• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে যানজট

সংগৃহীত ছবি

যোগাযোগ

পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে যানজট

  • রতন বালো
  • প্রকাশিত ১৮ জুলাই ২০২২

দুলাল মিত্র। বয়স ৬২ কাছাকাছি। পেশায় আইনজীবী। নিজে কয়েকবার বাগেরহাটের খান জাহান আলী মাজার দেখতে গেলেও পরিবার নিয়ে যাওয়া হয়নি। স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন তাদের আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। পদ্মা সেতু দেখা ও মাজার জিয়ারতের জন্য স্ত্রী ও মেয়েসহ গত ১৫ জুলাই বাগেরহাটের উদ্দেশ্যে রওনা হন।

তিনি বলেন, স্বপ্নের পদ্মা সেতু হয়ে মাত্র ৩ ঘণ্টায় পৌঁছে যাই বাগেরহাটে। কিন্তু ফেরার পথে মাত্র ২ ঘণ্টায় পদ্মা সেতুর কাছে এসে ২ কিলোমিটার লম্বা লাইনে আরো ২ ঘণ্টা লেগে যায় টোল দিতে। এরপর  বঙ্গবন্ধু মহাসড়কের টোল দিতে একঘণ্টা আর মো. হানিফ ফ্লাই ওভারের জ্যামে পড়ে রাত ১ টায় শান্তিনগরের বাসায় ফিরেন। তিনি অভিযোগ করেন, পদ্মা সেতুর টোলপ্লাজায় অব্যবস্থাপনায় প্রতিদিন ২-৫ কিলোমিটার যানজট হচ্ছে। আর ভোগান্তির শিকার হন যাত্রীরা।

তিনি আরো বলেন, সেতুর প্রতিটি বুথে ধীরগতিতে টোল আদায়ের কারণে এক থেকে দেড় ঘণ্টা যানবাহনের দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করতে হয়। এছাড়া সেতু টোলের লেন ছোট করে তৈরির কারণে যানবাহন চলাচলের সময় টোল বুথে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বাসের লুকিং গ্লাস ভেঙে যায় বলে জানান তিনি।

শুধু দুলাল মিত্রই নয়, তার মতো বরিশাল শহরের স্থায়ী বাসিন্দা আমিনুল ইসলামও এই অভিযোগ করেন। তিনি জানান, ভাবছিলাম পদ্মা সেতু দিয়ে অনেক কম সময় ঢাকায় আসতে পারব। কিন্তু সেতুর টোলপ্লাজার জ্যামের কারণে এক ঘণ্টার বেশি সময় চলে যায়। আর গৌরনদী থেকে ফরিদপুর ভাঙ্গা পর্যন্ত দুই লেনের সড়ক অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। তাই ভাঙ্গা পর্যন্ত আসতে সন্ধ্যা সাতটা পার হয়ে যায়। আর টোলপ্লাজায় যানজট না থাকলে আরো একঘণ্টা আগে ঢাকায় পৌঁছানো যেত বলে জানান তিনি জানান।

এদিকে সেতু কর্তৃপক্ষ জানান, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর বাস ও ট্রাকের আঘাতে এ পর্যন্ত দুই প্রান্তের ৫-৬টি টোল বুথ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সোয়া ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুতে মাত্র ১২টি টোলবুথ পর্যাপ্ত নয় বলে সেতু বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেন। তারা দেড় থেকে দুই ঘণ্টা যানজট দূর করতে হলে  টোলপ্লাজাগুলো ডিজিটাল করার পরামর্শ দেন।

গত শনিবার সরেজমিনে পদ্মা সেতু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সেতুর মাওয়া ও জাজিরা দুই প্রাপ্তের টোলপ্লাজার সামনে দীর্ঘ লাইন। যানবাহনের চাপের কারণে মাওয়া প্রাপ্তের প্রায় ৫ কিলোমিটার ও জাজিরা প্রান্তের ২ কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয়েছে মাওয়া প্রান্তের টোলপ্লাজা থেকে শুরু হওয়া এই যানজট পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়কের সার্ভিস এরিয়া-১ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সেতু কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার কারণে টোলপ্লাজা অতিক্রম করতে প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় বলে চালকরা জানান।

এ বিষয়ে শরীয়তপুরের ইলিশ পরিবহনের এক চালক  মো. সালাম হোসেন জানান, এত বড় সেতুতে মাত্র ৬টি টোল বুথ দেওয়া হয়েছে। গাড়ির চাপ আরো বাড়লে এই যানজট প্রায় ১০ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যাবে। সেতুর টোলের রাস্তা এত ছোট যে, খুব ধীরে গাড়ি চালাতে হয়। এতে পিছনে যানজট সৃষ্টি হয়। এছাড়া প্রথম দিকে কিছু মহিলা টোল আদায় করত। তারা অনেক স্লো ছিল।

মাওয়া প্রান্তে  মো. মিরন মিয়া নামের অপর এক প্রাইভেটকার চালক জানান, সেতুর টোল বুথগুলো অনেক বড় কিন্তু গাড়ি যাওয়ার রাস্তা ছোট। তাই বড় বাসের লুকিং গ্লাসের সঙ্গে টোল বুথের প্রায় সংর্ঘষ হয়। তাই টোলপ্লাজায় প্রবেশের আগেই গাড়ির গতি কমিয়ে দেয় সেতুর লোকেরা। ছোট ছোট ব্যারিকেড দিয়ে গাড়ি নিন্ত্রয়ণ করার কারণে এভাবে যানজটের সৃষ্টি।

বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. মো. সামছুল হক বলেন, পদ্মা সেতু টোলপ্লাজায় অব্যবস্থাপনা লক্ষ করা যাচ্ছে। এ কারণে টোল আদায় করতে সময় লেগে যায়। আর সময় লেগে যাওয়ার কারণেই পদ্মা সেতুর দুই পারে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। এত বড় অবকাঠামোর নির্মাণ করা হলেও পরিকল্পনা ও সমন্বয়হীনতার কারণে টোলপ্লাজায় এই সমস্যাগুলো সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্বের কোথাও এখন আর ম্যানুয়েল টোল আদায় করা হয় না। বড় বড় মহাসড়ক ও সেতুতে সবখানে এখন ডিজিটাল টোল আদায় করা হয়। পদ্মা সেতুতে তাই করতে হবে। এছাড়া একই মহাসড়কে পর পর তিন-চারবার টোল আদায়ের যানবাহনের গতি অনেকটা স্লো হয়ে যায়।  দ্রুত এই সমস্যা দূর করার জন্য টোলপ্লাগুলো ডিজিটাল করার পরামর্শ দেন তিনি।

মো. আব্বাস নামের এক পিকআপ চালক জানান, যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান হানিফ ফ্লাইওভারে শনিরআখড়া দিকে ৬টা করে ১২টা টোলঘর। ওখানে কোনো সমস্যা হয় না। পদ্মা সেতুতে যত ঝামেলা। টোল ঘর বানাইছে কম। এহন খালি জ্যাম লাইগ্যা থাকে বলে তিনি অভিযোগ করেন। বিশেষ করে বিকেল ৪টার পর থেকে কম করে হলেও ২ কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয় পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে।

তবে সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন টোল আদায়ে অব্যবস্থাপনা বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তিনি মুঠোফোনে বলেন, ১৫ জুলাই সরেজমিনে পদ্মা সেতুর জাজিরা টোলপ্লাজা পরিদর্শন করেছি। ঈদের যানবাহনের চাপের কিছু যানজট তৈরি হয়েছে। কিন্তু টোল আদায়ের কোনো ধীরগতি ছিল না।

পদ্মা সেতুর টোল আদায়কারী ও সেতুর রক্ষণাবেক্ষণে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে কোরিয়া এক্সপ্রেস করপোরেশন (কেইসি) ও চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি)। আগামী পাঁচ বছরের জন্য এই দুটি প্রতিষ্ঠান টোল আদায়, সেতু ও সেতুর দুই প্রান্তে যানবাহন চলাচল ব্যবস্থাপনায় আধুনিক পদ্ধতি চালু এবং সেতু ও নদীশাসনের কাজ রক্ষণাবেক্ষণ করবে। এর জন্য ৫ বছরে তাদের দিতে হবে ৬৯৩ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads