• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
চলতি মাসেই শুরু হচ্ছে পদ্মা সেতুতে রেলের কাজ

সংগৃহীত ছবি

যোগাযোগ

চলতি মাসেই শুরু হচ্ছে পদ্মা সেতুতে রেলের কাজ

  • রতন বালো
  • প্রকাশিত ১৯ জুলাই ২০২২

মো. আনোয়ার হোসেন সিকদার। বয়স ৭৫ অতিক্রম করেছে। পেশায় ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী হলেও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জে তার গ্রামের বাড়ি। এক সময় যানজটসহ নানা দুর্ভোগ মোকাবিলা করে ঢাকায় আসা ও যাওয়া করতে হতো। পদ্মা সেতু চালুর পর দুর্ভোগ কমে গেছে। ১৬ জুলাই বিকেল সাড়ে ৩টায় বরিশাল থেকে বাসে উঠেন ঢাকায় আসার জন্য। সন্ধ্যা ৭টায় গুলিস্থান পৌঁছান। মাত্র সাড়ে ৩ ঘণ্টায় বরিশাল থেকে ঢাকায় আসেন। স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে এক থেকে দেড় ঘণ্টায় বরিশাল থেকে ইলিশ মাছ ঢাকায় আনা সম্ভব হবে।

তিনি বলেন, যে জেলায় রেল নাই তার নাম বরিশাল। আর সেই জেলায় যাবে রেল। ইলিশের আতুর ঘড় বরিশাল। প্রতিদিনের ইলিশ প্রতিদিনই ঢাকাসহ সারা দেশে পৌঁছাতে সম্ভব হবে। উপকৃত হবে আমাদের ক্ষুদ্র জেলেরা। অল্প সময়ে দরিদ্র মানুষ ট্রেনে করে আসা-যাওয়া করতে পারবেন। লঞ্চের ঘাটে ঘাটে নির্যাতন থেকে মুক্তি পাবে জেলেরা। রেল একটি সরকারি বাহন। দরিদ্র মানুষগুলো কাজের সুযোগ পাবেন। বরিশাল, মেঘনা, পায়রা, বাঁশখালী, ধলেশ্বরী, মেঘারচড় ও আড়িয়াল খা নদীগুলো হলো ইলিশের ডিম ছাড়ানোর স্থান। সে কারণেই বরিশাল, কলাপাড়া, পায়রা হলো ইলিশ মাছের বড় আড়ত। এ অঞ্চলের প্রায় ৩ লাখ জেলে ইলিশসহ বিভিন্ন মাছ দ্রুত সময়ে রেল যোগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিতে সহজ হবে বলে আনোয়ার হোসেন জানান।

ঈদের পর পটুয়াখালীর কুয়াকাটা হতে ঢাকা ফিরার পথে তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে মো. আনোয়ার হোসেন সিকদার এর মতো বরিশালে স্থানী বাসিন্দা ও বরিশাল বি এম কলেজের সাবেক জি এস শামসুল আলম জানান, ঢাকা-মাওয়া, ভাঙ্গা-বরিশাল ও পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেল লাইন খুব প্রয়োজন। তা দ্রত বাস্তবায়ন হলে অভাবি মানুষ অল্প মূল্যে মালামাল ক্রয় ও বিক্রয়ের জন্য রেলপথে চলাচল করতে পারবে।

তিনি বলেন, পায়রা বন্দর থেকে বিভিন্ন মালামাল দ্রুত সময়ে রেল পথে ঢাকায় নেওয়া সম্ভব হবে। বিশেষ করে পায়রা বন্দর এলাকায় বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কর্মকাণ্ড হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ২০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের পথ খুলে গেল। রেল পথ চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের চলাচলের পথও সুগোম হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে রেল পথ বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে শামসুল আলম জানান।

এদিকে, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ২১ দিন পর সেতুতে রেললাইন বসানোর কাজের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে রেললাইন বসানোর কাজ শুরু হবে। গত রোববার সকালে রেল সংযোগ কাজের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে সেতুর নিচের অংশ রেলওয়ে কাছে বুঝিয়ে দেন সেতু কর্তৃপক্ষ। বুঝে পাওয়ার এক সপ্তাহ পর পদ্মা রেল সংযোগের কাজ শুরু হবে। মূল সেতু ও ভায়াডাক্টসহ প্রায় ৭ কিলোমিটার ডুয়েল গেজ সিঙ্গেল লাইন বসানো হবে। এটা শেষ করতে ছয় মাস সময় লাগবে বলে রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে।

অন্যদিকে, আগামী বছর জুনের মধ্যে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত নতুন লাইনে ট্রেন চালানো সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন রেলপথ মন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বের ফলে আমাদের গর্বের পদ্মা সেতু অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন হয়েছে। এই সেতুতে রেল সংযোগের ব্যবস্থা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প সরকারের দশটি অগ্রাধিকার প্রকল্পের একটি। এটি ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মিত হবে। ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা আছে। সময় মতো বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি অংশ ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত, দ্বিতীয় অংশ মাওয়া থেকে ভাঙ্গা এবং তৃতীয় অংশ ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত। পরবর্তীতে যশোর থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেল লাইন হবে। এ সময় তিনি বিভিন্ন অংশের কাজের অগ্রগতি তুলে ধরে বলেন, মাওয়া থেকে ভাঙ্গা অংশের অগ্রগতি ৮০ শতাংশ, ঢাকা থেকে মাওয়া অংশের অগ্রগতি ৬০ শতাংশ এবং ভাঙ্গা থেকে যশোর সেকশনের কাজের অগ্রগতি ৫১ শতাংশ এবং সার্বিক কাজের অগ্রগতি ৬০ শতাংশ।

মন্ত্রী উল্লেখ করেন, ঢাকা থেকে ভাঙা পর্যন্ত রেললাইন নির্মিত হলে ঢাকা থেকে ফরিদপুর রাজবাড়ী হয়ে খুলনা, যশোর, দর্শনা, বেনাপোল পর্যন্ত ট্রেন চালানো সম্ভব হবে। এছাড়া খুলনা থেকে মংলা পর্যন্ত নতুন লাইন যেটি এই বছর ডিসেম্বরের মধ্যে চালু হয়ে যাবে, ফলে তা মংলা পর্যন্ত চালানো সম্ভব হবে। সেতুতে রেললাইন বসানোর সময় কম্পন এর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে রেলপথ মন্ত্রী এ বিষয়ে টেকনিক্যাল টিম কাজ করছে। তারা সমস্ত কিছু দেখে সম্ভাব্য সমাধান করবেন।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালে মার্চে অথবা জুনে ঢাকা-ভাঙ্গা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণকাজ শেষ করা পরিকল্পনা রয়েছে। ওই বছরের ২৬ মার্চ রেললাইন উদ্বোধনের কথা রয়েছে। যদি কোনো কারণে তা সম্ভব না হয়, তবে জুন মাসে উদ্বোধন করা হবে। ওই সময় ওই অংশে রেলওয়ে অপারেশন শুরু হবে। তবে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২৪ সালের জুনে।

পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) অনুমোদনের সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু ২০১৯ সালের এপ্রিলে প্রকল্পের ব্যয় আরো ৪ হাজার ২৬৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা বৃদ্ধি করে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৩৯ হাজার ২৫৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এছাড়া ২০২৪ সালে জুনে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো প্রস্তাব অনুমোদন দেয় একনেক সভা।

সরকারি ব্যবস্থাপনার (জিটুজি) ভিত্তিতে প্রকল্পের অর্থায়ন করছে চায়না এক্সিম ব্যাংক। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ সহায়তা দিবে ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ। বাকি ১৮ হাজার ২২১ কোটি ৪৪ টাকা ব্যয় হয়ে সরকারি ফান্ড থেকে। মূল প্রকল্পে ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকার মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ছিল ৯ হাজার ৯৫৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। ব্যয়বৃদ্ধির এই প্রকল্পটিতে সরকারি অর্থায়ন ১৮ হাজার ২২১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া চীন সরকার জিটুজি পদ্ধতিতে ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা অর্থায়ন করতে সম্মত হয়েছে। যা আগে ছিল ২৪ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের এপ্রিলে চীনের সঙ্গে চূড়ান্ত ঋণচুক্তি হয়। এর দুই বছর আগে কমার্শিয়াল চুক্তি হয়েছিল। প্রকল্পের নির্মাণকাজ করছে চায়না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিআরইসি।

জানা গেছে, কমলাপুর থেকে যশোর পর্যন্ত রুটে ২০টি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে ১৪টি স্টেশনই হবে নতুন। পুরনো ছয়টি স্টেশনকে ঢেলে সাজানো হবে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে। কেরানীগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের নিমতলায় নতুন দুটি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। এরপর নির্মাণ করা হবে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর ও মাওয়া স্টেশন। মাওয়া স্টেশনটি হবে তুলনামূলক বেশি নান্দনিক। প্রকল্প অনুযায়ী দূর থেকে এটাকে দেখলে কোনো উন্নতমানের শপিংমল মনে হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

মাওয়া স্টেশনের পরে পদ্মা সেতু পার হয়ে শরীয়তপুরের জাজিরায় নির্মিত হবে ‘পদ্মা স্টেশন’। ‘মাওয়া স্টেশন’ থেকে পদ্মা স্টেশনের দূরত্ব হবে ১৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে ছয় কিলোমিটার পড়বে পদ্মা সেতুতে। তবে সেতুপাড়ের মানুষকে স্টেশনে যেতে দুই থেকে তিন কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হবে বলে রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানান। পদ্মা স্টেশনের পরে শরীয়তপুরে হবে ‘শিবচর স্টেশন’।

এছাড়া ফরিদপুরের ভাঙ্গায় উন্নত দেশের আদলে নির্মাণ করা হবে জংশন। ভাঙা থেকে একটি লুপ লাইন ফরিদপুর সদর ও অন্য একটি লুপ লাইন নাগরকান্দা পর্যন্ত যাবে। প্রকল্পের আওতায় নাগরকান্দায় স্টেশন নির্মাণ করা হবে। এরপর গোপালগঞ্জের মকসুদপুর ও মহেশপুরে নির্মিত হবে দুটি রেলস্টেশন। এছাড়া নড়াইলের লোহাগড়া, নড়াইল সদরে একটি করে স্টেশন নির্মাণ করা হবে। যশোরের জামদিয়া ও পদ্মবিলে দুটি নতুন স্টেশন নির্মাণ করা হবে বলে প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান।

এই প্রকল্পের আওতায় ছয়টি রেলস্টেশন ঢেলে সাজানো হবে। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। এছাড়া গেণ্ডারিয়া ও ফরিদপুরের ভাঙ্গা স্টেশন নান্দনিক করে গড়ে তোলা হবে। সংস্কার করা হবে তিনটি স্টেশন। সেগুলো হলো— গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি, যশোরের সিংগাই ও রূপদিয়া স্টেশন। বিদ্যমান এসব স্টেশন নতুন আঙ্গিকে গড়ে তোলা হবে বলে রেলওয়ে সূত্র জানায়।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads