• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

পুঁজিবাজার

দরপতনে আতঙ্ক পুঁজিবাজারে

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৯ এপ্রিল ২০২২

চরম ক্রেতা সংকট দেখা দিয়েছে দেশের পুঁজিবাজারে। অনেকে দাম কমিয়ে লোকসানে শেয়ার বিক্রির চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছেন। ফলে একের পর এক বড় দরপতনের ঘটনা ঘটছে। সেই সঙ্গে দেখা দিয়েছে লেনদেন খরা। চলতি সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস গত রোববার এক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেনের ঘটনা ঘটার পর গতকাল সোমবার দরপতনের বিরল দৃশ্য দেখলেন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা।

এদিন এক দিনে ৩৪৭টি কোম্পানির একসঙ্গে দরপতন হয়েছে। ২০১০ সালের মহাধসের পর এমন দৃশ্য দেখা যায়নি সেভাবে। এমনকি গত বছরের ৪ এপ্রিল লকডাউনে লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার আতঙ্কে যেদিন ১৮২ পয়েন্ট সূচক পড়েছিল, সেদিনও এত বেশি কোম্পানির শেয়ারদর হারায়নি। সেদিন পড়েছিল ২৫১টির দর।

সে সময় ফ্লোর প্রাইসের কারণে অবশ্য ৬৬টি কোম্পানির দর কমার সুযোগ ছিল না। কারণ সেগুলো বেঁধে দেওয়া সর্বনিম্ন দরেই ছিল এসব কোম্পানি। শেয়ারদর প্রায় প্রতিদিন নতুন বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ সীমা ২ শতাংশ কমছে, এই অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনতে পারছেন না, আর এ কারণে কম দামে বসিয়ে বিক্রি করা যাচ্ছে না।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে দিন শেষে বেড়েছে কেবল ১৪টি কোম্পানির দর, যা গত বছরের ৪ এপ্রিলের পর এক দিনে এত কম কোম্পানির দর বাড়েনি। সেদিন লকডাউন আতঙ্কে কেবল সাতটি কোম্পানির দর বেড়েছিল।

বেলা শেষে ১৯টি কোম্পানির দর অপরিবর্তিত ছিল। এর মধ্যে দুটির দর আসলে কমার সুযোগ ছিল না। কারণ এর শেয়ারদর ৪ টাকা ৯০ পয়সা। বিএসইসির দরপতনের ২ শতাংশ নীতিমালার কারণে এর দর আসলে কমা সম্ভব নয়।

সকাল ১০টায় লেনদেন শুরু হতে না হতেই বাজার নিম্নমুখী হয়ে যায়। যত বেলা গড়ায়, সূচক কমে তত বেশি। একপর্যায়ে ৮৩ পয়েন্ট কমে যায় লেনদেন শেষের ১৫ মিনিট আগে। দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ২ শতাংশ থাকায় সূচকের পতন এর চেয়ে বেশি হওয়া সম্ভব কি না, তা নিয়ে আছে প্রশ্ন।

তবে শেষ ১৫ মিনিটে সেখান থেকে কিছুটা বেড়ে শেষ পর্যন্ত ৭২ পয়েন্ট কমে লেনদেন শেষ হয়। দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ২ শতাংশ বেঁধে দেওয়ার পর এটাই পুঁজিবাজারে সর্বোচ্চ পতন।

গতকাল এই সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত দর কমে লেনদেন হয়েছে আড়াই শরও বেশি কোম্পানির শেয়ার। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর পর থেকে পুঁজিবাজার ধস দেখা দেওয়ায় বাজারে তারল্য বাড়াতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি নানা চেষ্টা করেছে। পাশাপাশি এক দিনে দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ২ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়।

দরপতন ঠেকানোর এই চেষ্টার পাশাপাশি বাজারে তারল্য বাড়াতে নানা চেষ্টা করে বিএসইসি। এই লক্ষ্যে প্রথমে ব্যাংক, পরে মিউচুয়াল ফান্ড পরিচালনাকারী সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি, এরপর মার্চেন্ট ব্যাংক, স্টক ডিলারসহ বাজার মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে বৈঠক হয়।

গত ৯, ১০ ও ৩০ মার্চের এই বৈঠক শেষে সব পক্ষই বাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর অঙ্গীকার করে। ৩৩টি ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে বলা হয়, যেসব ব্যাংকের বিনিয়োগ তাদের মূলধনের ২৫ শতাংশের নিচে রয়েছে, তারা কয়েক দিনের মধ্যে ২ শতাংশ বিনিয়োগ বাড়াবে। এতে শেয়ারবাজারে তারল্যপ্রবাহ বাড়বে।

ব্যাংকগুলোর জন্য ঘোষিত ২০০ কোটি টাকার ফান্ড এখনো যেসব ব্যাংক গঠন করেনি, তারা তা করবেন বলে আজকের সভায় জানিয়েছেন। এরপর সক্ষমতা অনুযায়ী তারা বিনিয়োগ করবেন। এ ছাড়া যারা ফান্ড গঠন করে এখনো বিনিয়োগ করেননি, তারা বিনিয়োগ করবেন।

পরদিন মিউচুয়াল ফান্ড পরিচালনাকারী সম্পদ ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে বৈঠক শেষেও বিনিয়োগ বাড়ানোর অঙ্গীকার করা হয়।

আবার রোজার আগে বৈঠক শেষে বলা হয়, রোজায় মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো ৩০০ কোটি টাকা আর প্রতিটি স্টক ডিলার অ্যাকাউন্ট থেকে ১ কোটি করে আড়াইশ কোটি টাকা লেনদেনের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ছিল। এ ঘোষণার পর রোজা আসার শেষ কর্মদিবসে লেনদেন বেড়ে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা ছাড়ায়।

কিন্তু রমজানের প্রথম দিন থেকেই লেনদেন ক্রমেই কমতে থাকে। এতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বাজারে প্রভাব রাখতে পারে, এমন কোনো পক্ষ আসলে বিনিয়োগে যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে ব্যক্তিশ্রেণির বড় বিনিয়োগকারীরাও হাত গুটিয়ে বসে আছেন।

এমন অবস্থান লেনদেন বাড়াতে আপাতত আর কোনো উদ্যোগ নিতে চায় না বিএসইসি। সংস্থাটির কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, এখন আমরা চিন্তা করছি, মার্কেট নিজ গতিতে পুনরায় ফিরে আসবে।

এ বিষয়ে মিয়া আব্দুর রশিদ সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপক শেখ ওহিদুজ্জামান স্বাধীন বলেন, বাজারে বায়ার নেই। এই বাজারেই ২ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়, কিন্তু এখন সেটি ৪০০ কোটির নিচে। তার মানে শেয়ার কিনছে না। নিশ্চয়ই এখানে কোনো কারণ আছে।

তিনি বলেন, হয়তো নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে বাজারের বড় বিনিয়োগকারী বা যারা প্রভাব রাখতে পারেন তাদের মতের মিল হচ্ছে না, অথবা তারা যেটা চাইছেন সেটা হচ্ছে না। যার কারণে ব্যাপক দরপতনে ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না।

বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বলাবলি হচ্ছে যে বাজার পতন ২০১০ সালের মহাধসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কি না।

তবে মহাধসের আগে বাবল তৈরি হলেও এবার সেটি হয়নি। ২০২০ সালের মাঝামাঝি থেকে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুঁজিবাজার চাঙা থাকলেও শত শত কোম্পানির শেয়ারদর ছিল অবমূল্যায়িতই।

সূচক পতনে দায়ী শীর্ষ দশ কোম্পানির সবগুলো বড় মূলধনি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬.৯৯ পয়েন্ট সূচক কমিয়েছে গ্রামীণ ফোন। কোম্পানিটির ১.০২ শতাংশ দরপতনে এই পয়েন্ট কমেছে।

৫.৩২ পয়েন্ট সূচক পড়েছে ওয়ালটন হাইটেকের দর পতনে। কোম্পানির প্রতিটি শেয়ারের দাম কমেছে ১.০৩ শতাংশ।

তৃতীয় সর্বোচ্চ ৩.৮৫ পয়েন্ট কমেছে বেক্সিমকো লিমিটেডের কারণে। দিন শেষে কোম্পানির দর কমেছে ১.৯৫ শতাংশ।

এছাড়া ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর দরপতনে ৩.৬৪ পয়েন্ট, লাফার্জ ২.৭৩ পয়েন্ট, আইসিবি ২.২৭ পয়েন্ট, ইউনাইটেড পাওয়ার ২.২৭ পয়েন্ট, বেক্সিমকো ফার্মা ২.১৭ পয়েন্ট, স্কয়ার ফার্মা ১.৯৫ পয়েন্ট ও রবির দর হ্রাসে সূচক পড়েছে ১.৬৪ পয়েন্ট। অর্থাৎ এই ১০টি কোম্পানিই সূচক ফেলেছে ৩২.৮৩ পয়েন্ট।

অন্যদিকে সূচকে কোনো কোম্পানি এক পয়েন্ট যোগ করতে পারেনি। সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট যোগ করেছে ধারাবাহিকভাবে দর বাড়তে থাকা জেএমআই হসপিটালের কারণে। কোম্পানিরটির ৭.৯৬ শতাংশ দর বেড়েছে। আর এতে সূচক বেড়েছে মাত্র ০.৮৮ পয়েন্ট।

এরপরেই সূচক বাড়িয়েছে বিকন ফার্মা। কোম্পানিটি সূচক বাড়িয়েছে ০.৬২ পয়েন্ট। এদিন কোম্পানির শেয়ারদর বেড়েছে ০.৫৯ শতাংশ।

বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলসের দর ০.৭৭ শতাংশ বাড়ার কারণে সূচক বেড়েছে ০.৪১ পয়েন্ট।

এছাড়া বাটা সুজ, যমুনা ব্যাংক, বার্জার পেইন্টস, এনসিসি ব্যাংক, ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স, রেনাটা ও এক্সিম ব্যাংকের দর বাড়ার কারণে সূচকে ভগ্নাংশ পয়েন্ট যোগ হয়েছে। এই ১০ কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে মাত্র ৪ পয়েন্ট।

শীর্ষ ১০টি কোম্পানিরই দর পতন হয়েছে দিনের সর্বোচ্চ সীমায়। ক্রেতা ছিল না সবগুলোর শেয়ারের। আগের দিন ৪৫ টাকা বিক্রি হওয়া সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্সের দাম দাঁড়িয়েছে ৩৯ টাকা ২০ পয়সা। পতনের সর্বোচ্চ সীমা ২ শতাংশে দর কমে দাঁড়িয়েছে ৪৪ টাকা ১০ পয়সায়। ২ শতাংশ কমে সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইলের দাম দাঁড়িয়েছে ৯ টাকা ৮০ পয়সায়। আগের দিন হাতবদল হয়েছিল ১০ টাকায়। এরপরেই ২ শতাংশ দর কমে মীর আকতারের শেয়ারদর দাঁড়িয়েছে ৫৮ টাকা ৮০ পয়সায়, পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স হাতবদল হয়েছে ৯৩ টাকা ১০ পয়সায়, প্রাইম টেক্সটাইল ২৪ টাকা ৫০ পয়সায়, রেনউইক জ্ঞানেশ্বর ৯৫০ টাকা ৮ পয়সা, রংপুর ফাউন্ডারি ২০১ টাকা ১০ পয়সা, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স ৯৩ টাকা ২০ পয়সা ও প্রাণের দর কমে ৩১৮ টাকা ৯০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে।

লেনদেন শুরুর পর থেকেই সর্বোচ্চ সীমায় দর বাড়লেও আজ ৭.৯৬ শতাংশ দর বেড়েছে জেএমআই হসপিটালের দর। গতকাল ৫৬ টাকা ৫০ পয়সায় হাতবদল হলেও গতকাল সেটা দাঁড়িয়েছে ৬১ টাকায়। ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স ও কাট্টালি টেক্সটাইলের দর বেড়েছে ২ শতাংশ করে। হাতবদল হয়েছে ৩৩ টাকা ৭০ পয়সা ও ৩৮ টাকা ৩০ পয়সায়। এছাড়া বাটা সু, এনসিসি ব্যাংকও যমুনা ব্যাংক ১ শতাংশের বেশি। আর ডরিন পাওয়ার, বিকন ফার্মা, সিটি ব্যাংক ও বার্জার পেইন্টসের দর কমেছে এক শতাংশের নিচে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads