• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

অপরাধ

ভয়ংকর হয়ে উঠছে ‘নারীফাঁদ’

কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে অর্ধশতাধিক চক্র

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১

কখনো মিলা, আবার কখনোবা লিনা মাহমুদ। কৌশলে বড় ব্যবসায়ীদের মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করে প্রেমের অভিনয়। একপর্যায়ে লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া। এজন্য ভুয়া বিয়ে নয়তো অশ্লীল কিংবা অন্তরঙ্গ ছবি তুলে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি। এভাবেই চলছিল তাদের প্রতারণা। সবশেষে টার্গেট কারওয়ানবাজারের বড় এক ব্যবসায়ী। কৌশলে বাসায় ডেকে ভুয়া বিয়ের কাগজপত্র তৈরি করে দাবি করা হয় ৭ লাখ টাকা। ওই ব্যবসায়ী স্ট্যাম্পে টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। এতেই মুখোশ উন্মোচন হয়ে যায় সেই মিলা বা লিনা মাহমুদের। আটকা পড়েন গোয়েন্দা জালে। 

দীর্ঘ প্রায় ৫ বছর ধরে এভাবেই প্রতারণা করে যাওয়া এই চক্রটিকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের একটি টিম। জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। দেশে কিংবা দেশের বাইরে সব জায়গাতে প্রতারণার জাল ছড়ানো চক্রটি গত ৫ বছরে এভাবে কোটি টাকার ওপরে হাতিয়ে নিয়েছে।

গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, এই চক্রের মোট সদস্য ৫ জন। এর মধ্যে লিনা মাহমুদ ওরফে মিলা হচ্ছে প্রধান। বাকিরা তার সহযোগী। সহযোগীরা বড় ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, এমনকি প্রবাসীদের মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করে তাকে দেয়। পরে কৌশলে ফোনে কথা বলে প্রেমের ফাঁদ পাতে।  এক সময় প্রেমিককে বাসায় ডাকে। একপর্যায়ে অন্তরঙ্গ ছবি তুলে টাকা দাবি করে। অনেকে সম্মানের ভয়ে টাকাও দেন।

তিনি বলেন, চক্রটি শুধু প্রেমের ফাঁদ নয়, অনেক সময় ভুয়া বিয়েও করে। সেই বিয়ের কাবিনের টাকা আদায়ও করে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো লিনা মাহমুদ ওরফে মিলা, তার সহযোগী মনির ও ভুয়া কাজী হাবিবুর রহমান।

গোয়েন্দা পুলিশের সূত্রটি জানায়, গ্রেপ্তারকৃতরা পেশাদার সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের সক্রিয় সদস্য। তারা ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ধনীদের টার্গেট করে। টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে নারী সদস্যদের দিয়ে ফোন করে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে  নির্ধারিত বাসায় ডেকে আনে। এ সময় নারী সদস্যদের দিয়ে ভিকটিমের আপত্তিকর ও নগ্ন ভিডিও ও ছবি তোলে।

জানা যায়, গ্রেপ্তারকৃত ও তাদের সহযোগীরা ভিকটিমকে জিম্মি করে টাকা দিতে বাধ্য করে। টাকা না দিলে ভুয়া স্ট্যাম্প ও ভুয়া কাবিননামা আর ভুয়া কাজি দিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করে। এরপর নারী নির্যাতন ও যৌতুক মামলার হুমকি ও ভয়-ভীতি দেখায়।

২০ কোটি টাকা প্রতারণা করে জান্নাত এখন জেলে : বিভিন্ন পত্রিকায় ‘উন্নত দেশগুলোর নাগরিকত্ব’ এমন লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণাই তার ছিল পেশা। নাম জান্নাতুল। কানাডা প্রবাসী, শর্ট ডিভোর্সি অথচ নিঃসন্তান সুন্দরী-এমন নানা উপমা দিয়ে পত্রিকায় মনভোলানো বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো। বিয়ে করে বিদেশে আয়েশি জীবনের সেই হাতছানির ফাঁদে পা দিলেই হাতিয়ে নিতেন কোটি কোটি টাকা। এভাবে জান্নাত অন্তত ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ধরা পড়ে সিআইডির জালে।

সিনিয়র এসপি জিসানুল হক জানান, প্রতারণার শিকার একজনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রতারক চক্রকে গ্রেপ্তার করেছি। সেইসঙ্গে তার ৫ সহযোগীকেও আটক করা হয়। তিনি জানান, এসএসসি পাস করতে না পারা জান্নাত প্রতারণায় পিএইচডি। এ পর্যন্ত প্রতারণার মাধ্যমে প্রায় ২০ কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক হয়েছেন তিনি। প্রথম স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করা স্বামীকে নিয়ে নামেন এই প্রতারণায়।

তিনি জানান, গত বছরের আগস্টে একটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী কানাডার নাগরিক, ডিভোর্সি সন্তানহীন, নামাজি পাত্রীর জন্য ব্যবসার দায়িত্ব নিতে আগ্রহী বয়স্ক পাত্র চেয়ে একটি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। আগ্রহীদের একটি মোবাইল নম্বর দিয়ে বারিধারার একটি বাড়িতে যোগাযোগ করতে বলা হয়। সিআইডির কাছে অভিযোগ দেওয়া ভুক্তভোগী নাজির হোসেন ওই বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করেন। পরে তার সঙ্গে গুলশানের একটি রেস্টুরেন্টে দেখা করেন জান্নাত। এ সময় ভুক্তভোগী নাজির দেড় লাখ টাকা ও পাসপোর্ট তুলে দেন জান্নাতের হাতে।

পরে জান্নাত নাজির হোসেনকে জানান, তিনি নিজেই পাত্রী। কানাডায় দুইশ কোটি টাকার ব্যবসা আছে। কিন্তু বর্তমানে কানাডায় অনেক শীত থাকায় নাজির হোসেনকে নেওয়া যাচ্ছে না। এরপর দেশে ব্যবসার জন্য কানাডা থেকে টাকা আনার কথা বলে ট্যাক্স, ভ্যাট, ডিএইচএল বিল ইত্যাদি খরচের কথা বলে এক কোটি ৭৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। জান্নাত এরপর মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেন। নাজিরের সঙ্গে যোগাযোগও বন্ধ করে দেন। পরে ভুক্তভোগী নাজির হোসেন এ বিষয়ে সিআইডিতে অভিযোগ করেন।

একইভাবে অন্য একজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় জান্নাতকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। সিআইডির এই কর্মকর্তা জানান, উদ্ধার করা খাতায় বিগত দিনের প্রতারণার হিসাব ও ভুক্তভোগীদের নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়। জান্নাতের নেতৃত্বে এই চক্রটি গত ১০ বছর ধরে এমন প্রতারণা করে আসছিল। এখন পর্যন্ত সিআইডি তাদের ২০ কোটি টাকার সম্পত্তির সন্ধান পেয়েছে।

গোয়েন্দা পুলিশের সূত্র জানায়, রাজধানীতে এ ধরনের অর্ধশতাধিক চক্র রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি চক্র গ্রেপ্তারও হয়েছে। এদের কাজই হলো নারী দিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পাতা। বিশেষ করে মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, বাড্ডা এলাকায় এই চক্রের সদস্যরা বেশি থাকে। 

 গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার বায়েজীদুর রহমান বলেন, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও প্রতারণা ফাঁদ পাতা কয়েকটি চক্রকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বর্তমানে ফেসবুক, ইমো, হোয়াটস অ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করেও নারীদের প্রতারণার অভিযোগও পাচ্ছি। আমরা সবাইকে সচেতনত হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। সচেতন হলেই এ ধরনের অপরাধ কমে যাবে।

ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সাইবার ক্রাইমের অতিরিক্তি উপ-পুলিশ কমিশনার নাজমুল ইসলাম বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করে প্রতারণা অভিযোগ এখনো অনেক বেশি। নারী ও পুরুষ উভয়েরই অভিযোগ আসছে।

তিনি বলেন, নারীদের দ্বারা ব্ল্যাকমেইলিং শিকার যেমন হচ্ছে, তেমনি পুরুষের দ্বারা  ব্ল্যাকমেইলিং শিকার হচ্ছে অনেকে। তবে অধিকাংশই সম্মান নষ্টের ভয়ে নিজেরাই মিটিয়ে নিচ্ছে, আবার অনেকে অভিযোগও দিচ্ছেন। এ ধরনের বেশ কিছু সিন্ডিকেটকে আমরা আটকও করেছি। নাজমুল ইসলাম বলেন, সবচেয়ে বড় বিষয় হলো সতর্কতা। লোভ সংবরণ করে সতর্কতার সঙ্গে চলাচল করলে সমস্যায় পড়তে হবে না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads