• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে চলছে মহাদুর্নীতি

সংগৃহীত ছবি

অপরাধ

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে চলছে মহাদুর্নীতি

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ০৪ এপ্রিল ২০২১

অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটে মহাসিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে। এদের অপতৎপরতায় প্রতিষ্ঠানটির চলমান ৩৮ প্রকল্পের কাজে অগ্রগতি নেই।  এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলা অফিসের আওতায় ২০১৫ সালে শেষ হওয়া প্রকল্পে সরকারের দেওয়া ২৬২টি গাড়ি ও ৬০৩টি মোটরসাইকেল গায়েব হয়ে গেছে। তা ছাড়া করোনা মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের প্রণোদনার অর্থও আত্মসাৎ করা হয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) একটি টিম প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর (খামারবাড়ি, ফার্মগেট) অফিসে অডিট করে রিপোর্ট তৈরি করে। ওই অডিটকালে গাড়ির ফাইলপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অধিদপ্তরের একাধিক প্রকল্পে সরকারের ২৬৭টি গাড়ি ও ৬০৩টি মোটরসাইকেল ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু প্রকল্প সমাপ্তের পর মাত্র ৫টি গাড়ি কেন্দ্রীয় পরিবহন পুলে জমা দেওয়া হয়। মোটরসাইকেলসহ বাকি ২৬২টি গাড়ি কোথায় আছে বা কার মাধ্যমে ব্যবহার হচ্ছে, কে ব্যবহার করছে তার কোনো হদিশ নেই।

প্রকল্পে গাড়িগুলো দেওয়ার নথিপত্র পাওয়া গেলেও গাড়ি প্রাপ্তি স্বীকার সংক্রান্ত কোনো পত্র পাওয়া যায়নি। এমনকি গাড়িগুলোর তালিকার নিচে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তার স্বাক্ষর ছিল না। অধিদপ্তরে বাস্তবে কতগুলো গাড়ি আছে এরও কোনো রেকর্ড পাওয়া যায়নি। বিধি মোতাবেক প্রকল্পের কাজ শেষে গাড়ি জমা দেওয়ার কথা সরকারি কেন্দ্রীয় পরিবহন পুলে। কিন্তু গাড়িগুলো সেখানেও জমা হয়নি। বাস্তবে এসব গাড়ি এখন কোথায় আছে, কারা ব্যবহার করছে-এ তথ্য নেই অধিদপ্তরের কাছে। গাড়ির সন্ধানে চিঠি চালাচালি হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও নিরীক্ষা অফিসের মধ্যে। কিন্তু গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের কাছে মেলেনি সঠিক উত্তর। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

প্রসঙ্গত, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আদেশ নং সম(পরি)-স্থায়ী কমিটি/৪৪/২০০৫ (অংশ-১)-৭২১ তারিখ ০৮/০১/২০০৬ অনুযায়ী প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে প্রকল্পের সচল যানবাহন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় পরিবহন পুলে জমা করার নির্দেশনা আছে।

জানা গেছে, গাড়িগুলোর প্রসঙ্গে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে একটি জবাবে বলা হয়েছে টিওঅ্যান্ডই (টেবিল অব অর্গানিসটিও অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট) ভুক্ত করতে মন্ত্রণালয় বরাবর পত্র দেওয়া হয়েছে। সম্প্রসারণ কাজে বিভিন্ন জেলায় গাড়িগুলো নিয়োজিত আছে। কিন্তু এই জবাব যথাযথ নয় বলে জানায় অডিট অফিস। কারণ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রকল্পগুলো সমাপ্ত হওয়ার পর কেন্দ্রীয় পরিবহন পুলের মহাপরিচালকের মাধ্যমে জমা করার বিধান রয়েছে। এই বিধান পরিপালন করা হয়নি। এ ছাড়া এসব গাড়ি কোথায়, কার মাধ্যমে ব্যবহার হচ্ছে তার প্রমাণ সরবরাহ করা আবশ্যক।

সিএজি প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, কেন্দ্রীয় পরিবহন পুলের মহাপরিচালকের কাছে মাত্র ৫টি গাড়ি জমা দেওয়া হয়েছে। এই অনিয়মের বিষয়ে অডিট অফিস থেকে একটি অগ্রিম অনুচ্ছেদ জারি করা হয়। কিন্তু এর জবাব পাওয়া যায়নি। জবাব না পেয়ে এ বিষয়ে তাগিদ দিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সচিবকে আধা-সরকারি পত্র দেওয়া হয়। কিন্তু সে পত্রের কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

এদিকে ৬০৩টি মোটরসাইকেল প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক সুনীল চন্দ্র ঘোষের স্বাক্ষরিত সমাপ্ত প্রকল্পের যন্ত্রপাতি বিভাজনে দেখা গেছে বিভিন্ন সমাপ্ত প্রকল্পে ৬০৩টি মোটরসাইকেল কোথায় ব্যবহার হচ্ছে সে ঘরটি ফাঁকা। অর্থাৎ এসব মোটরসাইকেলের কোনো হদিশ নেই।

এ ছাড়া কোথায় ব্যবহার হচ্ছে এর কোনো তথ্য নেই। সেখানে বলা হয়, প্রতিটি মোটরসাইকেলের মূল্য ১ লাখ টাকা ধরা হলেও সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৬ কোটি টাকার ওপরে। সেখানে আরো বলা হয়, এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক।

এই অনিয়মের বিষয়ে জানতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবদুল জব্বার শিকদারের মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সচিব রওনক মাহমুদ বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ শেষে গাড়িগুলো জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার কথা। কিন্তু আমি এখানে আসার আগের ঘটনা, তাই আমার নজরে আসেনি। যেহেতু এখন আমার নজরে এসেছে, আমি এ গাড়িগুলোর বিষয়ে খোঁজখবর নেব।

গাড়িগুলো নিয়ে সিএজি’র অডিট রিপোর্টের বিষয়টি আমার জানা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক সময় মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অফিস হয়, নতুন পদের কারণে বিভিন্ন জেলায় গাড়ি পাঠানো হয়। হতে পারে সে ধরনের কোনো বিষয় এখানে আছে। তবে জেলা অফিসে গাড়িগুলো ব্যবহার হলেও সেটি বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী হয়নি বলে অধিদপ্তরে এর সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। 

এটি বড় ধরনের দুর্নীতি উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এতগুলো গাড়ি গায়েব হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাতের শামিল। প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির বড় ধরনের সিন্ডিকেট ছাড়া এতগুলো গাড়ি নিশ্চিহ্ন হতে পারে না। এর মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও জড়িত থাকতে পারেন। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টদের এর দায় নিতে হবে। কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারবে না।

তিনি আরো বলেন, এর জবাব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে চাইতে হবে। জবাব দিতে অবজ্ঞা করতে পারবে না মন্ত্রণালয়। বিষয়টি সংসদেও আলোচনা হতে পারে। সংসদীয় কমিটি এ বিষয়ে জানতে চাইতে পারে। আর কেউ যদি এসব গাড়ি ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করে তাহলে তার বৈধ আয়ের সঙ্গে এটি অবৈধভাবে যুক্ত হবে। এ ব্যাপারেও খতিয়ে দেখা দরকার। অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। নইলে সরকারি সম্পদ এমন করে  লুটপাট হতেই থাকবে। 

এ বিষয়ে সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ডা. রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, সিএজি’র অডিট রিপোর্ট আমরা পেয়েছি। এরপর সম্প্রতি সংসদীয় কমিটির এক বৈঠকে বিষয়টি সকলের নজরে আনা হয়েছে। সমাপ্ত প্রকল্পের এতগুলো যানবাহন কেন্দ্রীয় পরিবহন পুলে জমা দেওয়া হয়নি। এর কোনো হদিশ না থাকায় সরকারের বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পরিবহন পুল ও অডিট অফিসের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করার সুপারিশ করা হয়েছে। কমিটিকে চলতি এপ্রিল মাসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২৩ সালের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের চলমনা ৩৮টি প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি খুবই কম। ৩৮টি প্রকল্পের মধ্যে ১৩টি প্রকল্পের বাস্তবায়নকাজের অগ্রগতি ২৫ শতাংশের নিচে। আটটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ ৫০ শতাংশের নিচে। ৫১ শতাংশের ওপরে ১৬টি প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ। মাত্র একটি প্রকল্পের শতভাগ কাজ শেষ হয়েছে। বাকি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন কাজ চলছে শম্বুকগতিতে। এর মধ্যে ছাগল ও ভেড়ার ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগ পেস্ট ডেস পেটিটস রুমিন্যান্টস (পিপিআর) রোগ নির্মূল ও খুরারোগ নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পটি ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি শুরু হয়। ২০২২ সালে এই প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা। এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ২ শতাংশ। ৩৪৫ কোটি দুই লাখ ৯৯ টাকার মধ্যে খরচ হয়েছে ছয় কোটি ৬১ লাখ ৪৭ হাজার। আর সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে ২০১৮ সালের জুন মাসে। ২০২৩ সালের জুনে এই প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা। এখন পর্যন্ত কাজ হয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ। এক হাজার ৮৬৮ কোটি ৮৬ লাখ ৫৬ টাকার মধ্যে খরচ হয়েছে ৩৮ কোটি ৬৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।

এ ছাড়া ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি ৪২৮ কোটি ৩৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প (এলডিডিপি) শুরু হয়। এই প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর। কিন্তু গত নভেম্বর পর্যন্ত কাজ হয়েছে ৬ শতাংশ। আর ব্যয় হয়েছে ১৯৩ কোটি ৭৩ লাখ ৮৩ হাজার টাকা, যা মোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের সাড়ে ৪ শতাংশ। প্রকল্পের জন্য একটি ফোর হুইলার, পাঁচটি ডাবল কেবিন পিকআপ, একটি মাইক্রোবাস ও ৪১৮টি মোটরসাইকেল কেনা হয়েছে।

তা ছাড়া প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) আওতায় করোনাভাইরাস মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের প্রণোদনা দেওয়ার অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি আব্দুস শহীদ বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পের জন্য মোটরসাইকেল কেনার কথা জানানো হয়েছে। অথচ আমার উপজেলায় আমি এই প্রকল্পের কোনো মোটরসাইকেল দেখিনি। এগুলো কোথায় তাহলে? প্রকল্প পরিচালক যুগ্ম সচিব, তিনি সরকারি গাড়ি পান। তাহলে আবার প্রকল্পের গাড়ি কেন।

আব্দুস শহীদ আরো বলেন, এলডিডিপি প্রকল্পের আওতায় করোনাভাইরাস মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের প্রণোদনা দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি। কমিটির পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads