে আটক করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। একইসঙ্গে বিমানটিও জব্দ করা হয়। সেদিন দুবাই থেকে আসা বিমানের ফ্লাইটের (বিজি০৪৮) সিটের নিচে রাখা ৪ কেজি ৬৪০ গ্রাম সোনার বার পাওয়া যায়। একইদিনে আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সের বহিরাংশসংলগ্ন রানওয়ে এলাকায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের টেকনিক্যাল হেলপার মেহেদি হাসানের কাছ থেকে ২ কেজি ৫৫০ গ্রাম সোনা পাওয়া যায়। আর ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর আবুধাবী থেকে আসা বিমানের একটি উড়োজাহাজ থেকে ৮ কেজি ৮০০ গ্রাম সোনা উদ্ধার করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। উড়োজাহাজটির সিটের নিচের পাইপের মধ্যে এসব সোনা লুকানো ছিল। এ ঘটনায়ও উড়োজাহাজটি জব্দ করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। এর আগে, ২০১৯ সালের ১৩ জুলাই শাহজালাল বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গার গেটের কাছ থেকে বিমানের ট্রাফিক হেল্পার এমদাদ হোসেন চৌধুরী ও তার সহযোগী আব্দুর রহিমকে ৪ কেজি সোনাসহ আটক করেন বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের সদস্যরা। শুধু তাই নয়, ২০১৭ সালে সোনা চোরাচালানের দায়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে ২০ লাখ টাকা জরিমানাও করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। একইসঙ্গে চোরাচালানের পণ্য বহনের দায়ে বিমানের বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ (এস২-এএইচভি) ময়ূরপঙ্খীকে বাজেয়াপ্ত করে কাস্টমস। তবে ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়ে উড়োজাহাজটি অবমুক্তির সুযোগ দিয়েছিল কাস্টমস। এভাবে বাংলাদেশ বিমানের এমন অসংখ্য ফ্লাইট থেকে সোনা উদ্ধার করেছে কাস্টমস এবং শুল্ক গোয়েন্দা। গত ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশ বিমানের শারজাহ থেকে আসা ফ্লাইটের স্পর্শকাতর স্থান থেকে ১০ কেজির ওপরে স্বর্ণ জব্দ করা হয়।

বিভিন্ন এয়ারলাইনস ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, সাধারণত বিমান উড্ডয়নের ৩০ মিনিট আগে সব যাত্রীকে একসাথে বিমানের উঠানো হয়। ফলে কোনো যাত্রীর পক্ষে বিমানের ভেতরে সোনা লুকানো সম্ভব নয়। ফলে গোয়েন্দারা আশংকা করছেন, বিমানের কোনো না কোনো কর্মকর্তার সহযোগিতায় বিমানের ভেতরে সোনা লুকিয়ে রাখা হয়, এরপর সেগুলো পাচার হয়ে থাকে। আর এসব বিষয় উল্লেখ করে গত বছরের আগস্টে নিরাপদ তদন্ত চেয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি লেখে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।

শুল্ক গোয়েন্দার হিসাবে, আটকের চেয়ে সোনা চোরাচালান হয়েছে অনেক বেশি। আবার সোনা উদ্ধারে বেশিরভাগ সময়ই সহযোগিতা পাওয়া যায় না বিমানের। ধরা পড়লেও যথাযথ ব্যবস্থা নেয় না বিমান কতৃপক্ষ।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আব্দুর রউফ বলেন, সোনা চোরাচালানের সঙ্গে অনেক অবৈধ কাজ জড়িত। এর পেছনে অনেক কাজ হয়। খুব কম পরিমাণ সোনা দিয়ে অনেক বড় বড় কাজ করা যায়। যার প্রদর্শনও খুব কম। ফলে অবৈধ কাজে সোনা বেশি ব্যবহার হয়।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads