• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
শঙ্কা আর ঝুঁকি নিয়ে ঈদযাত্রা

সংগৃহীত ছবি

যোগাযোগ

শঙ্কা আর ঝুঁকি নিয়ে ঈদযাত্রা

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ২০ জুলাই ২০২১

করোনার লাগামহীন সময়েও ভোগান্তিকে সঙ্গী করে পরিবারের সাথে ঈদ করতে রাজধানী ছেড়েছেন লাখো মানুষ। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি এবং ঈদের পরে চাকরি হারানোর শঙ্কা নিয়েই তারা ছুটছেন গ্রামের বাড়ি। এদিকে এক সপ্তাহের বিরতি দিয়ে আবার শুরু হবে দুই সপ্তাহের বন্দিদশা (কঠোর লকডাউন)। এ অবস্থায় ঢাকায় থেকে যাব নাকি বাড়ি যাব, এমন ভাবনায় এরই মধ্যে রাজধানী ছেড়েছেন কর্মজীবীদের একটি বড় অংশ।

অন্যদিকে ঈদ-পরবর্তী ১৪ দিনের লকডাউনে হুমকিতে নিম্নমধ্যবিত্তের জীবিকা। গত ঈদে বাড়ি যাওয়া হয়নি, তাই এবার যে যেতেই হবে। কিন্তু গ্রামগঞ্জের পরিস্থিতি আরো নাজুক। এমন জটিল অবস্থার মধ্যে তাদের ঈদযাত্রা। শুধু তাই নয়, একদিকে করোনাভাইরাসের ছোবল, অন্যদিকে দারিদ্রের কবল-মাঝখানে ঈদ। জটিল এই সমীকরণের মাঝে সমন্বয় করে সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান বিশেষজ্ঞদের।

গত রোববার রাতে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের নিজস্ব ফেসবুকে ওয়ালে দেওয়া পোস্ট মাধ্যমে জানা গেছে, শনি ও রোববার এ দুই দিনে ঢাকা ছেড়েছেন প্রায় ১৭ লাখ মোবাইল সিম ব্যবহারকারী। শুধু মোবাইল সিম ব্যবহারকারীর ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার পরিসংখ্যান এটি। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের সিম ৭ লাখ ৭৪ হাজার ৭৮৪, বাংলালিংকের ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৪৯২, রবির ৩ লাখ ৪২ হাজার ৮২ ও টেলিটকের ১ লাখ ১২ হাজার ২২৯টি সিম। সব মিলিয়ে মোবাইল সিমের সংখ্যা ১৬ লাখ ৯৩ হাজার ৬৮৭টি।

এদিকে রাত পেরোলেই কাল ঈদ। আর গতকাল ছুটি হয়ে গেছে সকল শিল্পকারখানা ও অফিস। কিন্তু ঈদযাত্রায় গতকাল সোমবার মহাসড়কে যানবাহনের চাপ অতীতের তুলনায় কম থাকলেও নৌপথে ছিল উপচেপড়া ভিড়। ঈদের আগাম টিকিট অনলাইনে বিক্রি হওয়ায় রেল স্টেশনে টিকিটের ভিড় ছিল না যাত্রীদের। তবে সময়মতোই ছাড়ছে ট্রেন। কিন্তু এক আসন করে খালি রাখার নির্দেশনা ভাঙা হয়েছে বাস ও ট্রেনে।

ঈদযাত্রাকে কেন্দ্র করে মহাসড়কে তেমন গাড়ির চাপ না থাকলেও রাজধানীতে ছিল অতিরিক্ত গাড়ির চাপ। ফলে গতকাল সকাল থেকেই রাজধানীর গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন সড়কে ছিল তীব্র যানজট। বিশেষ করে বনানী হয়ে বিমানবন্দর এলাকা দিয়ে যেসব গাড়ি টঙ্গী ও গাজীপুরে প্রবেশ করছে সেসব গাড়ির যাত্রীদের পোহাতে হয়েছে সীমাহীন দুর্ভোগ। এ সড়কে সকাল ৮টা থেকে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই জায়গায় গাড়িতে বসে থাকতে হয়েছে যাত্রীদের। অন্যদিকে বিমানবন্দরের এ যানজটের প্রভাব পড়ে কুড়িল বিশ্বরোড ও প্রগতি সরণির রাস্তায়ও। সকাল থেকে প্রগতি সরণি এলাকায় হালকা যানজট সৃষ্টি হয়, যা বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র যানজটে রূপ নেয়। তবে এ যানজট শুধু ঢাকা থেকে বের হওয়ার সড়কে দেখা গেছে। বিপরীত পাশের রাস্তায় যান চলাচল স্বাভাবিক ছিল।

যানজটে আটকে থাকা যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবার ঈদযাত্রায় তাদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। কিন্তু এবার করোনা মহামারির কারণে রাজধানীতে মানুষের যাতায়াত কম থাকায় তারা আশা করেছিলেন ভোগান্তি কম হবে। কিন্তু রাস্তায় অন্যান্য বারের মতোই যানজটে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তাদের।

সিলেটগামী এনা পরিবহনের বাসের চালক হায়দার আলী বলেন, ঈদযাত্রায় এমন যানজট প্রতি বছরই হয়। তবে এবার বিমানবন্দর এলাকায় উন্নয়নকাজের জন্য সড়কের বিভিন্ন অংশ ভাঙা। কিছু অংশে সড়ক সরু হয়ে গেছে। তাই স্বাভাবিক গতিতে যানবাহন চলাচল করতে পারে না। এ কারণেই এ সড়কে তীব্র যানজট দেখা দিচ্ছে, যা আশপাশের বিভিন্ন সড়কেও প্রভাব ফেলছে।

অন্যদিকে ঈদযাত্রায় গতকাল গাবতলীর বাস টার্মিনালে তেমন ভিড় না থাকলেও বাসের জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে যাত্রীদের। কিন্তু ভোগান্তির কমতি নেই। রাজবাড়ীর টিকিট এক যাত্রী পেতে ঘুরছেন এক কাউন্টার থেকে আরেক কাউন্টার। টিকিট আছে ঠিকই, কিন্তু দাম প্রায় দ্বিগুণ। করোনার প্রেক্ষাপটে ২৫০ টাকার টিকিট সরকারি হিসাবে ৪০০ টাকা হলেও, নেওয়া হচ্ছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা।

বাসের ভিতরের চিত্র ছিল আরো বেগতিক। বেশিরভাগ যাত্রীর মুখে ছিল না মাস্ক, তেমন মানা হয়নি এক আসন ফাঁকা রাখার নির্দেশনাও। যাত্রীদের অভিযোগ, বেশি টাকা নিয়েও, দুই আসনেই যাত্রী তুলছেন তারা।

সকালে কমলাপুর স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়েছে সময়মতো। তবে এক সিট ফাঁকা রাখার কথা থাকলেও, তা দেখা যায়নি। একই সিটে পাশাপাশি দুজনকে বসতে দেখা গেছে। তবে এবার ঈদের আগাম টিকিট অনলাইনে বিক্রি হওয়ায়, স্টেশনে টিকিটপ্রত্যাশীদের ভিড় দেখা যায়নি।

এদিকে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ছিল যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়। তাদের মধ্যে চাঁদপুর, চরভৈরব, লক্ষ্মীপুর, শৌলা, মুলাদি, দেউলা, নাজিরপুর, লালমোহন, ভোলা ও বরিশালগামী যাত্রীদের ভিড় ছিল বেশি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে লঞ্চে যাতায়াতের নির্দেশনা থাকলেও অনেকেই তা তোয়াক্কা করছেন না। লঞ্চে যাত্রী সংখ্যা যাই হোক ৬০ শতাংশ বেশি ভাড়া দিয়েই যাতায়াত করতে হচ্ছে যাত্রীদের। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) স্বাস্থ্যবিধি মেনে লঞ্চে চলাচলের নির্দেশনা দিলেও যাত্রীদের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপার অনীহা দেখা গেছে। এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ-এর যুগ্ম পরিচালক জয়নাল আবেদীন বলেন, স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে আমরা কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছি। এখানে যাত্রীদের মাস্ক পরার ব্যাপারে বার বার সতর্ক করা হচ্ছে। এছাড়া যাত্রীদের স্বাস্থ্য সচেতনতায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, নৌ-পুলিশ, বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উপস্থিত আছেন।

অন্যদিকে স্থানীয় প্রতিনিধিদের থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, মহাসড়কে যানবাহনের চাপ কমলেও পথে পথে যাত্রীদের পরতে হয়েছে ভোগান্তিতে। গতকাল সকাল থেকেই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে থেমে থেমে চলেছে যানবাহন।

গতকাল ভোর থেকেই মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটে ছিল ঘরমুখো মানুষের ঢল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা বেড়ে যায় বহুগুণে। সরেজমিনে দেখা গেছে, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি মাথায় নিয়ে পদ্মা পাড়ি দিতে মরিয়া মানুষ। তবে স্বল্প ফেরি ও ছোট লঞ্চে যাত্রী পার করে সামাল দিতে হিমশিম খায় কর্তৃপক্ষ। পণ্যবাহী যান ও ব্যক্তিগত গাড়িসহ বিভিন্ন বাহনের লাইনও বেশ দীর্ঘ ছিল।

ঢাকা থেকে শরীয়তপুরগামী এক নারী জানান, ঈদের পর সরকার কঠোর লকডাউন ঘোষণা করেছে। ইতোমধ্যে শিল্পকারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ছেলেমেয়ে পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে বাড়িতে যাচ্ছি। তাই করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি আছে জেনেও বাড়ি ফিরতে হচ্ছে।

এদিকে পাটুরিয়ার ঘাট এলাকায় গতকাল ভোর থেকে কয়েক কিমি এলাকাজুড়ে যানবাহনের দীর্ঘ যানজট দেখা যায়। দুপুরে উভয় ঘাটে ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় সহস্রাধিক ছোট-বড় যানবাহন দেখা গেছে। ঘাট কর্তৃপক্ষ জানায়, রোববার মধ্যরাত থেকেই পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে যানবাহনের তীব্র চাপ লক্ষ করা গেছে। ফলে ঈদে ঘর ফেরা মানুষ দুই থেকে তিন ঘণ্টা বা তারও বেশি ঘাট এলাকায় অপেক্ষা করছেন নদী পারাপারের জন্য। তবে সবচেয়ে বেশি রয়েছে ছোট যানবাহনের চাপ। কিন্তু ঘাট এলাকাতে উপেক্ষিত ছিল স্বাস্থ্যবিধি। দৌলতদিয়া ঘাটেও একই অবস্থা। গতকাল পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে ২০ ফেরি চলাচল করছে।

অন্যদিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শঙ্কা, ঈদে দেশের এক প্রান্তের মানুষ আরেক প্রান্তে যাতায়াতের কারণে ঈদ পরবর্তী করোনা পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। আর অর্থনীতিবিদের মতে, করোনার প্রথম ধাক্কায় দরিদ্রের হার যতটা বেড়েছে, এবারের লকডাউন আরো চ্যালেঞ্জে ফেলবে মানুষকে।

প্রসঙ্গত সরকার ১৫ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ‘শিথিল বিধিনিষেধের’ ঘোষণা দিয়েছে, তবে ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ফের ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ বা লকডাউন দিয়েছে। গত ১৩ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনে দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখা এবং ঈদুল আযহা পালনের সুবিধার্থে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে এতদিন যে বিধিনিষেধ ছিল তা এই ৮ দিন থাকছে না বলে জানানো হয়। ঈদুল আজহার পর আগামী ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ থাকবে বলেও উল্লেখ করা হয়। ওই ১৪ দিন পোশাক কারখানাসহ সব কলকারখানাও বন্ধ থাকাসহ এ সময়ে পর্যটন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদন কেন্দ্রে গমন ও জনসমাবেশ হয় এ ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান, যেমন বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান (ওয়ালিমা), জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি ইত্যাদি এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পরিহার করার কথাও রয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads