• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

যোগাযোগ

ফ্লাইওভারেও কমেনি যাত্রাবাড়ীর যানজট

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ০৬ জানুয়ারি ২০২২

গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ীতে নির্মিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারও কমাতে পারেনি যাত্রাবাড়ী এলাকার যানজট। দেশের সবচেয়ে বড় ফ্লাইওভারটি নির্মাণের সময় এলাকাবাসী স্বপ্ন দেখেছিলেন দীর্ঘদিনের দুঃসহ যানজট থেকে মুক্তির। কিন্তু স্থানীয় চাঁদাবাজদের কারণে তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।

যাত্রাবাড়ী এলাকার তিনটি রাস্তায় গড়ে উঠা কয়েকশ ভাসমান দোকান আর বাজারকে ঘিরে কোটি টাকার চাঁদাবাজির ইতিহাস দীর্ঘদিনের। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদলেও কখনো থেমে থাকেনি চাঁদাবাজির এই মহোৎসব। রাজনৈতিক মদদপুষ্ট এই গ্রুপগুলো প্রতিদিন হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। আর যত্রতত্র গড়ে ওঠা এসব অস্থায়ী দোকানের কারণে নিত্য যানজটে ভোগান্তিতে পড়ছেন লাখো নগরবাসী। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ও যান চালকরা।

সরেজমিনে জানা যায়, রাজধানীতে প্রবেশ ও বের হওয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ন যাত্রাবাড়ী মোড়টি দীর্ঘদিন ধরে দখল করে আছে কয়েকটি চিহ্নিত চাঁদাবাজ গ্রুপ। চাঁদাবাজদের এই লালসায় ভোর থেকে গভীর রাত অব্দি ভোগান্তিতে পড়ছে এই রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী লাখ লাখ মানুষ ও যানবাহন। অভিযোগ আছে, সংশ্লিষ্টদের ‘সন্তুষ্ট’ করেই চলে এই অবৈধ বানিজ্য। যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে নিজেদের আন্তরিক চেষ্টার দাবি করা হয়েছে।

জানা যায়, যাত্রাবাড়ী বিবিরবাগিচার ১নম্বর গেট থেকে পার্ক হয়ে মসজিদ পর্যন্ত, শহীদ ফারুক রোডের মোড় থেকে খানকা শরীফ মসজিদ পর্যন্ত ও সামাদ সুপার মার্কেট থেকে দোলাইরপাড় যাওয়ার রাস্তার বেশ কিছুটা অংশে গড়ে উঠেছে প্রায় সাতশতাধিক ভাসমান দোকান ও বাজার। ছোট ছোট কয়েকটি গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করে এসব দোকান। তারাই নিয়মিত চাঁদা উঠায় এইসব দোকান থেকে। তবে এই টাকা দিয়ে অনেককে ম্যানেজ করতে হয় বলে অনেকে জানান।

অভিযোগ রয়েছে, এখানে চাঁদা উঠায় কয়েকটি গ্রুপ। তাদের মধ্যে স্থানীয় ওয়ার্ড সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জাহিদ হোসেন জুয়েল অন্যতম। তার নামে প্রতি দোকান থেকে নেয়া হয় দুইশত টাকা। জুয়েলের হয়ে টাকা উঠায় সাজ্জাদ, শাওন ও সাইফুল। চাঁদাবাজদের মধ্যে আরেকজন হচ্ছেন কাবিলা। তিনি প্রতিটি ফলের দোকান থেকে চাঁদা নেন ১৫০ টাকা। রনি, জনি, সনি ও জামাই সেলিম নেয় ১৫০ টাকা করে। এছাড়া এখানকার ২৫টি দোকান থেকে ৪-৫শত টাকা নেয় জাহাঙ্গীরসহ কয়েক জন। এখানে বিদ্যুৎ বাবদ প্রতি লাইট হতে দৈনিক গড়ে ৫০ টাকা করে নেয় জসিম। এদের প্রত্যেকেরই ক্ষমতাসীন দলের সাথে যোগসূত্র আছে বলে জানা যায়।

ভাসমান এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সথে কথা বলে জানা যায়, যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার শুধু বিবিরবাগিচা অংশ থেকেই মাসে কোটি টাকা চাঁদা উঠে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ফল ব্যবসায়ী জানান, প্রতিদিন কয়েকটি গ্রুপকে বিদ্যুৎ খরচসহ ৫ থেকে ৬শ টাকা পরিশোধ করতে হয়। তিনি স্বীকার করেন, চাঁদাবাজদের পরিশোধ করা এই টাকা তারা কোন না কোন ভাবে ক্রেতাদের কাছ থেকেই উঠিয়ে নেন।

যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার আরকেটি অংশ সামাদ সুপার মার্কেটের সামনে গিয়ে দেখা যায়, এখানে রাস্তার ওপর চৌকি বিছিয়ে বসে ছোটবড় প্রায় ১২০ টি দোকান। এখানকার প্রতিটি দোকান থেকে দৈনিক চাঁদা আদায় করা হয় একশত থেকে দেড়শত টাকা। এ চাঁদা নেয় ৫০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা-কর্মী পরিচয়দানকারী সাইকেল চোর হাবু, শামীম ও ডিম রাসেল। এখানে প্রতি মাসে চাঁদা আদায় করা হয় প্রায় সাড়ে পাচ লক্ষ টাকা। আলম নামে এক পোশাক বিক্রেতা জানান, প্রতিদিন বিদ্যুৎসহ তাকে একশত থেকে দেড়শত টাকা চাঁদা দিতে হয়। না দিলে বসতে দেয়া হয় না। অনেক সময় মারধরও করা হয়।

যাত্রাবাড়ীর আরেকটি অংশ শহীদ ফারুক রোড। এখানকার প্রধান সড়ক ও ফুটপাত দখল করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর প্রায় তিনশত দোকান। ফুটপাতের দোকানিরা জানান, এসব দোকান নিয়ন্ত্রন করে তোরাব আলী নামে এক ব্যাক্তি। দোকানভেদে দৈনিক চাঁদা দুই থেকে আড়াইশ টাকা। এই হিসেবে এখানে প্রতিমাসে চাঁদা আদায় হয় প্রায় ২০ লক্ষাধিক টাকা।

মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার নির্মানের পর এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াতকারী এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার  বাসিন্দাকা আশা করেছিলেন এই এলাকার যানজট কমবে। লাঘব হবে তাদেও দীর্ঘদিনের ভোগান্তি। কিন্তু বাস্তাবে তাদেও সেই প্রত্যামা খুববেশী পূরন হয়নি।

ধলপুর বিবিরবাগিচার বাসিন্দা রুবেল হোসেন জানান, ব্যবসার কারনে প্রতিদিনই তাকে যাত্রাবাড়ী দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। ফ্লাইওভার নির্মানের আগে থেকেই যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় যান আর জনজটের ভোগান্তি পোহাতে হয় এসব এলাকার বাসিন্দাদের। আশা ছিল হানিফ ফ্লাইওভার হলে সেই ভোগান্তি থেকে মুক্তি মিলবে। কিন্তু রাস্তাজুড়ে বসা হকার আর বাজারের কারণে আদতে তা আর হয়নি।

যাত্রাবাড়ী থেকে পোস্তগোলাগামী লেগুনা চালক আমির জানান, এই রাস্তায় দিন-রাত সবসময় যানজট লেগেই থাকে। ফ্লাইওভার হওয়ায় আগের তুলনায় যনজট কিছুট কমলেও রাস্তাদখল করে বসে থাকা হকারদের কারনে যানজট থেকে পুরেপুরি মুক্তি মেলেনি।

যাত্রাবাড়ীর শেখ রাসেল পার্কের সামনের অংশ জুড়ে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বসে বাজার। ফলে এখানেও থাকে যানজট।

ঢাকা দক্ষিন সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল কালাম অনু এ প্রসঙ্গে জানান, যাত্রাবাড়ীর শেখ রাসেল নামের এই পার্কের সৌন্দর্য বজায় থাক আমি সেটা চাই। তাই পার্কের সামনে থেকে বাজার উঠিয়ে দিতে আমি মেয়র, ডিসি ওয়ারী ও সংশ্লিষ্ট থানাকে অবহিত করেছি।

যাত্রাবাড়ীতে দায়িত্বরত ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টি আই) জাকারিয়া মেনন জানান, আমরা আমাদের যতটুকু লোকবল আছে, তা দিয়ে মাঝে মাঝে দোকান উঠিয়ে দেই। কিন্তু আমরা চলে গেলে আবার এসে বসে। এই বাজার উঠিয়ে দিতে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।

ডিএমপি’র ওয়ারী বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি, ট্রাফিক) সাইজুল ইসলাম জানান, আমরা একদিকে এদের সরাই অন্যদিকে পুনরায় এসে বসে। আমাদের সদস্যদেরকে এই ব্যাস্ততম রাস্তার যানজট নিরসনে ব্যাস্ত থাকতে হয়। ফলে হকারদের পিছনে সার্বক্ষণিক সময় দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। আবার মানবিকতার বিষয় নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেন।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১১ অক্টোবর গুলিস্থান থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার’ জনসাধারণের জন্য উম্মুক্ত করা হয়। ২০১০ সালের ২২ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২ হাজার ১০৮ কোটি টাকার এ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে (পিপিপি) নির্মিত দেশের সবচেয়ে বড় এ ফ্লাইওভারের সঙ্গে আশেপাশের প্রধান সড়ক ও বাস টার্মিনালের সংযোগ রাখা হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads