• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
গুজব ছড়ানো ফেসবুক আইডি নজরদারিতে

প্রতীকী ছবি

অপরাধ

গুজব ছড়ানো ফেসবুক আইডি নজরদারিতে

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ২৩ এপ্রিল ২০২১

শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরে থেকে সরকারের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানিদাতাদের গ্রেপ্তারে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আর এটাই বিদেশে বসে দেশের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা চালানো ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযান। এ ক্ষেত্রে ওইসব দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকও করা হয়েছে। দ্রুত এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

সূত্রমতে, ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচারিত যে-কোনো অনুষ্ঠান বা কোনো ঘটনার প্রতি সাধারণ জনগণের রয়েছে আগ্রহ। আবার এ ধরনের ভিডিও’র প্রতি অনেকের রয়েছে অন্ধবিশ্বাস। এই সুযোগ কাজে লাগাতে বেশ কয়েকটি চক্র পুরনো কোনো ঘটনার ছবি কিংবা ভিডিও (সংঘর্ষ, আন্দোলন বা কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা) বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচার করতে তৎপর রয়েছে। আগের কোনো ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করে বিভিন্ন আইডি থেকে বিশেষ অ্যাপের মাধ্যমে তারা সরাসরি সম্প্রচার করছে। এতে সৃষ্টি হচ্ছে নানা ধরনের বিভ্রান্তি আর বিশৃঙ্খলা।

এসব ভিডিও’র কারণে অনেকের মাঝে উত্তেজনা ও ক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছে। উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে কেউ কেউ বিভিন্ন ধরনের অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়ে পড়ছে। দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে চক্রগুলো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। এরইমধ্যে অর্ধশতাধিক আইডি ও পেজের ওপর নজর রাখছে তারা।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাইবার ইউনিট বিভাগগুলো এরইমধ্যে অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন বিষয়ের তথ্য পর্যালোচনা করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুরনো ঘটনা নতুন করে বিশেষ অ্যাপের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছেন তারা। এর সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া অনেকেই নজরদারিতে আছেন।

গোয়েন্দা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সাম্প্রতিক হেফাজতের হরতালকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের পুরনো সংঘর্ষের ঘটনাকে বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে নতুন করে সম্প্রচার করা হয় বিভিন্ন আইডি থেকে। গত ২৬ মার্চ যাত্রাবাড়ীতে রাস্তা অবরোধ ও কয়েক ঘণ্টা বিক্ষোভ করে বিভিন্ন মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। রাত ৮টা পর্যন্ত বিক্ষোভ শেষে তারা যে যার মতো মাদরাসায় অবস্থান নেয়। কিন্তু সেদিন গভীর রাতে সেই ঘটনাকে আবারো বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে সম্প্রচার করে জনগণের কাছে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য তুলে ধরা হয়।

সেদিনকার ঘটনার বিষয়ে যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে হেফাজতের নেতাকর্মীদের সরিয়ে দেওয়া হয় রাত আটটার দিকে। এরপর রাতে সেখানে কারো অবস্থান ছিল না। কিন্তু পুরনো সেই ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়ে আবারো তারা অপতৎপরতায় জড়িত হন।’

এ ছাড়া ১৮ এপ্রিল হেফাজত নেতা মামুনুল হককে গ্রেপ্তারের পর বিকালে বায়তুল মোকাররম এলাকায় বিক্ষোভ চলছে এমন একটি ভিডিও সরাসরি সম্প্রচার করা হয় বিভিন্ন আইডি থেকে। কিন্তু সেই সময় বায়তুল মোকাররম এলাকায় এ ধরনের কোনো বিক্ষোভ কিংবা মিছিল অনুষ্ঠিত হয়নি। পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু বক্কর সিদ্দিকী বলেন, ‘বায়তুল মোকাররম এলাকা রোববার বিকালে ছিল শান্ত। সেখানে কোনো ধরনের বিক্ষোভ-সমাবেশ হয়নি।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ পুরনো ভিডিও ছড়িয়ে দিতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এ ধরনের অপতৎপরতা দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ব্যবহারের প্রবণতায়। এ ধরনের অসত্য তথ্য ও পুরনো ঘটনা জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। জনগণের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। তারা বলছেন, এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারের কাজ চলছে।

প্রযুক্তিবিদ তানভির খান জোহা বলেন, ‘প্রযুক্তির এ ধরনের অপব্যবহার রোধ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং বিটিআরসির কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। বাজারে বিভিন্ন ধরনের অ্যাপস রয়েছে, যেগুলো খুবই ক্ষতিকারক। এসব অ্যাপসের মাধ্যমে পুরনো যে-কোনো ঘটনা লাইভে সম্প্রচার করা যায়। এতে যে-কোনো সময় যে-কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থেকে যায়। এটি একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। যে-কোনো অ্যাপ দিয়ে লাইভ সম্প্রচারের বন্ধে বিটিআরসিকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।’

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি সোহেল রানা বলেন, ‘পুরনো কোনো সংঘর্ষ কিংবা আন্দোলনের ঘটনা লাইভ সম্প্রচার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে—এমন বেশ কিছু অভিযোগ আমরা পেয়েছি। বিষয়গুলো আমরা খতিয়ে দেখছি। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত যাদেরই পাওয়া যাবে, তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।’

জানা গেছে, প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে লাইভ করছে, এমন অর্ধশতাধিক আইডি নজরদারিতে রেখেছে সাইবার পুলিশ। এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘ফেক আইডি কিংবা অন্য কোনো আইডি থেকে যারা এগুলো প্রকাশ করছে, তাদের বিষয়ে আমাদের নজরদারি রয়েছে। ফেসবুকে নতুন আইডি খুললে তার সব তথ্যই আমাদের কাছে চলে আসবে। ফেক আইডি থেকেও কেউ বিভ্রান্তিমূলক ভিডিও ছড়ালে আমরা তাদের আইনের আওতায় আনছি।’

তিনি বলেন, ‘ফেক আইডি থেকে যারা বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়াচ্ছে, আমরা তাদের শনাক্ত করছি।  এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনকে এ ধরনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’ সোহেল রানা জানান, এ ধরনের ৬০টি ফেসবুক আইডি ও পেজ সাইবার টিমের মনিটরিংয়ে রয়েছে।

র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যারা বিভিন্ন ধরনের অপতৎপরতার সঙ্গে জড়িত রয়েছে, তাদের বিষয়ে আমরা নজরদারি করছি। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ঘটনার পেছনে কী উদ্দেশ্য রয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদে তা জানা সম্ভব হবে।’

এদিকে দেশের বাইরে বসে দেশ এবং সরকারের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে অনবরত উসকানি দেওয়া ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

একাধিক গোয়েন্দা সূত্রের বরাতে জানা যায়, গত ২৬ থেকে ২৮ মার্চে হেফাজতের তাণ্ডবের পর সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠক থেকে দেশ ও সরকারবিরোধী প্রবাসী উসকানিদাতাদের একটি তালিকা তৈরি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। নির্দেশ অনুযায়ী দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে যারা অনবরত উসকানিমূলক স্ট্যাটাস, টুইট, ইউটিউব ভিডিও আপলোড করছে এদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এই তালিকা অনুযায়ী ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু আরব দেশের প্রশাসনের সাথে স্থানীয় রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে ইতোমধ্যে যোগাযোগ করেছে সরকার।

সরকারের এক উচ্চপর্যায়ের কর্তাব্যক্তি নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানিয়েছেন, আগামী ২৩ এপ্রিলের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশে অবস্থান করে দেশের বিরুদ্ধে উসকানিদাতা অনলাইন অ্যাকটিভেস্টদের ব্যাপারে স্ব স্ব রাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ সম্পন্ন হবে এবং সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী ৩০ এপ্রিলের মধ্যে উসকানিদাতাদের কাজের পারমিট বাতিল ও আজীবনের জন্য সেই দেশ থেকে ব্যান করে দেওয়ার প্রসেস চলবে। তিনি আরো জানান, তালিকায় স্থান পাওয়া উসকানিদাতাদের সেই দেশের প্রশাসনের মাধ্যমে বাংলাদেশে ফেরত এনে আইনের আওতায় নেওয়ার প্রক্রিয়াও চলছে।

সরকারের উচ্চপর্যায়ের আর এক কর্মকর্তা জানান, দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা কাউকে ছাড় না দিতে তাদের কাছে কঠোর নির্দেশ আছে, আর সেই নির্দেশমতো বাংলাদেশ থেকে যোগাযোগের পর দেশের বিরুদ্ধে টুইটারে উসকানিমূলক টুইট করার দায়ে ইতালির রোম শহর থেকে দুজনকে আটক করেছে সেই দেশীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads