• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

যোগাযোগ

দেশে তৈরি হবে বগি ও ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ

ঘুরে দাঁড়াচ্ছে রেল খাত

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ১৮ অক্টোবর ২০২১

স্বাধীনতা পরবর্তীসময়ে দেশের রেলপথ সচল রাখতে বিনিয়োগ হয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। এ বিনিয়োগের সিংহভাগই ব্যয় হয় রেলপথ সংস্কার, ইঞ্জিন ক্রয় ও মেরামত, নতুন কিছু বগি ক্রয় ও মেরামত কাজে। তবে ক্রয়সংক্রান্ত কাজে রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়াম-দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। এসব কারণে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে এখনো লাভের মুখ দেখেনি সংস্থাটি। এবার রেলকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে দেশেই রেলের বগি ও ইঞ্জিনের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ কাজের জন্য ইতোমধ্যে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে, যা আগামী নভেম্বর মাসে চূড়ান্ত হবে। এই নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে ঘুরে দাঁড়াতে পারে রেল খাত।  

বর্তমানে রেল খাতের প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। বিদেশ থেকে প্রতিবছর বগি (কোচ বা ক্যারেজ) ও ইঞ্জিন কিনতে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। উপরন্তু এ দীর্ঘ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়। এতে রেলে বগি সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ অবস্থায় আমদানিনির্ভরতা কমাতে ২০১৭ সালে দেশে রেলের বগি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়, যা বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে। এজন্য নতুন কারখানা স্থাপনে ব্যয় ধরা হয়েছিল সাড়ে ৭০০ কোটি টাকা।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশের সবচেয়ে বড় রেল ওয়ার্কশপ সৈয়দপুরে অবস্থিত। যদিও স্বাধীনতার আগে থেকে মেরামতের পাশাপাশি এখানে সীমিত আকারে কিছু কোচ তৈরি করা হতো। তবে ১৯৯৩ সালে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রায় ১১২ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত এ ওয়ার্কশপে এখন রেলের বিদ্যমান পুরাতন বগি বা ক্যারেজগুলো পুনর্বাসন করা হয়। বিদ্যমান সৈয়দপুর রেল ওয়ার্কশপের বিশাল এলাকা থাকায় সেখানে ক্যারেজ তৈরির পর্যাপ্ত জায়গাও পাওয়া যাবে।

এদিকে বর্তমানে রেলে ২৭৮টি ইঞ্জিন রয়েছে। এর বেশির ভাগেরই বয়স ৩৫ থেকে ৬৩ বছর। এরমধ্যে ৮৭ শতাংশ ইঞ্জিন ও ৭৭ শতাংশ কোচের (বগি) আয়ুষ্কাল শেষ। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আর পুরনো ইঞ্জিন হওয়ায় সেগুলো মেরামতের দরকার হয় বেশি। কিন্তু সংকট হলো, প্রয়োজনের সময় যন্ত্রাংশ সহজেই নাগালে পাওয়া যায় না। ৯৫ শতাংশ যন্ত্রাংশই আমদানি করতে হয় বিভিন্ন দেশ থেকে। সব প্রক্রিয়া শেষ করে যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করতে রেলওয়ের অনেক সময় লেগে যায়। এ বাড়তি সময়ক্ষেপণই ইঞ্জিনের সক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে বলে সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এ অবস্থায় দেশেই বগিসহ ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ তৈরির গুরুত্ব দিচ্ছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। 

অন্যদিকে চলমান বা আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া ইঞ্জিন-কোচ মেরামতে আমদানিনির্ভর যন্ত্রাংশের বিকল্প উৎস সৃষ্টির লক্ষ্যে নীতিমালা তৈরি করছে সরকার। এটি রেলওয়ের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে বলে রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অভিমত প্রকাশ করেছেন।

দেশেই কোচ-ইঞ্জিন তৈরি করতে পারব উল্লেখ করে, রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন- ভারতসহ বিভিন্ন দেশ রেল ইঞ্জিন-কোচসহ যন্ত্রাংশ তৈরি করছে। আমরা যুগ যুগ ধরে পিছিয়ে আছি। রেলের যন্ত্রাংশ ক্রয়ে আমরা প্রায় শতভাগ আমদানিনির্ভর। এছাড়া যথাযথ সময়ে যন্ত্রাংশ ক্রয় করাও সম্ভব হয় না। এ কারণে অতি প্রয়োজনীয় ইঞ্জিন-কোচ সংস্কারে বিলম্ব ঘটে। এছাড়া মেরামতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষাও করতে হয়। আবার কিছু যন্ত্রাংশ বিশ্ব বাজারেও পাওয়া যাচ্ছে না। এতে বহুগুণ বেশি দামে যন্ত্রাংশ কিনতে হয়। ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে লোকসানও বাড়ে। আগামী মাসে নীতিমালা চূড়ান্ত হলে অধিকাংশ যন্ত্রাংশ স্থানীয় কোম্পানিগুলো তৈরি করবে। এতে স্বল্প দামে যন্ত্রাংশ মিলবে, স্থানীয় শিল্পেরও বিকাশ ঘটবে। দেশের টাকা দেশেই থাকবে।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, নীতিমালা চূড়ান্ত হলে রেলওয়ের নিজস্ব কারখানায় যন্ত্রাংশ তৈরি করা যাবে। একইসঙ্গে শিল্পোদ্যোক্তারা বিভিন্ন দেশ থেকে যন্ত্রাংশ আমদানি করে রেলওয়েতে সরবরাহ করতে পারবে।

এদিকে বর্তমানে আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া ইঞ্জিন ও কোচ রেলে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ওপর ২০১৩ সালে চীন থেকে আনা ডেমুর আয়ুষ্কাল শেষ না হতেই ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। ৬৫৪ কোটি টাকার ২০টি ডেমু ট্রেনের মধ্যে বর্তমানে মাত্র ৩টি সচল আছে। ৩৫ বছর আয়ুষ্কাল থাকলেও মাত্র এক বছর যেতে না যেতেই নষ্ট হতে থাকে আধুনিক ডেমু ট্রেন। অচল হয়ে পড়া ডেমু ট্রেনগুলো মেরামত করতে হলে শুধু চীন থেকেই যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করতে হবে। যার দাম বিশ্ব বাজারের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। আর কেনার পর মেরামত করতে প্রায় সমপরিমাণ টাকা লাগবে। কিন্তু নীতিমালা চূড়ান্ত হলে ডেমুর অধিকাংশ যন্ত্রাংশ দেশেই উৎপাদন করা সম্ভব হবে।

রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, নীতিমালা চূড়ান্ত হওয়ার পর রেলে আমূল পরিবর্তন আসবে। একই সঙ্গে দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তারা উপকৃত হবে। কারণ একটি রেলইঞ্জিনে সর্বোমোট ২৫ হাজার ধরনের যন্ত্রাংশের প্রয়োজন হয়। আর তার ৯৫ শতাংশ যন্ত্রাংশই বিভিন্ন বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করতে হয়। তাতে রেলের কোটি কোটি টাকা খরচ হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে সময় মতো যন্ত্রাংশ কেনাও সম্ভব হয় না। আর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যন্ত্রাংশ না পাওয়ায় ইঞ্জিনও যথাযথ মেরামত হয় না। ফলে ট্রেন পরিচালনায় হিমশিম খেতে হয়। এখন নীতিমালা চূড়ান্তের মাধ্যমে রেল কর্তৃপক্ষ ওসব সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে রেলপথ সচিব সেলিম রেজা জানান, আমাদের দেশেও রেলের যন্ত্রাংশ তৈরি করা সম্ভব। ইস্পাত শিল্প বিকাশের কারণে উপকরণ হিসেবে লোহা ও ইস্পাত পেতে অসুবিধা হবে না। এ জন্য নীতিমালা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছ। এটি অনুমোদন হলে দেশেই নতুন কোচ তৈরি করা হবে। ইঞ্জিন মেরামত করতে আর আমদানি নির্ভর যন্ত্রাংশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। তাছাড়া পর্যায়ক্রমে দেশেই রেলের ইঞ্জিন তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে।

তিনি জানান,  দেশে তিনটি বিশেষায়িত রেলওয়ে কারখানাও আছে। সৈয়দপুরে আছে রেলওয়ে কারখানা, দিনাজপুরের পার্বতীপুরে রয়েছে কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানা আর চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে রয়েছে ক্যারেজ ও ওয়াগন মেরামত কারখানা। কারখানাগুলো প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল রেলওয়ের লোকোমোটিভ, ক্যারেজ ও ওয়াগনের সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ এবং আয়ুষ্কাল ঠিক রাখার পাশাপাশি গতিশীলতা বজায় রাখা। এসব কারখানায় খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরির মেশিনও রয়েছে। কিন্তু লোকবল সংকট, বাজেট ঘাটতি এবং আধুনিকায়নের অভাবে কারখানাগুলো কাঙ্ক্ষিত নৈপুণ্য দেখাতে পারছে না। তাছাড়া ভারতসহ বিভিন্ন দেশ রেল ইঞ্জিন-কোচসহ যন্ত্রাংশ তৈরি করছে, আমরাও সেদিকে যাচ্ছি বলে তিনি জানান।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads