• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
নৈরাজ্যের আশঙ্কা গণপরিবহনে

সংগৃহীত ছবি

যোগাযোগ

নৈরাজ্যের আশঙ্কা গণপরিবহনে

  • রতন বালো
  • প্রকাশিত ০৬ এপ্রিল ২০২২

রমজান শুরুর পর থেকে রাজধানীতে তীব্র আকার ধারণ করেছে যানজট। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আনফিট (ক্রুটিপূর্ণ) গণপরিবহন চলাচল। আর এই আনফিট বাস-মিনিবাসই ঈদের আগে যাত্রী নিয়ে ছুটবে বিভিন্ন জেলায়। একারণে সড়কে বাড়বে দুর্ঘটনার হার। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, গত বছর সারা দেশে ৫ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ২৮৪ জন নিহত এবং ৭ হাজার ৪৬৮ জন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৮০৩ জনই শিক্ষার্থী।

ধারণা করা হয়, বেপরোয়া গতির কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ক্রুটিপূর্ণ বাস-মিনিবাস মহাসড়কে চলাচলের কারনে বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে। এছাড়া ইজিবাইক, ট্রাক্টর, আবর্জনার গাড়ি, কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেলের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকায় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। এছাড়া মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, তরুণ ও যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাও এজন্য দায়ী। বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতিসহ গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজির কারণেও ঘটে সড়ক দুর্ঘটনা।

জানা গেছে, এবারো ঈদকে ঘিরে আবারো আনফিট গাড়ি রাস্তায় নামানো হচ্ছে। এসব গাড়ির বয়স ৩০ ছুঁই ছুঁই। আবার রংচটা গাড়িকে রং করেও নামানো হচ্ছে। বর্তমানে রাজধানীতে ৯২টি কোম্পানির প্রায় সাড়ে তিন হাজার বাস চলছে। তবে বেশিরভাগ বাসেরই ফিটনেস নেই। দরজা-জানালা ভাঙা, বসার সিট ছেঁড়া ও ময়লা। সামান্য বৃষ্টিতেই বাসের  ভেতর পড়ে পানি। ফলে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এসব গাড়িই আসন্ন ঈদে ঘরমুখী যাত্রীদের নিয়ে ছুটবে বিভিন্ন জেলায়।

পরিবহন বিশ্লেষকরা বলেছেন, প্রায় দুই কোটি মানুষের এ মহানগরীতে এমনিতেই গণপরিবহনের সংকট রয়েছে। আর ঈদ এলে এ সংক্রট আরো তীব্র আকার ধারণ করে। ঢাকার পরিবহন সমিতিগুলোর হিসাবে, প্রতি তিন হাজার মানুষের জন্য এ শহরে বাস-মিনিবাস আছে মাত্র একটি। প্রতিবার অভিযান শুরু হলেই মালিকরা কৌশলে রাস্তায় গাড়ি কমিয়ে দেন। এর মাধ্যমে মানুষের ভোগান্তি সৃষ্টি করে তারা সরকারের ওপর চাপ তৈরি করেন, এতে কাজও হয়। কিন্তু কিছুদিন পর অভিযান বন্ধ হয়ে যায়। এর আগে গত বছর ৬ মার্চ অভিযান শুরু হয়। চলে দীর্ঘ দিন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

অভিযান শুরু হলে পরিবহন মালিকরা সরকারের কাছে সময়ের আবেদন করেন। তারা নতুন গাড়ি নামানোর প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর বছরের পর বছর পার হয়, কিন্তু কথা রাখেন না মালিকরা। ফলে আবারো রাজপথ দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করে সেই লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ি। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ ও বিআরটিএ (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ) কর্মকর্তাদের নিয়মিত মাসোয়ারা দিয়েই ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো হয়। ভুয়া চালকরাও একই কায়দা ব্যবহার করে। একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে বাস-মালিকরা আনফিট ও রং চটা গাড়িগুলো রং করে রাস্তায় নামাচ্ছে।

পরিবহন মালিকরা বলছেন, তীব্র যানজট, ভাঙাচোরা রাস্তা, কম সুদে ব্যাংকঋণ না পাওয়া এবং শুল্ক সুবিধা না পাওয়ায় তারা নতুন গাড়ি নামাতে পারছেন না। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, তীব্র যানজটে ট্রিপ কমে যাওয়া, শিল্প হিসেবে পরিবহন খাতে বিশেষ শুল্ক সুবিধা না দেওয়ার পাশাপাশি পরিবহন ব্যবসা প্রভাবশালী বলয়ে জিম্মি থাকা এবং  কোম্পানিভিত্তিক বাস নেটওয়ার্কের বদলে ব্যক্তিকেন্দ্রিক পরিবহন ব্যবসার কারণেই মূলত রাজধানী ঢাকায় গণপরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।

পরিবহন ব্যবসায় সরাসরি জড়িত নন, কিন্তু রাজনৈতিক নেতার ছত্রচ্ছায়ায় মালিকদের বড় একটি অংশ রাজধানীর পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণ করছে। রুট পারমিট দেওয়া থেকে শুরু করে কোন গাড়ি কী পরিমাণ নামানো হবে, তাও ঠিক করে দেয় তারা। এতে একজন নতুন মালিক গাড়ি কিনলেও তাদের নির্দেশ না পেলে রাস্তায় নামাতে পারেন না।

এদিকে ফিটনেস না থাকলেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গণপরিবহনে যাত্রীরা চলাচল করছেন বাধ্য হয়ে। প্রতিদিনই দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে লক্কড় ঝক্কড় মার্কার শত শত বাস, মিনিবাস, লেগুনা চলছে, সেগুলোতেই প্রাণ হাতে নিয়ে যাতায়াত করছেন যাত্রীরা। উন্নত সেবা দেওয়ার নামে বিভিন্ন সময় রাজধানীতে নানা কোম্পানির ব্যানারে যেসব গাড়ি নামানো হয়েছে সেগুলোর অবস্থা আরো শোচনীয়।

গত কয়েক বছরে অন্তত ৪৬টি কোম্পানি নগরীর রাস্তা থেকে তাদের দেড় হাজার বাস তুলে নিয়েছে। অনেকেই গণপরিবহনের বাস-মিনিবাস বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিবহনে ভাড়া দিয়েছে। সরকার গণপরিবহনকে উৎসাহিত না করে ব্যক্তিগত যানবাহন রাস্তায় নামানোর ব্যাপারেই বেশি আগ্রহ দেখানোর কারণে এ সেক্টরে সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।

তাদের এ অভিযোগের যে অনেকাংশই সত্য তার প্রমাণ মিলেছে খোদ বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) পরিসংখ্যানে। বিআরটিএর ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহকৃত পরিসংখ্যানে অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সাত বছরে বাস-মিনিবাসের তুলনায় প্রায় ১৮ গুণ বেশি প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন ছোট যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়েছে।

পরিবহন নেতাদের দাবি, বিপুলসংখ্যক ব্যক্তিগত যান ও অটোরিকশার মতো ছোট গাড়ি রাস্তায় নামায় রাজধানী ঢাকা যানজটের নগরীতে পরিণত হয়েছে। ফলে আগে যেসব বাস-মিনিবাস মতিঝিল থেকে মিরপুর ৬টি ট্রিপ দিতে পারতো, ওইসব পরিবহন এখন একই রুটে ৩ ট্রিপও দিতে পারছে না। ফলে লাভ দূরে থাক, খরচের টাকা তোলাই কষ্ট হয়ে পড়েছে।

ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির নেতা খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, এই শহরে গাড়ি চলার মতো অবস্থা নেই। মতিঝিল-মিরপুর রুটে আমার একটি বাস চলাচল করতো। সেটি বেঁচে দিয়েছি। চলার রাস্তা না থাকলে গাড়ি এনে কী হবে?

এদিকে বছর তিনেক আগে বাস-মিনিবাস ও হিউম্যান হলারসহ সব ধরনের যানবাহনের ডিজিটাল নাম্বার প্লেট বাধ্যতামূলক করা হলেও অধিকাংশ গণপরিবহনের মালিক সে নির্দেশনা অবজ্ঞা করছেন। বিআরটিএ সূত্র জানায়, ডিজিটাল নাম্বার প্লেট সংগ্রহের আগে প্রতিটি যানবাহনের ফিটনেস সনদ সংগ্রহ করতে হয়। তাই প্রাইভেট গাড়িগুলো দ্রুত ডিজিটাল নাম্বার প্লেট সংগ্রহ করলেও গণপরিবহনে তাতে সাড়া নেই। অথচ এসব গাড়ির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নজির খুবই সামান্য।

এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনা সংকটে লকডাউনসহ নানা কারণে দেশের ৭৭ ভাগ মানুষের আয় কমেছে। ফলে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে বলে এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে। এহেন সংকটাপন্ন দেশের মানুষজন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে যখন দিশেহারা, ঠিক তখনই জ্বালানি তেলের দাম একলাফে ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে মানুষের যাতায়াত, পণ্য পরিবহন, খাদ্যপণ্য ও কৃষিজ উৎপাদনসহ সামগ্রিক ব্যয় আরো কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। পণ্য ও সেবামূল্য আরো একদফা বৃদ্ধির ফলে চরমভাবে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। এতে নতুন করে আরো কয়েক কোটি মানুষ দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।

তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকায় সরকার উচ্চহারে তেল বিক্রি করে গত ৬ বছরে ধরে একচেটিয়া মুনাফা করেছে। এতে সরকার প্রায় ৬৩ হাজার কোটি টাকার বেশি আয় করেছে। মাত্র ৫ মাস ধরে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির কারণে দেশের মানুষের এই কঠিন দুঃসময়ে একলাফে ২৩ শতাংশ তেলের মূল্য বৃদ্ধি করা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads