• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
পুঁজিবাজারে ধস

সংগৃহীত ছবি

পুঁজিবাজার

আতঙ্কে পুঁজিবাজারে ধস

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৯ জুলাই ২০২২

বড় ধরনের দরপতন হয়েছে পুঁজিবাজারে। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং ঘোষণা ও পুঁজিবাজারে কারসাজিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শাস্তি চাওয়ার খবরে এই প্রভাব পড়ে পুঁজিবাজারে। বিনিয়োগকারীদের শঙ্কা শেয়ারের দাম আরো কমতে পারে, এই ভয়ে হিড়িক পড়ে বিক্রির।

গতকাল সোমবার এক দিনে দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ২ শতাংশ ছুঁয়ে লেনদেন হয়েছে আড়াই শটিরও বেশি কোম্পানির। সব মিলিয়ে দর হারিয়েছে ৩৫২টি, বিপরীতে বেড়েছে কেবল ১৪টির দর। আর দর ধরে রাখতে পারে ১৬টি কোম্পানি। গত অর্থবছরের মতোই অর্ধবার্ষিকীতে শেয়ার প্রতি সাড়ে ১২ টাকা লভ্যাংশ ঘোষণা করা গ্রামীণ ফোনও দর হারিয়েছে। বড় মূলধনি ও মৌলভিত্তির কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো কোম্পানির দর কমেছে একদিনে যতটা কমা সম্ভব ততটাই। ৮৭ পয়েন্ট দরপতনে সূচকের অবস্থান নেমে গেছে প্রায় দুই মাস আগের অবস্থানে।

গত ২৫ মে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সাধারণ সূচক ডিএসইএক্সের অবস্থান ছিল ৬ হাজার ১৮৭ পয়েন্ট। আর সপ্তাহের দ্বিতীয় কর্মদিবস সোমবার অবস্থান দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ২১৬ পয়েন্টে। দরপতনের মধ্যেও বেশিরভাগ শেয়ারের ক্রেতা ছিল না। এর ফলে লেনদেন নেমে এসেছে একেবারে তলানিতে। কোনো রকমে পাঁচশ কোটির ঘর অতিক্রম করেছে তা। দিন শেষে লেনদেন হয়েছে ৫১৫ কোটি ২৯ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। চলতি বছর এর চেয়ে কম লেনদেন হয়েছে হাতে গোনা কয়েক দিন।

ইউক্রেনে রুশ হামলার পর পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে দেশে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে ব্যাপক হারে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ডলারের বিপরীতে মুদ্রার অবমূল্যায়ন।

বাংলাদেশে গত কয়েক মাসে মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১০ শতাংশেরও বেশি। ডলার সংকটের সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে এক বছরে সাত বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করার পর রিজার্ভ নেমে গেছে ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে। নানা পদক্ষেপে আমদানি ব্যয় কিছুটা কমলেও এই মুহূর্তে লেনদেনের ভারসাম্য বাংলাদেশের প্রতিকূলে। অর্থাৎ রপ্তানি ও রেমিট্যান্স থেকে যে আয় হয়, তার চেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে পণ্য কিনে আনতে।

পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের জ্বালানি সাশ্রয়ে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের ঘোষণা পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলেছে। এমনিতে অর্থনৈতিক চাপের কারণে নানা ধরনের গুজব ও গুঞ্জন ভেসে বেড়াচ্ছিল। তার ওপর সরকারের এই সিদ্ধান্তে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাংক এশিয়া সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী সুমন দাস বলেন, মার্কেট ধসের কারণ হলো রিটেইল বেসড মার্কেট। মানুষ আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার ছেড়ে দিয়েছে। প্যানিক সেলের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, মানি মার্কেট হার্ট হয়েছে। সাপ্লাই কম। তার ওপর মুদ্রাস্ফীতি, রিজার্ভ কমে গেছে। রিজার্ভের যে অঙ্কের কথা বলা হচ্ছে, সেটা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। বিদ্যুতের ব্যাপারে সরকার যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে সেটাও মানুষ ইতিবাচকভাবে নেয়নি। এই বিষয়গুলো সমন্বিতভাবে প্যানিক সেল বাড়িয়েছে।

প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা কি সেল প্রেসার বাড়িয়েছে, জানতে চাইলে সুমন দাস বলেন, সব জায়গা থেকেই প্রেসার আসবে। মার্জিন লোনের ফোর্স সেল আসবে।

জুলাই বা আগস্টে নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনা কতটুকু? উত্তরে ব্যাংক এশিয়া সিকিউরিটিজের সিইও বলেন, মানি মার্কেট যখন হার্ড হয় তখন অনেকটাই মুশকিল হয়। সবাই মানি মার্কেট কনসার্নড, ক্যাপিটাল মার্কেট নয়। বিনিয়োগকারীরা অনেকটা ওয়েট অ্যান্ড সি-তে চলে গেছেন। তাই বিনিয়োগ হবে কি হবে না তা বলা যাচ্ছে না।

এদিকে দেশ ও বিশ্ব অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থার পর এবার পুঁজিবাজারের কারসাজিতে জড়িতদের শাস্তি চেয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এমন খবর বাজারে ছড়িয়ে পড়লে বিনিয়োগকারীদের শঙ্কা শেয়ারের দাম আরো কমতে পারে, এই ভয়ে বিক্রির হিড়িক পড়েছে। এদিন ৩৮২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শতাধিক কোম্পানির ক্রেতাই ছিল না।

সপ্তাহের দ্বিতীয় কর্মদিবস গতকাল সোমবার ব্যাংক-বীমা আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং প্রকৌশলসহ প্রায় সব খাতের শেয়ারের দাম কমেছে। আর তাতে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক কমেছে ৮৭ পয়েন্ট। অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সূচক কমেছে ২৪২ পয়েন্ট। তাতে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি কমেছে ৫ হাজার ৮১০ কোটি ৫৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। সূচকের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে কমছে লেনদেনও। এই নিয়ে টানা পাঁচ কর্মদিবস পুঁজিবাজারে দরপতন হলো।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজার এখন নিয়ন্ত্রণ করছে কারসাজি চক্র। এ কারসাজি চক্রের হাত থেকে বাজার রক্ষা করতে আইএমএফও সরকারকে সুপারিশ করেছে। আর তাতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বড় ধরনের আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। আরো দরপতন হবে এমন ভয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই তারা শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিচ্ছেন।

গত রোববার আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলিম উল্লাহর নেতৃত্বে মন্ত্রণালয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট সহায়তা দিতে দেশের পুঁজিবাজার কারসাজিতে জড়িতদের শাস্তি চেয়েছে আইএমএফ। এছাড়াও খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে আইএমএফ পরামর্শ দিয়েছে। ব্যাংক খাতের তদারকি শক্তিশালী করার পাশাপাশি করপোরেট সুশাসন উন্নত করার তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি। ব্যাংক খাতে বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরতে আইনি সংস্কারের পরামর্শও দিয়েছে আইএমএফ। বৈঠকে খেলাপি ঋণের হিসাব পদ্ধতি সংশোধন ও খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করার বিষয়টি নিয়ে কথা তুলেছে আইএমএফ।

সার্বিক বিষয়ে ডিএসইর সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব, মুদ্রাবাজারে অস্থিরতায় বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিচ্ছেন। পাশাপাশি আইএমএফ পুঁজিবাজারে কারসাজি সঙ্গে জড়িতদের বিচার চেয়েছে। এসবের কারণে আজকে বড় দরপতন হয়েছে।

ডিএসইর তথ্য মতে, সোমবার ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতার সংখ্যা বেশি থাকার মধ্য দিয়ে দিনের লেনদেন শুরু হয়। ফলে দিনভর সূচক পতনের মধ্য দিয়ে লেনদেন হয়েছে। এদিন ডিএসইতে ৩৮২টি প্রতিষ্ঠানের ১৩ কোটি ৪২ লাখ ৬৮ হাজার ২২৬টি শেয়ার ও ইউনিট কেনা-বেচা হয়েছে। এর মধ্যে ১২টি কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে, কমেছে ৩৫৮টির, আর অপরিবর্তিত রয়েছে ১২টির দাম।

প্রায় সব কোম্পানির শেয়ারের দাম কমায় এদিন ডিএসইর প্রধান সূচক আগের দিনের চেয়ে ৮৭ দশমিক ৩৯ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ২১৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। অপর দুই সূচকের মধ্যে ডিএসইএক্স আগের দিনের চেয়ে কমেছে ১৬ দশমিক ৬১ পয়েন্ট এবং ডিএস-৩০ সূচক কমেছে ৩১ দশমিক ৭২ পয়েন্ট। আর তাতে এক দিনের ব্যবধানে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি কমেছে ৫ হাজার ৮১০ কোটি ৫৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা।

ডিএসইতে ৫১৫ কোটি ২৯ লাখ ৭৬ হাজার টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৫৯৩ কোটি ৪৯ লাখ ৮১ হাজার টাকার শেয়ার।

এ বাজারে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে ডেল্টা লাইফের শেয়ার। এরপর যথাক্রমে রয়েছে- বেক্সিমকোর শেয়ার, ফরচুন সুজ, গ্রামীণ ফোন, ওরিয়ন ইনফিউশন, কেডিএস এক্সেসরিজ, তিত্যাস গ্যাস, ব্রিটিশ অ্যামেরিকান টোবাকো, ওরিয়ন ফার্মা এবং এইচ আর টেক্সটাইল লিমিটেড।
দেশের অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ২৪২ পয়েন্ট কমে ১৮ হাজার ২৮০ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এ বাজারে ২৯৭টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ১৭টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বেড়েছে, কমেছে ২৬০টির, আর অপরিবর্তিত রয়েছে ২০টির।

এদিন সিএসইতে লেনদেন হয়েছে ১৩ কোটি ৬১ লাখ ৩৬ হাজার ৬৯৭ টাকা। এর আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ১৯ কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ১৭৯ টাকা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads