• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
মাদরাসার টাকায় তাণ্ডব চালায় হেফাজত

সংগৃহীত ছবি

অপরাধ

মাদরাসার টাকায় তাণ্ডব চালায় হেফাজত

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ০৪ মে ২০২১

রাজধানীর বিভিন্ন মাদরাসা থেকে কোটি কোটি টাকা দেশের বিভিন্নস্থানে পাঠিয়ে তাণ্ডব চালায় হেফাজত। বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ২৬ মার্চ ও এরপর যে কয়েকটি তাণ্ডব চালায় তার আগেই ঢাকার বিভিন্ন মাদরাসা থেকে বিভিন্নস্থানে টাকা পাঠানো হয়। এই টাকা পাঠানোর বিষয়টি সমন্বয় করেন হেফাজত নেতা মামুনুল হক।

রিমান্ডে থাকা মামুনুল হককে জিজ্ঞাসাবাদে এ তথ্য দিয়েছেন বলে জানান মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার কমিশনার মাহবুবুল আলম। তিনি বলেন, পূর্বপরিকল্পিতভাবেই মামুনুল হক ঢাকার কয়েকটি মাদরাসা থেকে বিপুল পরিমাণ অঙ্কের টাকা নিয়ে ওই সব স্থানে পাঠান। আর এই টাকাতেই তাণ্ডব চলে। এক প্রশ্নের জবাবে যুগ্ম-কমিশনার বলেন, কি পরিমাণ টাকা পাঠানো হয়েছিল এটি তদন্ত করা হচ্ছে।  ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডব চালানোর পর তারা নিজেদের সফল মনে করেছিলেন। এই স্টাইলে ঢাকা আক্রমণের পরিকল্পনা করে। চলতি রোজার মাসেই তারা বদর দিবস পালনের নামে ঢাকা আক্রমণ করতো। ঢাকায় কীভাবে কোন কোন স্থানে আক্রমণ করতে হবে সেই পরিকল্পনাও সেরে ফেলেছিল। সরকার পতনের লক্ষ্যে সহিংস পন্থা অবলম্বন করতে কি কি করতে হবে সবই তারা করেছিল বলে জানান যুগ্ম-কমিশনার মাহবুব আলম।

জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে জড়িত গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, মাদরাসার ছাত্রদের সহিংস করতে ট্রেনিংয়েরও ব্যবস্থা করেন তারা। তারা হেফাজতকে অরাজনৈতক সংগঠন বলে দাবি করলেও যারা এখানে রয়েছেন তারা সবাই রাজনৈতিক। ওয়াজ মাহফিলে এই সব নেতারা গিয়ে সেখানে উগ্রবাদ ছড়িয়ে দিতো।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, মামুনুল হককে জিজ্ঞাসাবাদে এখন তিনি সবই বলছেন। বিশেষ করে সরকার পতনের লক্ষে সহিংসতা চালানোর বিষয়টি তিনি স্বীকার করেছেন।  কারা তাকে মদত দিয়েছে সেগুলোর বিষয়েও তিনি তথ্য দিচ্ছেন। এর আগে সহিংসতায় হেফাজতকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া ৩১৩ জনকে চিহ্নিত করে গোয়েন্দা পুলিশ।

কর্মকর্তারা জানান, হেফাজতে ইসলামের অর্থের যোগানদাতা ৩১৩ জনকে চিহ্নিত করা হয় পাশপাশি মামুনুল হকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৬ কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। এই বিষয়ে এখনো তদন্ত চলছে। অর্থদাতাদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা পুলিশের কয়েকটি টিম কাজ করছে।

কর্মকর্তারা জানান, হেফাজতে ইসলামের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর ছেলের বিয়েতেই সাবেক আমির আল্লামা শফিকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা হয়। ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে মামুনুল হক, জুনায়েদ আল হাবিবসহ কয়েকজন নেতার বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে আল্লামা শফিকে সরিয়ে বাবুনগরীকে আমির করার পরিকল্পনা হয়।

২৬ মার্চ থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধারাবাহিক সহিংসতার ঘটনায় হেফাজতে ইসলামের সংশ্লিষ্ট নেতাদের পর্যায়ক্রমে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এরই মধ্যে গত ২৫ এপ্রিল হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়।

গত ১৮ এপ্রিল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া মাদরাসা থেকে হেফাজতের যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯ এপ্রিল তাকে একটি মামলায় সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। ২৬ এপ্রিল তাকে আদালতে হাজির করে অন্য দুই মামলায় আরো ১০ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ।

মামুনুলকে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে পুলিশ আরো জানায়, সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া হেফাজত নেতাদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। পাকিস্তানের ‘তেহেরিক-ই-লাব্বায়িক’ নামের সংগঠনের আদলে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশকে গঠন করে পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো এ দেশকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তারা।

পুলিশ আরো জানায়, গত ২৪ এপ্রিল গ্রেপ্তার হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির আহমদ আবদুল কাদের ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি। হেফাজতে ইসলামের অধিকাংশ নেতাই জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে জড়িত।

এদিকে গত ১৮ এপ্রিল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদরাসা থেকে হেফাজত নেতা মামুনুল হককে গ্রেপ্তার করা হলেও সেসময় তার মোবাইল ফোন জব্দ করা যায়নি। পুলিশ শুরু থেকেই বলছে, মামুনুলের ফোনের ভেতরে অনেক ক্লু লুকিয়ে রয়েছে। সেটি উদ্ধার করা গেলে অনেক নতুন তথ্য সামনে আসবে। শেষ পর্যন্ত তার লুকানো ফোনটি উদ্ধার করতে পেরেছে পুলিশ। মোহাম্মদপুরের মাদরাসার একটি কক্ষ থেকে সেটি উদ্ধারের পর ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। এরই মধ্যে তার মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপের চ্যাটিং লিস্ট থেকে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সূত্র থেকে তার কাছে লাখ লাখ টাকা আসার তথ্য মিলেছে।

পুলিশ বলছে, মামুনুল হকের ব্যাংক হিসাবে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের চিত্র দেখা গেছে। ভারতের বাবরি মসজিদ, কওমি মাদরাসার ছাত্রদের শিক্ষা ও হেফাজতে ইসলামের নাম করে মামুনুল মধ্যপ্রাচ্য থেকে কোটি কোটি টাকা এনেছেন। সেসব টাকা বিভিন্ন উগ্রবাদী নাশকতামূলক কাজে ব্যয় করা হচ্ছে।

আদালত সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজতের তাণ্ডবের ঘটনায় মতিঝিল থানার মামলা এবং চলতি বছরের ২৬ মার্চ বায়তুল মোকাররমে হেফাজতের তাণ্ডবের ঘটনায় দুই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে মামুনুলের ১০ দিন করে ২০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। একই মামলায় হাবিব ও কেন্দ্রীয় সহকারী মহাসচিব মাওলানা জালাল উদ্দিন আহমেদের রিমান্ড আবেদন করা হয়। ঢাকা মহানগর হাকিম সাদবীর ইয়াসির আহসান চৌধুরীর আদালত হাবিব ও মামুনুলের সাত দিন রিমান্ডের আদেশ দেন। জালাল উদ্দিন আহমেদের ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। পল্টন থানায় আরেকটি মামলায় জুনায়েদ আল হাবিবের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

ডিবির সূত্র জানায়, মামুনুলের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কর্মকাণ্ড এবং জামায়াত কানেকশন পাওয়া গেছে। এ কারণে নাশকতায় তাঁর উদ্দেশ্য এবং এর পেছনে কারা জড়িত, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মামুনুল ভারতবিরোধী মতাদর্শীর লোকজন এবং সরকারবিরোধী দলের লোকজনকে একসঙ্গে করে নাশকতার পরিকল্পনা করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠান বানচাল করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। এ জন্য ভারতে মুসলমানদের নির্যাতনে মোদি জড়িত বলে ইস্যুটিকে সামনে নিয়ে আসেন। এই ইস্যুতে সারা দেশে তিনি কিছু রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে ‘বড় মুভমেন্ট’ করার পরিকল্পনা করেন। ২০১৩ সালের মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে সরকারের পতন ঘটিয়ে অন্য দল ক্ষমতায় আসতে পারবে বলে ধারণা ছিল তাঁদের। হেফাজতের প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় তাঁর কিছুই হবে না বলে বিশ্বাস ছিল মামুনুলের। এ কারণে কৌশলে তিনি উস্কানিমূলক বক্তব্য দিতে থাকেন। প্রথমে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে মূর্তি বলে বিরোধিতা শুরু করেন। পরে মোদিবিরোধী স্লোগান তোলেন। মামুনুলের নাশকতার পরিকল্পনার পাশাপাশি তাঁর আর্থিক দুর্নীতির ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছেন গোয়েন্দারা। তাঁর নাশকতায় ব্যবহূত টাকা কোথা থেকে এসেছে এবং কোথায় গেছে তার খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads