• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
অনলাইনে আবারো সক্রিয় জঙ্গিরা

প্রতীকী ছবি

অপরাধ

অনলাইনে আবারো সক্রিয় জঙ্গিরা

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ০৭ মে ২০২১

জাতীয় সংসদ ভবনে কালো পতাকা ও তলোয়ার হাতে জঙ্গি হামলা করা হবে বলে অনলাইনে এসে সম্প্রতি হুমকি দেয় নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন আনসার আল ইসলামের জঙ্গিরা। এরপর তাদের গ্রেপ্তারে শুরু হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান। অবশেষে গত বুধবার রাতে রাজধানীর শেরেবাংলানগর এলাকা থেকে ৩ জনকে আটক করে ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। এই হামলার পরিকল্পনায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে উগ্রবাদী বক্তা আলী হাসান ওসামার নাম প্রকাশ করে। বাকিদের নাম এখনো প্রকাশ করা হয়নি। 

ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) ইফতেখায়রুল ইসলাম বলেন, কালো পতাকা এবং তলোয়ার হাতে জাতীয় সংসদ ভবনে সন্ত্রাসী হামলা পরিকল্পনায় জড়িত আনসার আল ইসলামের জঙ্গিকে বুধবার রাতে শেরেবাংলানগর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এর আগে মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর মাতুয়াইল এলাকা হতে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির দুজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে কাউন্টার টেরোরিজম। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো সাকিব আহমেদ চৌধুরী ওরফে যাকি ও অপরজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় তার নাম প্রকাশ করা হয়নি।

সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারকৃতরা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর একটি অংশ নব্য জেএমবির সক্রিয় সদস্য। তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন জেএমবির আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে ঢাকা শহরে নাশকতা সৃষ্টির পরিকল্পনার জন্য ঘটনাস্থলে মিলিত হয়েছিল।

আরো জানা গেছে, গ্রেপ্তারকৃতরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও অন্যান্য অনলাইন প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে সহিংস উগ্রবাদী মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এ সংক্রান্ত প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে আসছে। অভিযুক্তরা অনলাইনের মাধ্যমে নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন স্তরের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করতেন। গ্রেপ্তারকৃত সাকিব সিলেটের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়ন শেষে ইন্টারনেটে ফ্রি-ল্যান্সিং কাজে যুক্ত ছিলেন এবং অপরজন (অপ্রাপ্ত বয়স্ক অভিযুক্ত ) সিলেট সরকারি প্রাথমিক পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাওয়াতি কার্যক্রম চালাচ্ছে নিষিদ্ধ ঘোষিত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা। বেশকিছু অনলাইনেও এদের তৎপরতা  চোখে না পড়লেও সম্প্রতি আবারো তারা অনলাইনভিত্তিক প্রচার প্রচারনা চালানো শুরু করেছে। ২০ থেকে ৩০ বছরের তরুণ-তরুণীদের টার্গেট করে সদস্য সংগ্রহে চলে প্রথম ধাপের শুরু করে দাওয়াতি কার্যক্রম। প্রথম ধাপের ধর্মের নানা বিষয়ে অপব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গি কার্যক্রমে উৎসাহ দিতে মগজ ধোলাইয়ের কাজ করে জঙ্গি সদস্যরা। প্রথম ধাপে সফল হলে পরবর্তীতে সংগঠনের সদস্যরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ব্যবহার করে তাদের শারীরিক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়। এমনকী অস্ত্র পরিচালনার বিষয়টিও অনলাইনে পরিচালনা করে আসছে জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা।

কর্মকর্তারা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ফেক আইডি খুলে বিভিন্ন ধরনের দাওয়াতি কার্যক্রম নিয়ে উঠতি বয়সীদের নজর কাড়ার চেষ্টা করে তারা। ভিপিএন ব্যবহার করে ফেক আইডি পরিচালনা করায় তাদের কার্যক্রমের স্থান শনাক্ত করা অনেকটাই কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে তাদের নজরদারিতে রাখছে এবং গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসছে।

ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজমের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের প্রধান নাজমুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি এ ধরনের প্রবণতা আমরা লক্ষ করছি। এ বিষয়ে অনলাইনে নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে বেশ কিছু যুবক যারা অনলাইনে উগ্রবাদি ছড়াচ্ছে তাদের আইনের আওতায় এনেছি।

জঙ্গি দমনে বিশেষায়িত বাহিনী এন্টি টেরোরিজম ইউনিট বলছে, কিছুদিন আগে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে নারায়ণগঞ্জ থেকে ২ জনকে গ্রেপ্তারের পর বেশকিছু তথ্য পাওয়া গেছে। তথ্য পর্যালোচনা করে তারা জানতে পেরেছেন, জঙ্গিরা টেলিগ্রাম অ্যাপসে গ্রুপ করে নিজেদের মধ্যে  যোগাযোগ এবং তথ্য আদান-প্রদান করত। তদন্তে আরও জানা যায়, এই গ্রুপের মাধ্যমে মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিরাও  জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে রেডিক্যালাইজড করে জঙ্গি সংগঠনগুলো প্রবাসীদের দলে ভেড়াচ্ছে।

অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের তথ্যে জানা গেছে, ২০২০ সালে দেশে ৪১টি অভিযানে ৬৪ জঙ্গি সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। যার মধ্যে নব্য জেএমবির ৪ জেএমবির ৩, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এবিটি ১৪, আল্লাহর দল ১৫, আনসার আল ইসলাম ৩, উগ্রবাদ প্রচারকারী ৪। এছাড়া ২০২১ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই দুই মাসে সাতটি অভিযানে ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এ ছাড়া র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‍্যাবের অভিযানে ২০২০ সালে ১৯৭টি অভিযান পরিচালিত হয়। যেখানে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ৩৫১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ১৪৭ জনই জেএমবি সদস্য। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্যাদি।

এ বিষয়ে র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুহাম্মদ খায়রুল ইসলাম বলেন,  জঙ্গি সংগঠনগুলোর বিষয় যখনই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তখনই অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। তারা বিচ্ছিন্নভাবে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি এবং চলমান অভিযানে কারণে তাদের সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় হবার সক্ষমতা নেই। সাংগঠনিকভাবে তাদের একটিভিটিজ নেই, অনেকে বিচ্ছিন্নভাবে দাওয়াতি কার্যক্রম চালাচ্ছে। যাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তারা জামিনে বেরিয়ে এলে তাদের বিষয়েও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ নজর রাখছে।

তিনি বলেন, দেশে কোনো জঙ্গি হামলার আশঙ্কা নেই। তবে সব বিষয় মাথায় রেখেই গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। যারা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে জামিনে বেরিয়ে এসে তারা যেন আবার সেই পথে না হাটে সেজন্য পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় র্যাব ডি-র্যাডিক্যালাইজেশন প্রোগ্রাম চালাচ্ছে। যারা সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হয়ে ফৌজদারি অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে, তাদের বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে দেখছে র্যাব‌। জঙ্গিবাদ থেকে নিজেদের সরিয়ে আনতে র‍্যাবের হটলাইনে অনেক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। তথ্য পর্যালোচনা করে পরবর্তীতে তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) এর মিডিয়া অ্যান্ড অ্যাওয়ারেনেস শাখার পুলিশ সুপার আসলাম খান বলেন, যারা বিভিন্নভাবে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গিবাদে যাওয়াতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছে সে বিষয়ে এটিইউ নজর রাখছে। মসজিদ, মাদরাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের সঙ্গে নিয়ে জনগণকে সচেতন করতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। যারা জঙ্গিবাদ জড়িয়ে পড়ছে তাদের কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায় সে বিষয়েও কাজ করা হচ্ছে। তবে এসরকারিভাবে আর্থিক অনুদান পেলেন দ্রুত এ কাজ শুরু করা সম্ভব হবে।

সূত্র বলছে, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে জঙ্গি সংগঠনের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে প্রতিনিয়ত গ্রেপ্তার করা হচ্ছে অনেককে। সংগঠন থেকে দাওয়াতি কার্যক্রমের জন্য দেশের ভেতরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় কথিত হিজরত করে তারা। সংগঠনের সদস্যরা ছোট ছোট ভাগে ভাগ হয়ে স্লিপার হিসেবে কাজ করে। সংগঠনগুলো অনলাইনে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি এনালগ পদ্ধতিতেই চলে তাদের দাওয়াতি কার্যক্রম। তবে সরকারের কঠোর অবস্থান এবং লাগাতার জঙ্গিবিরোধী নজরদারির কারণে কৌশল পাল্টাচ্ছে জঙ্গিরা।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads