• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

পুঁজিবাজার

শেয়ার কারসাজি

মুন্নুকে দিতে হবে ১৫ কোটি টাকা জরিমানা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১

কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করার অভিযোগের প্রমাণ পেয়ে মুন্নু ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনকে করা জরিমানার ১৫ কোটি টাকা পরিশোধ করতেই হচ্ছে। ২০১৯ সালে মুন্নু সিরামিক ও মুন্নু স্টাফলারের (বর্তমানে মুন্নু অ্যাগ্রো) শেয়ারের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এই জরিমানা করে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে ফাউন্ডেশন। কিন্তু বিএসইসি সেই আবেদন নাকচ করে দিয়েছে।

সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম বলেন, বিষয়টি যেহেতু তদন্তের বিষয়ে ছিল সেহেতু এটি ইনফোর্জমেন্ট বিভাগের। সেখান থেকে সবকিছু করা হয়েছে। তাদের জরিমানা করাসহ জরিমানা মওকুফ না হওয়ার বিষয়টিও সেখানেই সিদ্ধান্ত হয়েছে।

মুন্নু সিরামিকের কোম্পানি সচিব নাসির উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আমার কাছে তেমন কোনো তথ্য নেই। আমি খোঁজ নিয়ে জানাতে পারব। যে সময় কোম্পানিটিকে বিএসইসি জরিমানা করেছিল সে সময় তিনি বলেছিলেন, আমাদের মূল উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে মুন্নু ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, যেখানে মুন্নুর সিংহভাগ শেয়ার রয়েছে। সাত লাখ শেয়ার পাবলিক মার্কেটে বিক্রি করা হয়েছে। তবে পরবর্তীতে যে ২৮ লাখ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল তার পুরোটি বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। তবে আমরা যা করেছি বিএসইসিকে জানিয়ে করেছি।

বিএসইসি জরিমানার সিদ্ধান্ত নিলেও সেখানে কোনো অনিয়ম হয়নি বলে মনে করেন মুন্নুর কোম্পানি সচিব। বলেন, ২৮ লাখ শেয়ার ব্লক মার্কেটে বিক্রি করা হয়েছে। ফলে এখানে কারসাজি বা অন্যায়ের কী হয়েছে তা বোধগম্য নয়।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের পক্ষ থেকে শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত থাকলে আগাম ঘোষণা থাকতে হয়। কিন্তু বিএসইসি ঘোষণা ছাড়া শেয়ার বিক্রির প্রমাণ পায়। এ জন্য কোম্পানির করপোরেট উদ্যোক্তা মুন্নু ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন শেয়ার বিক্রির তথ্য পর্যালোচনা করে মুন্নু সিরামিক, ফাউন্ডেশন ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়।

তারই অংশ হিসেবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কমিশনের ৭৬১তম কমিশন সভায় কোম্পানিটিকে ১৫ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়।

বিএসইসি তদন্ত করে দেখতে পায় মুন্নু সিরামিকের শেয়ার কারসাজি করে ১১ গুণ বেশি দামে শেয়ার বিক্রি করেছে ফাউন্ডেশন। পরে এই বর্ধিত দামে কোম্পানির ১৩১ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করে মুন্নু ওয়েলয়েফার ফাউন্ডেশন।

মোট ৩৫ লাখ শেয়ার বিক্রি করা হয় সে সময় অভিহিত মূল্যে, যার দাম সাড়ে তিন কোটি টাকা। অর্থাৎ কোম্পানিটির লাভ হয়েছে ১২৮ কোটি টাকার মতো। দাম বাড়ানোর আগে যদিও প্রতিটি শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ৪০ টাকার মতো। কিন্তু সেই শেয়ার বিক্রি করা হয় ৪০০ টাকারও বেশি দামে। এই হিসাব করা হলে কোম্পানির লাভ হয়েছে ১০০ কোটি টাকার কিছু বেশি।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির তদন্তে বের হয়ে এসেছে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য গোপনে ফাঁস করে, হিসাব বাড়িয়ে দেখিয়ে কারসাজি করে মুন্নুর দুটি কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বাড়ানো হয় সে সময়।

ওই বছরে ৪০ টাকার মুন্নু সিরামিকের দাম কারণ ছাড়াই বেড়ে হয় ৪৪১ টাকা। বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হচ্ছে ১৫৯ টাকা ৯০ পয়সা। দুই বছরের তদন্ত শেষে ফাউন্ডেশনকে ১০ কোটি টাকা আর মুন্নু সিরামিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ সমস্ত পরিচালককে (স্বতন্ত্র পরিচালক বাদে) ১ কোটি টাকা করে জরিমানা করে বিএসইসি। অর্থাৎ মোট জরিমানা ১৫ কোটি টাকা। আফরোজা খান রিতা এই কোম্পানিটির মালিক।

ওই সময় একই কোম্পানির মালিকানাধীন আরেক কোম্পানি মুন্নু স্টাফলার, যা পরিবর্তীতে হয় মুন্নু এগ্রো অ্যান্ড জেনারেল মেশিনারির দাম ৩৫০ টাকা থেকে বেড়ে সে সময় হয় পাঁচ হাজার ৮০০ টাকায়। এই কোম্পানিটি পড়ে প্রতি দুটি শেয়ারের বিপরীতে তিনটি বোনাস শেয়ার দেয়। কিন্তু দর ধরে রাখতে পারেনি। এখন শেয়ারটির দাম ৭৭৫ টাকা ৫০ পয়সা। দাম সর্বোচ্চ পরিমাণে বাড়ার পর মুন্নু সিরামিকের বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেয় মুন্নু ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন। ২০১৯ সালের ৪ মার্চ ঘোষণা আসে মুন্নু সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজের করপোরেট ডিরেক্টর মুন্নু ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন তাদের কাছে থাকা মুন্নু সিরামিকের এক কোটি ৪২ লাখ ৪০ হাজার ৩৩০টি শেয়ার থেকে সাত লাখ শেয়ার পাবলিক মার্কেটে বাজার দরে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে বিক্রি করা হবে। তার ৫ কার্যদিবসে বিক্রি হয়ে যায় ৭ লাখ শেয়ার। এই সময়ে অর্থাৎ ৪ মার্চ কোম্পানির শেয়ারে সর্বোচ্চ দর ছিল ৪৪১ টাকা। এটাই মুন্নু সিরামিকের গত দুই বছরের সর্বোচ্চ দর। তার এক দিন পর ৫ মার্চ শেয়ার প্রতি দর ছিল ৪৩০ টাকা। ৬ তারিখে দর হয়ে ৪১৭ টাকা। আর ৭ মার্চ দর কমে হয় ৩৮৮ টাকা। ৮ ও ৯ মার্চ সরকারি ছুটি থাকায় লেনদেন হয়ে ১০ মার্চ। সেদিন ৪১০ টাকা ২০ পয়সা।

এ সময় কোম্পানিটির গড় দর ছিল ৪১৭ টাকা। এই হিসাবে সাত লাখ শেয়ার বিক্রি করা হয় ২৯ কোটি ২০ লাখ ৪০ হাজার টাকায়।

১১ মার্চ আবারও ঘোষণা করা হয় মুন্নু ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন ২৮ লাখ শেয়ার বিক্রি করবে হাতে থাকা এক কোটি ৩৫ লাখ ৪০ হাজার ৩৩০টি শেয়ারের মধ্যে। সেদিন সর্বোচ্চ দর ছিল ৩৬৯ টাকা ১০ পয়সা। এভাবে ২৮ লাখ শেয়ারের দাম আসে ১০৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা।

অর্থাৎ মুন্নু সিরামিকের ৩৫ লাখ শেয়ার বিক্রি করে ১৩১ কোটি টাকার মতো আয় করে মুন্নু ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন। লেনদেনের হিসাবেও দেখা গেছে, ৪ মার্চ মুন্নু সিরামিকের মোট লেনদেন হয়েছে সবচেয়ে বেশি ২১ লাখ ৮৮ হাজার ৩৫৯টি। আর ৫ মার্চ লেনদেন হয়েছে ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৭৯১টি। ছয় মার্চ লেনদেন হয়েছে ৭ লাখ ৯২ হাজার ৬১৭টি। এই কোম্পানির আহামরি কোনো লভ্যাংশ দেয়ার ইতিহাস নেই। কোম্পানিটি ২০১৭ সালে ৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। ২০১৮ সালে ৩০ শতাংশ বোনাস আর ২০১৯ সালে ১০ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ প্রদান করে। কারসাজি করে শতাধিক কোটি টাকা মুনাফা করলেও সাত ভাগের এক ভাগ জরিমানা করা নিয়ে প্রশ্ন ছিল আগে থেকেই।

এভাবে শাস্তি দিলে কোনো লাভ হবে কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বিএসইসি থেকে বলা হয়েছে, আইন অনুযায়ী যতটুকু করা যায়, ততটুকুই শাস্তি দেয়া হয়েছে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক দেবপ্রিয় সরকার বলেন, এই ধরনের কারসাজিতে অবশ্যই আরও বেশি জরিমানা করা উচিত। কিন্তু আইনে যেহেতু সর্বোচ্চ এটাই বলা আছে, তাই এর চেয়ে বেশি জরিমানা করলে হয়তো আদালতে গিয়ে আটকে যেতে পারত।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ তুলেছেন আরেক প্রশ্ন। তিনি বলেন, যে কোম্পানির কিছুই নেই, বছরে ভালো লভ্যাংশ দিতে পারে না, সেই কোম্পানির শেয়ার কেন ৪০০ টাকায় কিনবে। এ ধরনের কোম্পানির শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদেরও সচেতন হওয়া উচিত।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads