• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

যোগাযোগ

নির্বিঘ্ন ঈদযাত্রা নিয়ে শঙ্কা

  • রতন বালো
  • প্রকাশিত ২২ এপ্রিল ২০২২

এবারো আসন্ন ঈদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাবেন কোটি মানুষ। গত দুই বছরের চেয়ে রোজার ঈদে প্রায় দ্বিগুণ মানুষ রাজধানী ছাড়বে। কারণ করোনা মহামারির দুই বছরে মোট চার ঈদে খুব বেশি মানুষ গ্রামে যেতে পারেনি। এবার ঢাকা ছাড়বেন প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি এই তথ্য জানিয়েছে।

এদিকে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি বলেছে, এবার সদরঘাট টার্মিনালে অস্বাভাবিক চাপ পড়বে। ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ এবং গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ মহানগরসহ এ তিন জেলার প্রায় ৪০ লাখ মানুষ নৌপথে উপকূলীয় জেলাগুলোতে যাবে। কিন্তু মাত্র ১২ দিনে একমুখী এতো যাত্রী পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক নৌযান নেই।

অন্যদিকে, ঈদের আগে সব আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট কাটতে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বা জন্মসনদ নয়তো পাসপোর্টের ফটোকপি লাগবে বলে জানিয়ে দিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। বিদেশিদের ক্ষেত্রেও পাসপোর্ট দেখাতে হবে। টিকিট কালোবাজারি রোধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে রেল কর্তৃপক্ষ।

আগামীকাল শনিবার থেকে রেলে আগাম টিকিট বিক্রি শুরু হচ্ছে। এদিন থেকে পরিচয়পত্র ছাড়া কেউ টিকিট কাটতে পারবেন না। ২ বছর আগে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলেও এখন থেকে কার্যকর হচ্ছে। কিন্তু এতসব কাগজপত্র দেখে অল্প সময়ে টিকিট দেওয়া প্রায় অসম্ভব বলে জানালেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, এনআইডি, জন্মসনদ কিংবা পাসপোর্টের ফটোকপি সঠিক না জাল তা যাচাই-বাছাইয়ের কোনো সরঞ্জামই নেই কাউন্টারে। খালি চোখে পরীক্ষা করে টিকিট দিতে অনেক সময় লাগবে। এতে ঈদের আগে যাত্রীদের দুর্ভোগ বৃদ্ধির শঙ্কা আছে। তবে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি বলেছে, লঞ্চের ডেকে অতিরিক্ত যাত্রীর পাশাপাশি ছাদেও যাত্রী বহন করা হবে এবং এতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার আশংকা থেকে যাবে। তাই ঈদে বিড়ম্বনামুক্ত নিরাপদ নৌযাত্রার জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন ও কঠোর নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। সবমিলিয়ে  আশঙ্কা করা হচ্ছে, এবারের ঈদযাত্রায় রাজধানীবাসী সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়বেন।

ঘরমুখো মানুষ প্রতিবছরই দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে ঈদযাত্রা করেন। গত দুই বছরের করোনা মহামারির পর এবার অনেকটা স্বাভাবিক পরিবেশে ঈদ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ কারণে এবার হয়তো বেশি সংখ্যক মানুষ ঢাকা ছেড়ে যাবেন। কিন্তু অপ্রতুল গণপরিবহন ও ভঙ্গুর যোগাযোগব্যবস্থার কারণে তাদের ঈদযাত্রা কতটা নির্বিঘ্ন হবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ফেরি-সংকট, পুরোনো লঞ্চ ও ফিটনেসহীন যানবাহনে যাত্রী ভোগান্তির বিষয়টিও সামনে আসছে।

ঈদের সময় সড়কে ফিটনেসহীন যানবাহনে যাত্রী পরিবহনের প্রবণতা বেড়ে যায়। নৌপথে পুরোনো লক্কড়-ঝক্কড় লঞ্চে রং মাখিয়ে ‘নতুন’ করে চালানো হয়। ফলে এ সময় দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। অদক্ষ চালক দিয়ে যানবাহন চালানোর কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরো বেড়ে যায়। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গত ঈদুল ফিতরে তিন শতাধিক সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত তিনশ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। সড়কের নৈরাজ্য রোধ করতে না পারলে এবার দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের তথ্যমতে, ঈদে চাহিদা অনুযায়ী যানবাহন না থাকায় প্রায় ১২-১৩ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়বেন ট্রাক, ট্রেনের ছাদে করে। তখন দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যাবে। তাই এখনই দুর্ঘটনা রোধে পদক্ষেপ নিতে হবে। সংখ্যক ট্রিপ দিতে না পেরে তা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য বেপরোয়া গতিতে চালানো হয় বলেই প্রতিবছর ঈদযাত্রা পরিণত হয় মৃত্যুর মিছিলে।

সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের মহাসড়ক ব্যবস্থাপনা বিভাগের (এইচডিএম) সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানা গেছে, ৩৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ মহাসড়কের অবস্থা বেহাল। জেলা সড়কসহ মোট ভাঙাচোরা সড়কের পরিমাণ ৩৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ, অর্থাৎ সড়ক-মহাসড়কের এক-তৃতীয়াংশই ভাঙাচোরা। গত ঈদুল ফিতরের সময় ভাঙাচোরা সড়ক-মহাসড়কের পরিমাণ ছিল ৪৩ শতাংশ। বেহাল মহাসড়কের পরিমাণ ছিল ৩২ শতাংশ। আগের বছরের তুলনায় সড়ক ও মহাসড়কের উন্নতি হয়েছে। তার পরেও আসন্ন ঈদযাত্রার দুর্ভোগের শঙ্কা পিছু ছাড়ছে না।

এ বিষয়ে জানার জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মীর তারেক আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি শঙ্কা প্রকাশ বলেন, প্রতি ঈদে ঢাকাসহ বড় শহরগুলো থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ গ্রামের বাড়িতে স্বজনদের কাছে যায়। তাই প্রতিবছর ঈদে নির্বিঘ্ন যাতায়াত নিয়ে নানা সমস্যা ও শঙ্কা দেখা দেয় এবং ঈদের আগে তড়িঘড়ি করে সমাধানের চেষ্টা করা হয়।

এদিকে আসন্ন ঈদে ঘরমুখী মানুষের ভোগান্তি কমাতে বিভিন্ন সড়কে চলমান সংস্কার ও নির্মাণ কাজ ঈদের আগে পরে মোট চৌদ্দ দিন বন্ধ রাখার আহ্বান জানিয়েছেন এফবিসিসিআইর সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু। গত রোববার পরিবহন ও যোগাযোগ (রেল, সড়ক ও মহাসড়ক) বিষয়ক কমিটির প্রথম বৈঠকে তিনি এ আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, বিভিন্ন সড়কে সংস্কার ও নির্মাণ কাজ চলায় যানবাহনের গতি ধীর হয়ে যায়। যা দীর্ঘ যানজট তৈরি করে। ঈদে ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি কমাতে তাই ২৭ এপ্রিল থেকে ১০ মে পর্যন্ত সকল প্রকার সংস্কার ও নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখার অনুরোধ জানান যথাযথ সংশ্লিস্টদের প্রতি।

এছাড়া ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পার হতেই ভাঙাচোরা সড়কের মুখোমুখি। বিআরটির নির্মাণকাজের কারণে ১২ লেনের বিশাল প্রশস্ত সড়ক ছয় লেনে এসে ঠেকেছে। উত্তরায় জসীমউদ্দীন রোডের সামনে ফ্লাইওভারের সরঞ্জাম রাখায় সরু হওয়া সড়কে যানজট ঠেলে টঙ্গী সেতুতে পৌঁছাতে লাগে ঘণ্টাখানেক। বিআরটির জন্য ঢাকা ও গাজীপুরের সীমান্তে তুরাগ নদে চলছে ১০ লেনের সেতুর নির্মাণকাজ। এ কারণে পাশে অস্থায়ীভাবে নির্মিত স্টিলের সাঁকো পাড়ি দিয়ে গাড়ি ঢাকা ছেড়ে গাজীপুরে ঢোকে। সেতু পার হয়ে চেরাগ আলী পর্যন্ত ফ্লাইওভারের কাজ চলছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, ঢাকা থেকে রংপুর যেতে এখনই ১২-১৩ ঘণ্টা লেগে যায়। ঈদের সময় পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কেও যানজটে ভোগান্তি হতে পারে। এই মহাসড়কের কুমিল্লার দাউদকান্দি অংশের বারপাড়া এলাকায় চার লেনের সংস্কারকাজের কারণে দু-তিন কিলোমিটার এলাকায় এখন প্রায় নিয়মিতই যানজট হচ্ছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সোনারগাঁওয়ের কাঁচপুর থেকে ভুলতা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার অংশে যানজট নিত্যদিনের ঘটনা। এর কারণ, মহাসড়ক দখল করে গড়ে উঠেছে যানবাহনের স্ট্যান্ড ও অবৈধ পার্কিং। কাঁচপুর সেতুর নিচে শ্যামবাজার বাসস্ট্যান্ড ও তারাব চৌরাস্তায় মহাসড়ক দখল করে গড়ে তোলা লেগুনাস্ট্যান্ডে যাত্রী ওঠানো-নামানোর কারণেও যানজট হচ্ছে।

এছাড়াও গাবতলী পেরিয়ে আমিনবাজার ও হেমায়েতপুর ঘুরে দেখা যায়, লোকাল গাড়ির লেনে বসেছে বাজার ও পার্কিং। মহাসড়কের লেনে রিকশা, ইজিবাইক, অটোরিকশা থেকে শুরু করে সব ধরনের গাড়িই চলছে। ঠিক একই অবস্থা দেখা যায় সাভার, বাইপাইল, জিরানীসহ অন্য এলাকাতেও। যে যার মতো সড়ক পার হচ্ছে। অযান্ত্রিক গাড়িগুলো যেখানে ইচ্ছা টার্ন নিচ্ছে। এসব বিশৃঙ্খলায় মহাসড়কের গাড়ি কাঙ্ক্ষিত গতিতে চলতে পারছে না।

এ বিষয়ে জানার জন্য বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, ঈদযাত্রায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলতে দেওয়া হবে না। টার্মিনাল থেকে আটকে দিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত নামানো হবে। সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা ভালো দাবি করেছেন সওজের প্রধান প্রকৌশলী একেএম মনির হোসেন। তিনি এক বিবৃতিতে জানান, এবার সারা দেশে রাস্তার অবস্থা ভালো।  যানজট হওয়ার কোনো কারণ তিনি দেখছেন না বলে জোর দাবি করেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads