• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

যোগাযোগ

৫০ বছরে বাংলাদেশ

যোগাযোগ খাতে বিপ্লব

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ১৮ মার্চ ২০২১

বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশে সড়ক যোগাযোগ খাতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। বিশেষ করে গত এক দশকে এ খাতে ঘটেছে বিপ্লব। মাটির নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত সব জায়গায় চলছে সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নের মহা কর্মযজ্ঞ। এর মধ্যে কর্ণফুলি নদীর তলদেশে নির্মিত হচ্ছে টানেল। আর শূন্যে নির্মিত হচ্ছে উড়াল সড়ক। চ্যালেঞ্জের পদ্মা সেতু থেকে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো উন্নত দেশের মতো সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা হচ্ছে বাংলাদেশে।

নির্মিত হচ্ছে নতুন নতুন সড়ক-মহাসড়ক, ব্রিজ, কালভার্ট, উড়াল সড়ক, মেরিন ড্রাইভ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বিভিন্ন নির্মাণকাজ। অনেক কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। বেশ কিছু কাজ রয়েছে চলমান। শেষ পর্যায়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রকল্প। দেশি-বিদেশি অর্থায়নে চলছে এসব কাজ।

গত বছরের নভেম্বরে মাগুরা, নারায়ণগঞ্জ ও যশোরে তিনটি সেতু এবং পাবনায় একটি স্বাধীনতা চত্বরের উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকারে এসে সারা দেশে ব্যাপক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছে বলেই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। আরো অনেক কাজ আমরা শুরু করেছি। সেগুলোও সম্পন্ন করব।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে সারা দেশে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের আওতাধীন ২১ হাজার ৩০২ কিলোমিটার জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং জেলা সড়ক, ৪ হাজার ৪০৪টি সেতু এবং ১৪ হাজার ৮৯৪টি কালভার্ট রয়েছে। ৪ হাজার ৩৩১ কিলোমিটার মহাসড়ক মজবুতিকরণসহ ৫ হাজার ১৭১ কিলোমিটার মহাসড়ক প্রশস্তকরণ করা হয়েছে। ৪১৭ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক চারলেন বা তদূর্ধ্ব লেনে উন্নীত করা হয়েছে। এ ছাড়া সারা দেশে আরো এক হাজার ৭৫২ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করা হচ্ছে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে চার লেনে উন্নীত করা প্রতিটি সড়কেই থাকবে ধীর গতির যানবাহন চলাচলের জন্য পৃথক দুটি লেন। ইতিমধ্যে এসব সড়কের সম্ভাব্যতা যাচাই এবং পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকি সড়কগুলোর কাজও সম্পন্ন করা হবে।

দেশের অর্থনীতির লাইফ-লাইন খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়কের ১৯০ কিলোমিটার চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ, নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়ক এবং চট্টগ্রাম-হাটহাজারী সড়ক ডিভাইডারসহ চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। রংপুর মহানগরীর বিভিন্ন সড়ক চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ দৃষ্টিনন্দন মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ করা হয়েছে।

ঢাকা মহানগরীর গণপরিবহনের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে উত্তরা তৃতীয় পর্ব হতে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। মেট্রোরেল নির্মিত হলে উভয়দিকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী চলাচল করতে পারবেন। এ ছাড়া মেট্রোরেল রুট-১ ও রুট-৫ এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে।

ধীর গতির যানবাহনের জন্য পৃথক লেনসহ ঢাকা-মাওয়া-পাচ্চর-ভাঙ্গা মহাসড়ক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় চার লেনে উন্নীতকরণ কাজ শেষ হয়েছে। এটি দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে।

এডিবির অর্থায়নে জয়দেবপুর-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ কাজ এগিয়ে চলেছে। গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত দ্রুত গতির বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি রুট নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে।

হযরত শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত ৮৭০৩.১১ কোটি টাকা ব্যয়ে র্যাম্পসহ প্রায় ৪৬.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রকল্পের নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে।

জাইকার ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়কে চার লেনবিশিষ্ট দ্বিতীয় কাঁচপুর, দ্বিতীয় মেঘনা ও দ্বিতীয় গোমতী সেতুর নির্মাণকাজও শেষ হয়েছে। বরিশাল-পটুয়াখালী জাতীয় মহাসড় অংশে পায়রা নদীর ওপর চার লেনবিশিষ্ট পায়রা সেতু, তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুসহ বেশ কিছু সেতুর নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে।

এ ছাড়া কর্ণফুলি নদীতে টানেল নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া, বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। উত্তরা থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ফেনীতে ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্প, মেট্রোরেলের কাজ শুরু করাসহ অনেকগুলো উন্নয়নকাজ সরকারের বড় সাফল্য। এর বাইরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণ, পার্বত্য তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের যোগাযোগব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়নও সরকারের অন্যতম সাফল্য।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠনের পর সবার আগে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল সারা দেশের যোগাযোগব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নে। এর মধ্যে তৎকালীন সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প। মহাজোট সরকারের প্রথম দিকেই পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে হাত দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এবং জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করার কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নিয়মিত মনিটরিংয়ের কারণে ইতিমধ্যে জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করার কাজ শেষ পর্যায়ে। এর বাইরে চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। সূত্র জানায়, আগামী কয়েক বছরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ২২৬ কিলোমিটার, সিলেট-তামাবিল স্থলবন্দর সড়ক, দৌলতদিয়া-মাগুরা-ঝিনাইদহ-যশোর-খুলনা-মোংলা পর্যন্ত ২১২ কিলোমিটার মহাসড়ক, হাটিকুমরুল-রংপুর-বুড়িমারী স্থলবন্দর পর্যন্ত ১৫৭ কিলোমিটার মহাসড়ক এবং টেকেরহাট-কুয়াকাটা মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হবে।

এদিকে, চট্টগ্রামের কর্ণফুলি নদীতে নির্মাণ করা হচ্ছে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার টানেল। যার অর্ধেকের বেশি কাজ শেষ হয়েছে। এর এক প্রান্তে পতেঙ্গার নেভাল একাডেমি থেকে শুরু হয়ে পথটি কাফকো ও সিইউএফএল সীমানার মাঝখান দিয়ে উঠে কর্ণফুলি-আনোয়ারা প্রান্তে সংযোগ ঘটাবে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরের পর সুড়ঙ্গপথটি গাড়ি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার টার্গেট আছে। তখন নদীর দক্ষিণ পাড়ে কর্ণফুলি ও আনোয়ারা উপজেলা মূল নগরের সঙ্গে যুক্ত হবে। চীনের সাংহাইয়ের আদলে দুই শহর ও এক সিটি হবে চট্টগ্রাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ নামের এই পথ হবে দেশে নদীর তলদেশে সুড়ঙ্গপথ নির্মাণের প্রথম প্রকল্প।

শীতলক্ষ্যা, মেঘনা ও গোমতী নদীর ওপর বিদ্যমান সেতুর পাশাপাশি আরো তিনটি নতুন সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। রাজধানীর বিমাবন্দর-সংলগ্ন কাউলিয়া এলাকা থেকে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল সড়ক নির্মাণের কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।

যোগাযোগ খাতের উন্নয়নে বর্তমান সরকার এতটাই অগ্রাধিকার দিয়েছে যে, রাজধানী ঢাকাকে যানজটমুক্ত এবং নগরবাসীর চলাচল সহজ করতে নির্মাণ করা হচ্ছে মেট্রোরেল। তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানের যোগাযোগ খাতে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটিয়েছে সরকার। পর্যটনশিল্পের বিষয়টি মাথায় রেখে এ তিন জেলার অভ্যন্তরীণ সড়ক উন্নয়ন করা হয়েছে। কক্সবাজারের সঙ্গে বান্দরবানের সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে নির্মাণ করা হয়েছে নতুন সড়ক।

এ ছাড়া ঢাকা শহরের পশ্চিমাংশে নির্মিত হবে চক্রাকার সড়ক। ৫৫ দশমিক ৮ মিটার প্রস্থের ‘আধুনিক’ এই সড়কে দ্রুত গতির যান চলাচলের জন্য চারটি লেন থাকবে। দুই পাশে দুটি করে সার্ভিস লেন ছাড়াও মেট্রোরেলের জন্য ১০ মিটার করে জায়গা রাখা হবে। দুই পাশে পরিষেবা সংযোগের জন্য তৈরি করা হবে ‘টানেল’।

দেশের সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নের সবগুলো প্রকল্পের কাজ শেষ হলে আমূল বদলে যাবে দেশের সড়ক যোগযোগব্যবস্থা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads